ঝরে গেল সুকর্ণ শওকতের জীবন

0
866


নাজমুন নাহার:

আমার একমাত্র মামাতো ভাই সুকর্ণ শওকত আজ না ফেরার দেশে। আহারে জীবন! প্রিয় মানুষগুলো এভাবে চলে যায় কোন অচিনপুরে! বুকের ভেতর চিনচিনে কষ্ট আর ব্যথা জাগিয়ে কোথায় হারিয়ে যায় প্রিয় মুখগুলো! যার সাথে মিশে আছে আমাদের জীবনের অনেক গল্প। আমাদের শৈশব-কৈশোরের গল্প। আমাদের নানা বাড়ি, মামা বাড়ির গল্প, সকল উচ্ছ্বাস, দুরন্তপনা, হাসি ঠাট্টা, খাবার টেবিলের আড্ডা, আর ভালবাসাময় দিনের কত গল্প!

করোণায় নয়, ফুসফুসের জটিলতায় অচিরেই ঝরে গেল তাঁর জীবন। মানুষ চলে যায়, স্মৃতি রেখে যায়। একদিন এভাবেই ধীরে ধীরে সবাই চলে যাবে। তিনি এমন একজন প্রিয় মানুষ ছিলেন আমাদের পরিবারের সবার মাঝে তাঁর কথা আমি না লিখে পারছি না।

তিনি এতই মিষ্টভাষী এবং ভালো মানুষ ছিলেন যে তাঁকে ঘরে বাইরে সবাই খুব পছন্দ করতো।‌ আমাদের কাজিনদের যত বাহানা, আবদার সবকিছুই সম্ভব হতো শওকত ভাইয়াকে বললে। বাইরে সবাইকে খাওয়াতে নিয়ে যাওয়া, ঘরোয়া পার্টির আয়োজন করা, পারিবারিক পিকনিক করা সবকিছুর আয়োজনে তিনি ছিলেন আমাদের সবার পারিবারিক মিলন মেলা এবং আনন্দের খুঁটি।

এছাড়াও অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারতেন এমন একজন মানুষ ছিলেন। অসুখ-বিসুখে সবার পাশে থাকা, বুদ্ধি পরামর্শ, প্রয়োজন সব কিছুর মাঝেই তার সহযোগিতার কমতি ছিল না। মধ্যরাতেও যদি কেউ ফোন দিয়ে বলতো তার কোন অসুবিধা তিনি তৎক্ষণাৎ তার পাশে এসে দাঁড়াতেন। এমনই হৃদয়বান মানুষ ছিলেন তিনি।

উত্তরাতে আমরা যেখানে থাকি ৪ নম্বর সেক্টরের ৯ নম্বর রোডে তার ঠিক কয়েক গলি পরেই ‘চাঁদ গার্ডেন’ তাঁদের বাড়ি। সেই ‘চাঁদ গার্ডেনের’ ছাদ বাগানটা অপূর্ব। অনেক গাছগাছালি লাগিয়েছে শওকত ভাইয়া, গাছ প্রিয় বাগান প্রিয় মানুষ তিনি।

যখনই আমার কোন ইন্টারভিউ পড়তো ভাইয়া আমাকে বারবার বলতো এখানে এসে শুট করবা। ওই ছাদে আমার ১৫ টার মত ইন্টারভিউ এবং ফটোশুট হয়েছে। সাংবাদিকরা যখনই আসতেন আমার শুট শেষ হওয়া পর্যন্ত পাশে থাকা, তাদেরকে আপ্যায়ন করা তাদের সাথে গল্প করা সব কিছুর মাঝেই তাঁর উচ্ছ্বাস উৎসাহ ছিলো অনেক।

আমার এই ভাইটা খুবই মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।
শুধু পরিবার নয় পরিবারের বাইরে প্রচুর মানুষকে তিনি নানাভাবে সহযোগিতা করতেন। পৈত্রিক সূত্রে তিনি অনেক সম্পত্তির অধিকারী হলেও, কঠোর পরিশ্রম করে তিনি চারটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন, এবং পাট শিল্পের ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। সেগুলো নিয়ে কখনোই তার অহংকার ছিল না। সবার মাঝে বিলাতে পারলেই তার আনন্দ ছিলো।

খুব মনে পড়ে ২০১৫ সালে আমরা লক্ষ্মীপুরে নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম একসাথে। আমার নানার একটা দ্বীপ আছে, আড়াই ঘন্টা নদী পার হয়ে সেখানে যেতে হয়। আমার নানাকে নিয়ে আমরা বেশ কয়েকজন কাজিন সেই দ্বীপে গিয়েছিলাম। অপূর্ব সুন্দর সেই দ্বীপের মধ্যে সারাদিন আমরা টইটই করে ঘুরে বেরিয়েছিলাম।

আমাদের একটা প্ল্যান ছিল সেই দ্বীপে আমরা বড় কাঠের একটা কটেজ বানাবো। বছরে দু’বার পারিবারিক মিলনের অনুষ্ঠান সেখানে হবে। তাতে সকল কাজিনদের একসাথে প্রকৃতির মধ্যে থাকা হবে, আড্ডা হবে এবং ঘোরাঘুরি হবে। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নের মানুষটা আজ আমাদেরকে ছেড়ে বিধাতার কাছে চলে গেছেন।

উচ্ছ্বাসে ভরপুর ছিল এই মানুষটির প্রাণ। গত এক বছর ধরে তার চিকিৎসার জন্য দেশে-বিদেশে অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল। ক্ষণজন্মা এই মানুষটি যদি বহু বছর আমাদের মাঝে বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমাদের সবার জীবনকে তিনি আরো অনেক কিছু দিতে পারতেন।

কি সুতোর টানে আমাদের মায়াময় জীবন বিধাতা বেঁধে দিয়েছে পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজন সবার মাঝে। কেউ চির বিদায় নিয়ে চলে যেয়ে আমাদের কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায়। আমার মা এবং আমার একমাত্র খালা তাদের খুবই আদরের ভাইপোকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন। আমার মামাতো বোনরা উত্তরা থেকে ভাইয়ের নিথর দেহ নিয়ে এখন লক্ষীপুরে আমার নানা বাড়ির পথে রওনা দিয়েছে। আগামীকাল সকাল ফজরের নামাজের পর তার জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হবে। সবাই তাঁর জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন ওনার আত্মার শান্তি দান করেন। আমিন।

‘”ভাইয়া তুমি আমাদের মাঝে চির অম্লান হয়ে রবে।””
– নাজমুন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here