‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ৬)

0
97

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ৬)

কয়েক সপ্তাহ পর আরেক বিকেল। বাবুল সাহেবের ফোন। আমি অফিসে। এর মধ্যে দু’একবার তার সাথে কথা হয়েছে। তবে নতুন সম্পাদক নিয়োগ নিয়ে তেমন তাড়া ছিল না। তাই ফোন পেয়ে সিরিয়াস কিছু মনে করিনি। তিনি বললেন, এখনই কিছুসময়ের জন্য অফিসে আসেন। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিছুদিন আগে মাত্র আমি ইত্তেফাকে চিফ রিপোর্টারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। বিকালে কপি দেখে ছাড়তে হয়। বের হওয়া কঠিন। বাবুল সাহেবকে বললাম, কাল সকালে আসি। তিনি বললেন, না এখনই। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। এক সহকর্মীকে দায়িত্ব দিয়ে সেনাকল্যাণ ভবনে গেলাম। গিয়ে দেখি যমুনা গ্র“পের এক জিএম একটি টাইপ করা কাগজ পাঠ করছেন। বাবুল সাহেব ও তার একমাত্র ছেলে শামীম ইসলাম মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। আমি ঢুকতেই বাবুল সাহেব বললেন, সারওয়ার সাহেব পদত্যাগ করেছেন। আমার সাথে আলোচনা না করে কিছু না জানিয়ে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। এই পদত্যাগপত্রটি জিএম সাহেব আমাকে শোনানোর জন্য আবার পাঠ শুরু করলেন। আমি শুনলাম। বাবুল সাহেব বললেন, আমি জানতাম তিনি পদত্যাগ করবেন। কিন্তু না জানিয়ে এভাবে করবেন জানা ছিল না। এখন তাড়াতাড়ি সম্পাদক ঠিক করতে হবে। বাবুল সাহেব জানালেন, তার কাছে খবর আছে বিভাগীয় প্রধানদের কেউ কেউ দু’একদিনের মধ্যে পদত্যাগ করবেন।

ইতোমধ্যেই বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধানসহ কয়েকজন পদত্যাগ করেছেন। তার ধারণা মতে, সারওয়ার সাহেব বেশি বেতন দিয়ে অনেককে নিয়ে যাবেন। যাতে যুগান্তর প্রকাশ অসম্ভব হয়ে পড়বে। কেননা সারওয়ার সাহেব এরই মধ্যে অন্য জায়গায় যোগদান করেছেন। তাদেরও নিয়ে যাবেন। সাত দিন থেকে দেড় মাসের মধ্যে এ ঘটনা ঘটতে পারে। কেননা সে-সময়টায় বেতনের বাকি ছিল সাত দিন। আর দেড়মাস পর ঈদ হবে। তাই যারা যাবেন তাদের বেশিরভাগই অপেক্ষা করবেন। তাই তাড়াতাড়ি একজন সম্পাদক নিয়োগ দিতে হবে। এত তাড়াতাড়ি সম্পাদক পাওয়া কীভাবে সম্ভব? আমাদের আলোচনার মধ্যে যুগান্তরের একজন সিনিয়র সাংবাদিক এলেন। তিনি অনেক ঘটনা জানেন। তার কাছ থেকে বাবুল সাহেব অনেক খবর নিলেন। আমি শুনলাম সব। সারওয়ার সাহেব চলে যাওয়ার পর দায়িত্বশীল কেউ দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করছেন। উস্কানি দিচ্ছেন। সারওয়ার সাহেব চলে গেলে যুগান্তর চলবে না এমন গুজবও ছড়াচ্ছেন। সারওয়ার সাহেববের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন। সুযোগ বুঝে পা বাড়াবেন। আবার বাবুল সাহেবকে বোঝাচ্ছেন অন্যভাবে। তার কথা শুনে বাবুল সাহেবও বললেন আমি জানি, তার সম্পর্কে সবই জানি। এরপর ওই সিনিয়র সাংবাদিককে বাবুল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, আতাউস সামাদের সাথে কথা হয়েছে? তিনি জানালেন হয়েছে। তবে ফলাফল ইতিবাচক নয়। আমি বুঝলাম তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সম্পাদক খুঁজছেন। এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, শিগগিরই একটি ব্যবস্থা করতে হবে। আমি বললাম, আপনারাও চেষ্টা করেন আমিও করছি। কিন্তু বাবুল সাহেবের ত্বর সইছে না। একই আলোচনায় সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধানের জন্য অর্থাৎ সহযোগী সম্পাদক পদের জন্য দু’জনের নাম নিয়ে আলোচনা হলো। বাবুল সাহেব এবং ওই সিনিয়র সাংবাদিকের কথা শুনে মনে হলো তারা অনেকদিন ধরেই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদের বিকল্প খুঁজছেন। তাদের মুখ থেকে ওই দু’জনের নাম বের হয়ে আসে। আগেই বলেছি, আবেদ সাহেবের সাথে আলোচনার পর থেকে আমার আর যুগান্তর বিষয়ে তেমন খোঁজখবর ছিল না।

এবার বাবুল সাহেব জানতে চান, সম্পাদকীয় বিভাগের জন্য যে দু’জন নিয়ে তারা আলোচনা করছেন, তাদের সাথে আমার পরিচয় আছে কিনা? আমি বললাম আছে। একজন মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, অন্যজন সোহরাব হাসান। দু’জনই তখন সংবাদে। মঞ্জু সাহেব প্রথম আলো ছেড়ে মাত্র সংবাদে গেছেন। আর সোহরাব হাসান অনেকদিন ধরেই আছেন। আমি বললাম, তাদের সাথে কথা বলব? দু’জনের একজনকে আনা যাবে। সম্পাদকীয় বিভাগীয় প্রধান পদত্যাগের কারণে এ পদে নিয়োগ জরুরি। আমি বললাম, সমস্যা হবে না, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একই সঙ্গে বললাম, সম্পাদক নিয়েও আরো চিন্তা করি। কাকে আনা যায়। কে রাজি হন। কাল আবার আসব বলে বিদায় নিয়ে অফিসে এসে কাজ করে বাসায় ফিরি বেশ রাতে। মাথায় তখন যুগান্তরের সম্পাদক কে হলে ভাল হয় এ চিন্তা। আবার সারওয়ার সাহেব যে স্থান থেকে চলে গেছেন সেখানে সিনিয়র কেউ আসতে চাইবেন কিনা ইত্যাদি।

অফিসে ফিরে হাতের কাজ শেষ করে সহযোগী সম্পাদক পদের জন্য প্রস্তাব করা মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জুকে ফোন করি। মঞ্জু সাহেব স্বল্পভাষী। মতি ভাইয়ের সঙ্গে (প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান) সাপ্তাহিক একতায় কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। প্রথম আলোতেও ছিলেন মঞ্জু সাহেব। আমিও একসময় একতায় লিখতাম। মতিউর রহমান সাহেব তখন সাপ্তাহিক একতার সম্পাদক ছিলেন। সেই সুবাধে ভালই জানাশোনা। শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর মূলকথা। ঠিক হলো পরদিন সকালে তার বাসায় বসব। রাতে আর যুগান্তর বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। সকালে সময়মতো আমি মঞ্জু সাহেবের বাসায় গিয়ে পৌঁছি। কথা হয়। তিনি তখন যেকোনো কারণে প্রথম আলো থেকে চাকরি ছেড়ে দৈনিক সংবাদে যোগদান করেছেন। আমার প্রস্তাবের পর বিনয়ের সঙ্গে বললেন, নতুন যোগ দেয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই অন্য কাগজে যাওয়া ঠিক হবে না। কাকে সম্পাদক করা যায় এ নিয়েও তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি।

হঠাৎ তিনি মূসা সাহেবের নাম বললেন। এবিএম মূসা, কিংবদন্তী সাংবাদিক। বাংলাদেশ অবজারভারের বার্তা সম্পাদক, সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক ও এমডি, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, কিছুদিন ডেইলি নিউজে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। বিদেশি সংস্থায়ও কাজ করেছেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে এমপিও নির্বাচিত হন। মূসা সাহেব তখন কোনো চাকরি করতেন না, নিয়মিত কলাম লিখতেন, প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের একজন। তার নাম শুনে আমি বেশ পুলকিত। কেননা আমার সঙ্গে তার খুবই সুসম্পর্ক ছিল। ভাল কোনো রিপোর্ট ছাপা হলে টেলিফোন করে ধন্যবাদ জানাতেন, মাঝে-মধ্যেই কথা বলতেন। দেশের বিভিন্ন খবরাখবর জানতে চাইতেন। আর প্রেসক্লাবেও নিয়মিত দেখা হতো। মঞ্জু সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে সোজা বাবুল সাহেবের অফিসে গেলাম। তার কাছে মূসা সাহেবের নাম বললাম। তিনি মূসা ভাইয়ের নাম শুনেছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না। আমি বিস্তারিত বললাম। তিনি রাজি হলেন। এর আগে দুজন রাজনীতিবিদের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের একজন বর্তমানে মন্ত্রী। অন্যজন এরশাদ জামানায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, মারা গেছেন। এখন প্রশ্ন, মূসা সাহেব এ বয়সে আবার চাকরিতে ফিরবেন কি-না, চাইবেন কি-না সম্পাদক হতে। বাবুল সাহেব বললেন, কথা বলে দেখেন। রাতে অফিসের কাজ শেষ করে গাড়িতে উঠেই মূসা সাহেবকে ফোন দেই। তিনি ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, কী সরদার, কেন ফোন করেছ? তিনি আমাকে সবসময় ‘সরদার’ নামেই ডাকতেন। আমি বললাম, কাল সকালে আপনার বাসায় আসতে চাই। কথা আছে। বললেন, সাড়ে ৯টার মধ্যে আস। এটুকুই কথা। সেদিন অফিস থেকে বাসায় না গিয়ে আমি সোজা গুলশান গেলাম। এক ব্যবসায়ী বড় ভাইয়ের বাসায়। তিনিও মূসা সাহেবের এলাকার লোক। বড় ব্যবসায়ী। একসময় তার সঙ্গে আমি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শেয়ার করতাম। ঘটনাটি তাকে জানালাম। তিনিও বললেন, মূসা সাহেব রাজি হলে ভাল হবে।

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here