শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।
(পর্ব- ৪)
সারওয়ার সাহেব কয়েকদিনের মধ্যেই ইত্তেফাকে জানিয়ে দিলেন তিনি এখানে আর থাকবেন না। সারওয়ার সাহেবের পদত্যাগের বিষয়টি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো। মিডিয়াপাড়ায় খবরটি ছিল বেশ চাঞ্চল্যের। আর আমার ভূমিকাও জানাজানি হয়ে যায়। এরই মধ্যে পত্রিকা প্রকাশের পরবর্তী বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত আলোচনা চলতে থাকে। ক্যাম্প অফিস, নাম ইত্যাদি। অনেক চাকরিপ্রত্যাশী সাংবাদিক কর্মচারীও আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে থাকেন। কয়েকদিন পর সারওয়ার সাহেবকে নিয়ে আমরা বাবুল সাহেবের অফিসে বৈঠক বসে কয়েকটি নাম নিয়ে আলোচনা করি। আমি নিউজপ্রিন্টের প্যাডে লিখে আগেই নামের একটি তালিকা দিয়েছিলাম। যার মধ্যে নতুন সূর্য, যুগান্তর, কালান্তরসহ আরও দু’টি নাম ছিল। আমাদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল নতুন সূর্য নামটি নিয়েই আমরা অগ্রসর হব। আর ক্যাম্প অফিস করার জন্য সারওয়ার সাহেব পছন্দমত স্থান ঠিক করবেন। লোকজন নিয়োগের বিষয়, প্রেস ইত্যাদি নিয়েও আলোচনা হলো। অফিস কমলাপুরেই হবে এবং প্রি-ফেব্রিকেটেড ভবন। বাবুল সাহেব জানালেন, ইতোমধ্যেই ভবন তৈরির বিষয় তিনি চূড়ান্ত করেছেন। পরে একজন বার্তা সম্পাদক নিয়ে আমাদের কথা হলো। বাবুল সাহেব বললেন, এসব আপনারা বসে ঠিক করেন। কাদের নিলে ভাল হবে, তা আপনারা জানেন। তবুও সারওয়ার সাহেব বার্তা সম্পাদকের বিষয়টি বাবুল সাহেবের নজরে আনেন। তিনি জানান, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলকে বার্তা সম্পাদক করতে চান। আমরা আগেই এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাবুল সাহেব আবারও বললেন, লোক নিয়োগের বিষয় আপনাদের, আমার নয়। আমি কারও জন্য বলব না। যেভাবে ভাল হয় তা করেন।
কিছুদিনের মধ্যেই সারওয়ার সাহেব একটি হোটেলে ক্যাম্প অফিস শুরু করেন। জনবল নিয়োগের বিষয়ে মোটামুটি আমরা একটি গাইডলাইন ঠিক করি। সারওয়ার সাহেব ক্যাম্প অফিসে বসার পর থেকে লোকজনের ভিড় বাড়তে থাকে। সারওয়ার সাহেবের সাথে সাইফুলও বসেন। তারা পূর্ণোদ্যমে কাজ শুরু করেন। আর আমি আস্তে আস্তে যোগাযোগ কমিয়ে দিই। বলতে গেলে বাধ্য হই। কেননা তখন রাজনৈতিক উত্তাপ শুরু হয়। আমি নিজ কাজে বেশি ব্যস্ত হয়ে যাই। তবুও যোগাযোগ থাকে। বিশেষ করে বাবুল সাহেবের সাথে যোগযোগ ছিল নিয়মিত। সব বিষয়েই আমাকে অবহিত করতেন, যেমন প্রেস, ডিক্লারেশন, মার্কেটিং পলিসি ইত্যাদি নিয়েই আমার সাথে তার বেশি আলোচনা হতো। এরই মধ্যে নতুন সূর্য নামে ডিক্লারেশনের জন্য আবেদন করা হয়, কাজ অনেক দূর এগিয়ে যায়। পরে আবার নাম পরিবর্তন করে যুগান্তর করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু যুগান্তর নামের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়। তা হচ্ছে এ নামে আরেকজন ডিক্লারেশন নিয়ে গেছেন। কিন্তু পত্রিকা নিয়মিত বের হচ্ছে না। পরে মালিককে খুঁজে বের করে এই নামটি নিয়ে ডিক্লারেশন নেয়া হয়। অবশ্য এ প্রক্রিয়ার সাথে আমি যুক্ত ছিলাম না। এর জন্য নাকি অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। আমি পরে শুনেছি। আগেই বলেছি, আমি তখন নিজ পেশায় বেশি ব্যস্ত। তাই সময় দেয়া সম্ভব হয়নি। আর সারওয়ার সাহেব ও সাইফুল সারক্ষণই কাজ করছেন। কিছুদিন পর হোটেল থেকে নিয়ে কমলাপুর ক্যাম্প অফিস করা হয়। তখন সারওয়ার সাহেব সেখানে বসেন। এরই মধ্যে ভবন হয়ে যায়, প্রেস আসে। নতুন পত্রিকা। সময় লাগে দীর্ঘ। আর দীর্ঘ সময়ে সারওয়ার ভাই অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। কারণ তার সবকিছু নতুন করে করতে হয়েছে। যেহেতু আগে তিনি কোনো নতুন পত্রিকা গড়েননি তাই জানতে হয়েছে, বুঝতে হয়েছে, এটি তার জন্যও চ্যালেঞ্জ। বার্তা সম্পাদক থেকে সম্পাদক। ভাল কাগজ হলে নাম, যশ তারই। আর বাবুল সাহেবের একটি কথাই ছিল আমার পত্রিকা হতে হবে একনম্বর। এর জন্য যা প্রয়োজন তিনি দিতে রাজি। তিনিও কথা রেখেছিলেন। সারওয়ার সাহেবও কথা রেখেছিলেন। চাহিদামতো বিনিয়োগ আর টিম নিয়ে সারওয়ার সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রমে যুগান্তর একসময় একনম্বর পত্রিকাই হয়েছিল। পেয়েছিল ভাল বাজার ও জনপ্রিয়তাও। কিন্তু সারওয়ার সাহেব থাকলেন না বা থাকতে পারলেন না। আমি আগেই বলেছি, যুগান্তর বাজারে আসার বেশ আগে থেকেই আমি নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। যা যোগাযোগ হয় বাবুল সাহেবের সঙ্গে। সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে এমনকি সাইফুলের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ ছিল না। অবশ্য এরই মধ্যে তারা জেনে যান, আমি যোগ দেব না। বাবুল সাহেব নিজেই সারওয়ার সাহেবকে জানান। এটিও হয়তো কম যোগাযোগের কারণ। আর তারা ব্যস্তও থাকতেন। আর সারওয়ার সাহেব তো কাজ পাগল লোক। কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসেন।
আমি কিন্তু তখনও সপ্তাহে একদিন বা আরও বেশি সময় বাবুল সাহেবের অফিসে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকি। তার সঙ্গে রাজনীতি, ব্যবসা, অর্থনীতি নিয়ে এবং মাঝে মধ্যে পত্রিকা নিয়েও আলোচনা হতো। তখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমি অফিসের কাজে আরও অনেক ব্যস্ত হয়ে যাই। পরে বাবুল সাহেবের অফিসে যাতায়াতও কমে আসে। তবে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয়। আমি বাবুল সাহেবকে বলেছিলাম, পত্রিকা লাভজনক করতে হলে বেশ বড় অংকের বিনিয়োগ করতে হবে। কত জানতে চেয়েছিলেন তিনি। আমি তাকে একটি অংক এবং সময় সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলাম। সে-সময় এগিয়ে আসার আগেই নির্দিষ্ট অংকের বিনিয়োগ ব্যয় কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে। এমন সময় একদিন ফোন করলেন বাবুল সাহেব, বললেন, কি শাহজাহান ভাই, (তিনি আমাকে এভাবেই সম্বোধন করতেন) আপনার ধারণা দেয়া বিনিয়োগের অংক তো নির্ধারিত সময়ের আগেই শেষ প্রায়। পত্রিকাতো এখনও লোকসান। আমি বললাম, আরেকটু ধৈর্য ধরেন। পত্রিকার কাটতিতো ভাল। আশা করি শিগগিরই সুফল পাবেন। তখন রাজনৈতিক উত্তাপে দেশ কাঁপছে। বাবুল সাহেব সেই উত্তাপের সুযোগ নিলেন। তখন প্রথম দফা আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষদিকে। বাবুল সাহেবের পত্রিকার পলিসি আর সারওয়ার সাহেবের হাতের যশে যুগান্তরের বাজার তুঙ্গে। প্রচারসংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে আর সাথে আয়ও। ঠিকই আমার দেয়া ধারণামতো সময়েই বিনিয়োগের অংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেই যুগান্তর ব্রেক-ইভেনে চলে এলো। এরপর থেকে লাভ। আমার জানামতে অনেক উত্থান-পতনের পর যুগান্তর এখনও লাভে আছে।
যুগান্তর যখন রমরমা চলছে তখনও বাবুল সাহেবের সাথে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। মাঝে মাঝে অফিসেও যেতাম। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি কাজের চাপে দিনে রাতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে তার অফিসে যাওয়া সম্ভব হত না। আর রাজনৈতিক এত উত্তাপ যে, সারাক্ষণ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমাকে দৌড়াতে হতো। তাই ফোনেও যোগাযোগ কমে আসে। পত্রিকা নিয়েও কথা হয় না। তিনিও বলেন না। আমিও জানতে চাই না। প্রায় চার মাস এমন অবস্থা চলে। সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে প্রেসক্লাবে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। কিন্তু তার সঙ্গেও পত্রিকা নিয়ে কথা হয় না। এরই মধ্যে তিনি একজন সফল সম্পাদক হিসাবে প্রতিষ্ঠা পান। অনেকে বলেন, জাদুকরী হাত। আর সাইফুলের সাথে দেখা হলেও যুগান্তর নিয়ে কোনো কথা হয় না। তাই যুগান্তরের সর্বশেষ পরিস্থিতি আমি জানতাম না। প্রচার সংখ্যা ও আয় বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুগান্তরের মালিক আর সম্পাদকরে মধ্যে যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল সঙ্গত কারণেই তাও আমার জানা ছিল না। পরে খোদ বাবুল সাহেবের কাছ থেকেই জেনেছি।
বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com