নারীর অস্বাভাবিক জীবনের ফলাফল পারিবারিক বিপর্যয়

0
440

সালমা তালুকদার:
নারীর নারীবাদ, নারীর প্রতিবাদ এসব নিয়ে মানুষ কত শঙ্কিত। কত আলোচনা, কত সমালোচনা। কিন্তু একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছে এই অবস্থার শুরু কোথা থেকে?

আজকে একজন নারীর কথা বলবো। যে নারী তার স্বীকারোক্তি ও তার আচরনে বুঝিয়ে দিয়েছেন শুধুমাত্র নির্যাতনের স্বীকার হওয়ার কারনে তিনি আদর্শ মা হতে পারেননি। এবং তার হাত দিয়েই প্রতিবাদী নারী চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি একজন বয়স্কা নারী। জীবনের গোধূলি লগ্নে এসে পৌছে দেখেন, হিসেবের খাতাটা তার একেবারেই শূন্য। পেছন ফিরে তাকাতে ভয় পাচ্ছেন। কারন তার মতে, পুরোটা জীবনই তার ভুলে ভরা। ভুলগুলো যেন বড় বড় দাঁত নিয়ে তাকে কামড়াতে আসছে। মৃত্যু তার হাতের নাগালে থাকলে হয়তো তিনি এতদিনে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেন।

এই বয়স্কা নারীর বিয়ে হয় একেবারেই ছোট বয়সে। যাকে আমরা বলি বাল্য বিবাহ। বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীকে বাবা মায়ের সেবায় নিয়োজিত করে চাকরী করতে দূরে চলে যান। ছুটি ছাটায় বাড়ি এসে স্ত্রীকে গর্ভবতী করে যান৷ দফায় দফায় সন্তান জন্ম দিতে সেই নারীরও ক্লান্তি লাগে না যেন। তবে দিন রাত যে জিনিসটা তাকে ঘিরে থাকে, তা হচ্ছে শূন্যতা। বাড়ি ভর্তি মানুষ। তবু যেন কোথাও কেউ নেই। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে যখন বিছানায় আসেন তখন তার মন, শরীর দুটোই কারো সঙ্গ চায়। কারো বুকে মাথা রেখে সারাদিনের ক্লান্তি ভুলতে চায়। কিন্তু এ তো চাইলেই পাবার বস্তু নয়। বুক ভরা কান্নাকে দমন করতে করতে প্রতি রাতে ঘুমিয়ে যাওয়াটাও যেন সেই নারীর জন্য একপ্রকার যুদ্ধের সামিল।

একে তো মানসিক আর শারীরিক যন্ত্রণা তার উপর কানে আসে সংসারের একমাত্র টাকা যোগানদাতা স্বামী। যে দূরে না গেলে সংসারও যে চলবে না। তিনি নিজের মানসিক ও শারীরিক চাহিদা ঠিকই পূরন করে নিচ্ছেন। গ্রামের সরল বালিকা বধূ তখন পূর্ণ যৌবনা। এত যাতনা সহ্য করাও তার জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়ালো। কোনো এক দূর্বল মূহুর্তে দূর সম্পর্কের এক দেবরের সাথে তার শারীরিক মিলন ঘটলো। শুধু শারীরিক মিলন বলছি কারন এখানে মানসিক বন্ধনের চাইতে শারীরিক বন্ধনের জোড় বেশি। মানসিক বন্ধন হলে এই সম্পর্ক হয়তো দিনের আলো দেখতো। রাতের আঁধারেই মুখ থুবড়ে পরে যেত না।

একটা সময় পরে স্বামীর সাথে সেই নারী তার সন্তানদের নিয়ে চলে এলেন ঠিকই। কিন্তু স্বভাবে যোগ হলো প্রতিবাদ নামক বিষ। যা একটা সংসারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক। নিজের চরিত্রের এই দিকটা নিয়ে তিনি নিজেও সচেতন ছিলেন না। কিন্তু অবচেতন মনেই স্বামীর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তার আর কোনোদিন হয়নি। অবশ্য সেটা যে কেবল স্বামীর বহির্মুখী মানসিকতার জন্য তা কিন্তু নয়। স্বামী স্বভাবগতভাবেই ভীষন বদরাগী ছিলেন। অর্ধেক জীবন কষ্ট করা এই নারী স্বামীর এই চতুর্মুখী স্বভাব মেনে নিতে পারেননি। নয়তো তিনিও তো অন্য এক পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। চাইলেই স্বামীর এই জায়গাটা আনদেখা করতে পারতেন।

নিজের জীবন এক ভাবে কেটেই গেলো। মেয়েদের বেলায় যেন এমনটা না ঘটে। এই ভাবনা থেকেই তার নিজের দুই মেয়ের মনে প্রতিবাদের বীজ খুব ধীরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যার ফলে তার দুই মেয়ে নিজেদের স্বামীদের উপর তাদের সামরিক শাসন চালিয়েছেন সর্বাত্মক ভাবে। ওদিকে ছেলের অন্যায়কে যেন দেখেও দেখেননি। যার ফলে ছেলের বউ প্রথমে নাবালিকা থেকে সাবালিকা হলো। পরবর্তীতে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা শুরু করলো। এবং একটি সংসার ভেঙ্গে গেলো।

কথায় আছে অতীতই ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। বয়স্কা নারীর পুরো জীবনের প্রভাব পরলো তার কলিজার ধন সন্তানদের উপর। আর এভাবেই সমাজে মেয়ে, বউরা প্রতিবাদী নারী চরিত্রের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। ঐ বয়স্কা নারী বলছিলেন দেবরের সাথে শারীরিক মিলনটা তাকে মনসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিলো। বার বারই মনে হচ্ছিলো তিনি অন্যায় করেছিলেন। আমি বললাম, আপনারও তো একটা শারীরিক চাহিদা ছিলো। বললেন, সেই জন্যেই হয়তো নিজেকে সামলাতে পারিনি।

আমি অবাক হয়ে চারপাশে চোখ বুলোই। এরকম কত শত নারী আছেন আমাদের চারপাশে। বিয়ে নামক সামাজিক বন্ধনের আড়ালে কিভাবে নিজেদের চাহিদা গুলোর গলা টিপে হত্যা করছেন। সবচেয়ে বড় কথা একজন নারী যখন দেখছেন তার সমাজ স্বীকৃত স্বামী অনায়াসে তাকে ছাড়া অন্যদিকে যাচ্ছেন। তিনি তখন দিশেহারা বোধ করেন। কোথায় যাবেন! কার কাছে যাবেন! তাছাড়া ভালোবাসা হয় কি করে এত দ্রুত! আর ভালোবাসা ছাড়া কি শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো যায়! যদিও বা কারো সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে যান। তখন থেকেই শুরু হয় লোক জানাজানির ভয়। সাথে আছে নিজেদের বিবেকের সাথে যুদ্ধ। কারন বাংলাদেশী সংস্কৃতি তো এমনটা শেখায়নি। এমন আরো কতকিছু।

যারা সত্যি সত্যি এভাবে জীবন কাটাতে চান, তারা হয়ে যান অসচ্চরিত্র, নোংরা মেয়ে মানুষ। সতী হয়ে দুশ্চরিত্র স্বামীর সংসার করলেই কেবল শেষ বয়সে সমাজ স্বীকৃত একটা সার্টিফিকেট পাওয়া যায়।যা পরকালে সৃষ্টিকর্তার কাছে সাবমিট করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নারীদের বেলাতেই কেন এমন হবে! পুরুষের কি কোনো সার্টিফিকেটের প্রয়োজন নেই! প্রশ্ন রেখে গেলাম।

এবার আসি করোনা মহামারীর এই যুগে ঘরে ঘরে কেন এত অশান্তি, মারামারি, কাটাকাটি হচ্ছে? পত্রিকার পাতায় তো এই ব্যাপারে অভিযোগের সংখ্যাটাও উল্লেখ করে দিচ্ছে। বৈধ স্বামীরা তাদের বৈধ স্ত্রীদের দিকে চেয়ার ছুড়ে দিতেও কার্পন্য করছেন না। যদিও ঐ চেয়ারটা স্ত্রীর বাবার বাড়ি থেকে যৌতুক হিসেবে পেয়েছিলেন। আসলে স্ত্রীরা তো ফার্নিচার, গয়নার সাথে নিজেকেও একটা পন্য হিসেবে স্বামীর ঘরে বিসর্জন দেন। তো তার আর এর থেকে কি ভালো ব্যবহার পাবার কথা! একজন নারী শুধু একজন মানুষ হিসেবে যদি স্বামীর ঘরে আসতেন, তাহলে হয়তো তার কিছুটা মূল্য থাকতো। জীবনের শুরুতেই জড় বস্তুর সাথে এসেছেন বলে, জীবনের শেষ পর্যন্ত জড় বস্তুর সাথেই তাকে তুলনা করা হয়।

যাই হোক, বেশি কথায় আর যাব না। শুধু নারীদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই। পুরুষ জন্মগতভাবে অনেক শক্তিশালী। আর নারী জন্মগত ভাবেই নরম,কোমল। নারীর শরীরে পুরুষের ইস্পাত কঠিন হাতের প্রহার যতটা না নারীর শরীরে লাগে তারচেয়ে বেশি লাগে মনে। শরীরের ব্যথা হয়তো দুই দিনেই সেরে যায়। কিন্তু মনের ব্যথাটা আজীবন ভোগায়। সংসার করার আর মন থাকে না। মাঝখান থেকে কষ্ট পায় সন্তানগুলো।

তাই পরামর্শ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা নারীকে কথা বলার যে অসাধারণ গুনটি দিয়েছেন, মানে মানুষ যে কারনে নারীকে ঝগরাটে উপাধি দেয়। সে মুখটা একটু বন্ধ রাখতে হবে। আমার মা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, ” বোবার কোনো শত্রু নেই।” এই মহামারিতে যেহেতু নিজের ঘর ছাড়া যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আপাতত নারীরা আমরা বোবা হয়ে যাই। মহামারী চলে গেলে যা সিদ্ধান্ত নেয়ার নেয়া যাবে। কি প্রয়োজন এই মুহূর্তে ইচ্ছে করে নিজেকে জল্লাদের রোষানলের আগুনে পোড়ানোর? তারচেয়ে চুপ করে থাকা অনেক ভালো। এই পরিস্থিতিতে পুলিশ, ডাক্তার সবাই ব্যস্ত। আইনি লড়াই অথবা ডাক্তারি চিকিৎসা কতটুকু পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

তারচেয়ে চুপ করে থাকায় অশান্তি কমেও যেতে পারে। শারীরিক আঘাতের পরিমানও কমে যেতে পারে। পুরুষ যখন নারীর শরীরে আঘাত করে, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তাই একজন নারীর নিজেকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার নিজের। সংসার টিকবে কি টিকবে না সেটা তো পরের কথা। আগে বাঁচার রাস্তা খুঁজতে হবে।

১২ জুন ২০২০ ইং
যশোর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here