‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১৪)

0
109

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ১৪)

পরদিন গেলাম। তিনি আমাকে লিফটের কাছ থেকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। বসালেন, কফি খাওয়ালেন। অফিস দেখাতে নিয়ে গেলেন। পরে জানতে চাইলেন, আমি আসব কিনা। আমি বললাম ঠিক আছে। কতদিনের মধ্যে কাগজ বের করতে চান। নাম, ডিক্লারেশন ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা হলো। বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশ প্রতিদিনে যা পাই বললাম। মোটামুটি কথা হলো ল্যাবএইডের সঙ্গে একটি নতুন পত্রিকা বের করব। তিনি জানালেন, আমার নিয়োগপত্রের একটি খসড়া আজই তিনি মেইলে পাঠিয়ে দিবেন, আমি দেখে যেন তাকে জানাই। আমি চলে গেলাম অফিসে। সন্ধ্যায় মেইলে ঠিকই নিয়োগপত্রের একটি খসড়া পাই। তাতে সবই ঠিক আছে। কিন্তু বেতন-ভাতা বৃদ্ধি নেই। প্রতিদিনে যা ছিল তাই। তিনি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন বেতন-ভাতা কত? আমি প্রতিদিনে যা পাই তাই বলেছিলাম। বেশি দিতে হবে তা বলিনি। তিনিও জানতে চাননি বেশি চাই কিনা। আমি এতে কিছু মনে করিনি। ঠিক আছে। শুরু করি। দেখি না, ভাল কিছু করা যায় কিনা। আর তিনিতো বলছেন, এ পত্রিকাটি দু’জনের অংশীদারিত্বের মতো থাকবে। আমার নিজের কাগজ ভাবতে হবে। চাকরি যেন না ভাবি। তিনি মেইল পাঠিয়ে কিছুক্ষণ পরে ফোন করেন। আমি বলি দেখে পরে জানাব। রাতে আর কথা বলিনি। পরদিন ফোন করে জানালাম, ঠিক আছে। নিয়োগপত্র তৈরি করেন। আমি পরদিন এসে নিয়ে যাব। ঠিকই পরদিন নিয়োগপত্র গ্রহণ করলাম। এতে লেখা আছে যোগদানের তারিখ থেকে কার্যকর। কাজেই তাড়াহুড়া নেই। তিনি জানতে চাইলেন, কবে নাগাদ যোগদান করতে পারব। বললাম, আমি একটি পত্রিকার সম্পাদক। এ পত্রিকাটি আমি নিজ হাতে রাস্তায় নেমে বিক্রি করেছি। বাজারজাতের প্রথম দিন আমি আর নঈম নিজাম দু’জন ভোররাত থেকে সকাল পর্যন্ত পত্রিকা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছেছে কিনা ঘুরে ঘুরে দেখেছি। ঢাকাশহরের প্রতিটি বিক্রয়কেন্দ্রে ঘুরেছি। তাই হুট করে আসা যাবে না। সবাইকে বলে সম্মানজনকভাবে আসতে হবে। সময় দিতে হবে তাদেরও। আর আমি যখন নিয়োগপত্র গ্রহণ করেছি আর আপনি যখন বলেছেন, শাহ আলম সাহেব সব খবর রাখেন, আপনাকে ফোন করেছিলেন, তাহলে আসতে কোন সমস্যা হবে মনে হয় না। তবুও পদত্যাগের আগে শাহ আলম সাহেবকে জানাতে হবে। দু’একদিনের মধ্যেই তার সাথে কথা বলব। শামীম সাহেব যথারীতি আমাকে লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। এ ব্যাপারে সবসময়ই তিনি অগ্রণী। যতবার তার অফিসে গিয়েছি বিদায়ের সময় সবসময়ই লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেছেন।

ল্যাবএইড থেকে বেরিয়ে গেলাম বসুন্ধরায় বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে। এদিন কাউকে আর কিছু বললাম না। নিয়োগপত্র পকেটে। কাজ শেষ করে সময়মতো বাসায় ফিরি। বাসায়ও কাউকে কিছু বলিনি। ল্যাবএইডে যাওয়া-আসা আলোচনা কোন কিছুই জানাইনি। এভাবেই কেটে গেল রাতটি। নানা ধরনের চিন্তা-ভাবনা। কী করতে যাচ্ছি আমি, নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। যেন একধরনের মোহের মধ্যে পড়ে গেছি। পরদিন অফিসে গিয়ে যথারীতি সকালের সব বৈঠক করে ফোন করলাম শাহ আলম সাহেবকে। বললাম, আমি দেখা করতে চাই। তিনি দুপুরের পর তার অফিসে যেতে বললেন। কথামতো তিনটার দিকে তার অফিসে হাজির হলাম। তিনি একাই ছিলেন। সাধারণত আমি যখনই গুরুত্বপূর্ণ কোন বিষয়ের কথা বলেছি তখন তিনি একাই কথা বলতেন। আমি রুমে ঢুকতেই চা-নাস্তা এলো। পত্রিকা নিয়ে কথা হতে থাকলো। আমি জানালাম সব ভাল চলছে। আগের মতো কথাবার্তা। তিনি স্বাভাবিক, আমি অস্বাভাবিক। কেননা শামীম সাহেব যে কথা বলেছিলেন তার মধ্যে এমন কোন আভাস লক্ষ করছি না। তিনি পত্রিকার কথাই বলছেন। প্রায় আধঘণ্টা এভাবে কথা বলার পর আমি পদত্যাগেরর বিষয়টি এভাবে তুললাম : শাহ আলম ভাই বাংলাদেশ প্রতিদিন তো এখন ভাল চলছে, লোকসানেও নেই বরং লাভে আছে। আমি এখন বিদায় নিতে চাই। একটি ফোন আসার কারণে তিনি কথার শেষ অংশটি বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন বলে মনে হলো না। ফোন রাখার পর আমি আবার বললাম, ভাই আমি প্রতিদিন থেকে বিদায় নিতে চাই। তিনি বলে উঠলেন, মানে? এরপর চুপ করে রইলেন। আমিও চুপ। প্রায় তিন-চার মিনিট পর বললেন, কেন? জবাবে আমি বললাম আমার বাসা থেকে অফিস অনেক দূর। ট্রাফিক জ্যাম এতো বেশি যে আসতে আড়াই-তিনঘণ্টা, যেতে দুই ঘণ্টা। অর্ধেক সময় রাস্তায়ই পার হয়ে যায়। তিনি বললেন, বসুন্ধরায় এসে যান। অ্যাপার্টমেন্ট রেডি আছে। এখানে থাকেন। আমি বললাম, ছোট ছেলে মেডিকেলে পড়ছে। তার কলেজ এখান থেকে অনেক দূর হবে। এরপর তিনি জানতে চাইলেন, অন্য কোথাও কাজ ঠিক করেছেন। আমি বললাম, হ্যাঁ। কোথায় জানালাম। তিনি বললেন, আপনি ভুল করছেন। নিজের গড়া কাগজ রেখে কেউ চলে যায়? যাবেন না আরও চিন্তা করেন। চিন্তা-ভাবনা করে আসেন। চাকরি ছাড়ার বিষয়ে আমার বক্তব্যে তিনি খুবই আশ্চর্য হলেন মনে হলো। তার বক্তব্যে স্পষ্ট মনে হয়েছে, এ-ব্যাপারে কিছু তিনি জানতেন না। শামীম সাহেবের সাথে কথা হয়েছে, এ-কথা কোনভাবেই আমার সত্য মনে হয়নি। বিদায় নেয়ার আগে শাহ আলম সাহেব বিষয়টি কাউকে না জানানোর জন্য বলেন। শাহ আলম সাহেবের অফিস থেকে বের হতেই শামীম সাহেবের ফোন। তিনি জানতেন, আমি আজ পদত্যাগ করব। তাকে বললাম ঘটনা। এও জানতে চাইলাম আসলেই কি আপনাকে শাহ আলম সাহেব আমার বিষয়ে কোন কথা জানতে চেয়েছিলেন? তিনি জোর দিয়ে বললেন, আমি কি আপনার সাথে অসত্য বলছি? আমি অফিসে কাউকে কিছু বললাম না। শাহ আলম সাহেব তার পরিবারের মধ্যে আলোচনা করে থাকতে পারেন। কিন্তু অফিসে তিনিও কাউকে কিছু বলেননি। আমি যথারীতি কাজ করছি। শামীম সাহেব ফোনের পর ফোন। জানতে চান কবে পদত্যাগ করছি। এভাবে পক্ষকাল চলে গেল। আবার শাহ আলম সাহেবের কাছে গেলাম। এবার পদত্যাগপত্র নিয়ে গিয়ে একই কথা বললাম। তিনি আগের মতই বললেন ভুল করছেন। আরও ভাবেন। আমি বললাম, না শাহ আলম ভাই। আপনি আমাকে বিদায় দেন। তিনি এবার বললেন, পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিয়ে যান। আপনি আরও ভাবেন, আমিও ভাবি। কিছুদিন কাজ করেন। যদি নাই থাকতে চান আমি আপনাকে বলব কিছুদিন সময় নিন। পরে পদত্যাগ করেন। আরেকটা কথা তিনি বললেন, যেখানেই যান প্রতিদিন থেকে কাউকে না নিলে আমি খুশি হব। এদিন অফিসে এসে আমি তখনকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বর্তমান সম্পাদক নঈম নিজামকে পদত্যাগের বিষয়টি বলি। শাহ আলম সাহেবের সাথে আলোচনার কথাও জানাই। পদত্যাগ করতে চাই শুনে তিনিও আশ্চর্য হলেন। নঈম আমার স্নেহভাজন। অনেক আগে থেকে দুজনের সখ্য। একসাথে আড্ডা। দু’জন যখন বেকার ছিলাম তখনও আড্ডা দিতাম। তিনি শুনে বললেন, ‘আপনি কেন পদত্যাগ করবেন?’ কেন যাবেন? পত্রিকা এখন ভাল চলছে। তাই কেন পদত্যাগ করবেন। তাকে বললাম আগে যদি আমি চলে যেতাম, পত্রিকার লোকসানের সময় যদি চলে যেতাম তাহলে অনেকে এমনকি মালিকরাও অনেক কথা বলার সুযোগ পেত। পত্রিকার এখন ভাল একটি সময়ে যাচ্ছে। তাই কারো কিছু বলার থাকবে না। আর তুমি তো জানো আমার লোভ-লালসা কম। ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ, সংসার খরচ চললেই আমার হয়। সহায়-সম্পদের লোভ থাকলে অনেক আগেই করতে পারতাম। সেদিন শাহ আলম সাহেব জানতে চেয়েছিলেন, আমি যদি চলে যাই তাহলে সম্পাদক কাকে করা যায়। আমি বলেছিলাম বাইরের কাউকে আনা দরকার নেই। নঈম নিজামকেই করেন। আমার প্রস্তাবে তিনি কোন কথা বলেননি। আমি নঈমকে তাও জানালাম। তবে নঈম সেদিন একটি সত্য কথা বলেছিল। অর্থাৎ খারাপ সময় গেলেন না, এখন কেন? বাংলাদেশ প্রতিদিন প্রকাশের ছয় মাসের মাথায় আমার খারাপ সময় কেটেছে। বসুন্ধরা গ্র“পের মিডিয়ার দায়িত্বে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা আমাকে একটি চিঠি দিয়েছিলেন নানা বিষয়ের উল্লেখ করে। পরে শুনেছি এটা মালিকদের পক্ষ থেকে আসেনি। অনেকটা তার ব্যক্তিগত। তিনি তখন পত্রিকার খবরদারি করতে চাইতেন, আমি পাত্তা দেইনি। আমি বিষয়টি নিয়ে কড়া প্রতিবাদ এবং তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আরেকটি চিঠি পাঠাই। মালিকদেরও বিষয়টি জানাই। এর পর থেকে সেই কর্মকর্তা চুপ হয়ে যান। খবরদারি এমনকি তার অফিসে আসাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে এটা আমি নিশ্চিত ছিলাম ওই কর্মকর্তা কারো-কারো ইন্ধনেই ঘটনাটি ঘটিয়েছিলেন। কেননা আমি কে, কী আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ইত্যাদি তার অজানা ছিল না।যাহোক এদিন থেকেই মোটামুটি আমার বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে বিদায় নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে বিষয়টি মালিকপক্ষ, আমি এবং নঈম ছাড়া দু’একজন জানতে পারেন। আমি স্বাভাবিকভাবেই সব কাজকর্ম করছি। অপেক্ষায় আছি শাহ আলম সাহেব কখন ডাকেন। ওদিক শামীম সাহেব ফোনের পর ফোন। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই শাহ আলম সাহেব ফোন করে তার অফিসে যেতে বললেন। আমি পদত্যাগপত্র ড্রয়ার থেকে বের করে নঈমকে নিয়ে যাই। গিয়ে দেখি শাহ আলম সাহেবের সামনে বসা বসুন্ধরা গ্র“পের এমডি সায়েম সোবহান (আনভীর) সাহেব এবং উপদেষ্টা তৈয়ব সাহেব। আমি আর নঈমও গিয়ে বসি। শাহ আলম সাহেব, জানতে চাইলেন, আপনার সিদ্ধান্ত কি চূড়ান্ত। বললাম, হ্যাঁ। আনভীর সাহেব বলেন, আপনি কি পাগল। এতবড় পত্রিকা। নিজে কষ্ট করেছেন। আমরাও চেষ্টা করছি। অথচ এখন চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। আমি তার কথার কোন জবাব দেইনি বা দিতে পারি না। কেননা তিনি অত্যন্ত সোজাসুজি কথা বলেন। কাজে-কর্মে খুবই গতিশীল। প্রতিদিনে কাজ করার সময় তিনি আমাকে যেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখেছেন তেমনি সময়ে অসময়ে তাকেও আমি কাছে পেয়েছি। তিনি বললেন, চলে যাবেন, তবে যোগাযোগ রাখবেন। আমি পদত্যাগপত্রটি বের করে শাহ আলম সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। দুই কপি পদত্যাগপত্র। শাহ আলম সাহেব তৈয়ব সাহেবকে দিতে বললেন। বললাম, শাহ আলম ভাই, আপনি নিজে আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করলে আমি খুশি হব। আমার মঙ্গল হবে। তিনি বললেন, আপনার মঙ্গল হবে কিন্তু আমার তো অমঙ্গল হতে পারে। অবশেষে তৈয়ব সাহেবই পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন। এক কপি গ্রহণ করে তার স্বাক্ষরসহ আমাকে দিলেন। সেদিন ছিলো ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর। আর তখন থেকেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো। শাহ আলম সাহেব বললেন, আপনি এভাবে যাবেন না। বিদায় সম্বর্ধনা দেয়া হবে। আমিও থাকব। তৈয়ব সাহেবকে বললেন, দু’দিন পর সংবর্ধনার আয়োজন করতে। ইস্টওয়েস্ট মিডিয়ার অর্থাৎ কালের কণ্ঠ, সান, বাংলাদেশ প্রতিদিন, বাংলা নিউজ সকলকে সংবর্ধনার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য বলেন। এ পর্যন্ত কথা শেষ করে আমি অফিসে গেলাম। নঈম একটু পরে এলো। এর মধ্যে অফিসে সব জানাজানি হয়ে গেছে। নঈম অফিসে ফিরে পর আমি কিছুক্ষণ অবস্থান করে উপস্থিত সবার সাথে কথা বলে প্রতিদিন থেকে বের হয়ে সোজা ল্যাবএইডে যাই। শামীম সাহেব অপেক্ষা করছিলেন। তার সঙ্গে কথা বলে অন্যদিনের চাইতে আগে বাসায় ফিরি। আমি সচরাচর ১১টার আগে বাসায় ফিরি না। এদিন তাড়াতাড়ি ফেরার কারণে স্ত্রী জানতে চায় শরীর অসুস্থ কি না? বললাম না, তার কাছে ঘটনা খুলে বললাম। তিনি খুবই আশ্চর্য, মর্মাহত হলেন। বড় দু’ছেলে আমেরিকায়। ছোট ছেলেকে ডেকে আনলেন। জানালেন আমার কথা। বললেন, আবার পাগলামি? কারণ আমি যখন যুগান্তর ছেড়ে আসি তখন ছোট ছেলে নটরডেম কলেজে সবে ভর্তি হয়। দীর্ঘদিন বেকারত্বের কারণে তার লেখাপড়া এবং সংসারের ব্যয়ভার বহনে অনেক সমস্যা হয়েছিল। কষ্ট করতে হয় সবাইকে। আর এখন সে এমবিবিএস-এর ছাত্র। যদি ল্যাবএইডে কোন সমস্যা হয় তখন আবার সেই কষ্ট, দুর্ভোগ। বাংলাদেশ প্রতিদিনে থাকাকালে আমার স্ত্রী, ছোট ছেলে আর আমেরিকা থেকে আসা মেজো ছেলে এক অনুষ্ঠানের দিন অফিসে গিয়েছিলো। তখন বলেছিল কোন সময় চাকরিতে কোন সমস্যা হলে তাদের যেন বলি। হুট করে যেন না ছাড়ি। কিন্তু চাকরি ছাড়ার আগে কিছু না জানানোর কারণে দু’জনই ভীষণ ক্ষুব্ধ। আমি অসহায়ের মত। তারা কিছুতেই ল্যাবএইডকে বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু যা হবার তা হয়ে গেছে। তাদের শান্ত করে একসঙ্গে নৈশভোজ সেরে দুটি ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো না। পরদিন সকালে উঠে দেখি অনেক পত্রিকায় আমার পদত্যাগের খবর। মিড়িয়াপাড়ায় হৈ-চৈ। চারদিক থেকে ফোনের পর ফোন। কেন চলে আসছি? সমস্যা কী ছিল ইত্যাদি। আমি সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করি স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে এসেছি। মালিকদের সঙ্গে কোন সমস্যা ছিল না। এখনও নেই। যারা আমার সুহৃদ এদের কেউ বিষয়টি ভালভাবে নেননি। আমার মাথায় তখন নতুন চিন্তা। নতুন ধারণা। আরেকটি নতুন কাগজ বের করব। ভাল কাগজ। এমন ধারণা নিয়ে সকালেই ল্যাবএইডে গেলে শামীম সাহেবের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলাম। তিনি নিয়ে গেলেন নতুন প্রস্তাবিত অফিসে। ছোটখাটো একটি রুম রেডি করা ছিল। আমাকে সেখানে বসানো হল।

২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিন অফিসে সংবর্ধনা। যথাসময়ে গেলাম। লিফটে উঠে সোজা আমার আগের রুমে গিয়ে পা দিলাম। একদিনের ব্যবধানে কিন্তু সেটি আমার রুম আর ছিল না। আমি তো পদত্যাগ করে আসছি। তাই গিয়ে দেখি অনেক বদল। নিজের প্রতিষ্ঠানে নিজেকে অচেনা মনে হলো। আমি আমার আগের চেয়ারে না বসে সামনের একটি চেয়ারে বসলাম। অন্যরাও আমার সাথেই বসল। এখান থেকেই বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্মেলন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাংবাদিক কর্মচারী এবং ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়ার কয়েক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের পক্ষ থেকে কয়েকজন বক্তব্য দিলেন। ফুল ও উপহার দিয়ে বিদায় সংবর্ধনা জানালেন। এবার আমার পালা। আমি বক্তব্য রাখলাম। বাংলাদেশ প্রতিদিন কীভাবে প্রকাশ হল, আমি কীভাবে সম্পৃক্ত হলাম সংক্ষেপে সেই কাহিনী বর্ণনা করলাম। অনেকেই এসব কাহিনী জানতেন না। জানার জন্যই বলা। অনেক সহকর্মীর চোখে সেদিন পানি দেখেছি। আমি তাদের বলেছি, আপনারা প্রতিষ্ঠিত কাগজে আছেন। বড় গ্র“পের কাগজ। আপনাদের কোন সমস্যা হবে না। আল্লাহ ভাল রাখবেন। আমি বরং অজানা গন্তব্যে পা দিয়েছি। অনিশ্চিত ভবিষ্যত। আমার জন্য দোয়া করবেন। এই বলে গাড়িতে উঠে চলে আসি। উল্লেখ্য, যেদিন পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছিল সেদিনই আমি অফিসের গাড়ি ছেড়ে দিই। সংবর্ধনার দিনে আমার ব্যক্তিগত গাড়িতেই গিয়েছিলাম। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। বসুন্ধরা থেকে আমাকে যে ড্রাইভার দেয়া হয়েছিল তিনি বেশ বয়স্ক। নাম আব্দুর রব। খুবই ভদ্র, বিনয়ী মানুষ। নিয়মিত নামাজ-রোজা করেন। অনেক বছর বসুন্ধরা গ্র“পের ড্রাইভার। তার কোন বিষয়ে লোভ-লালসা নেই। বিপদ-আপদ সব কিছুতেই শোকর করেছেন। আমি যখন পদত্যাগ করি তখন তিনি হজে ছিলেন। বসুন্ধরা গ্র“প থেকে প্রতি বছর শতাধিক লোককে হজে পাঠানো হয়। তার মধ্যে গ্র“পের গরিব কর্মচারীদেরও পাঠানো হয়। এজন্য গ্র“পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রধানদের কাছ থেকে নেয়া হয় তালিকা। আমি বাংলাদেশ প্রতিদিন থেকে দু’জনের তালিকা দিয়েছিলাম। একজন প্র“ফ সেকশনের। তিনি প্রতিদিনের অফিসে নামাজের জামাতে ইমামতি করেন। আরেকজন ড্রাইভার রব মিয়া। তিনি আগেই দরখাস্ত জমা দিয়ে রেখেছিলেন। তাই আমাকে অনুরোধ করতে বলেন। আমি কর্তৃপক্ষকে জানালে তাকে পাঠানো হয়। রব মিয়া হজ থেকে এসে আমার পদত্যাগের কথা শুনে বাসায় দৌড়ে আসেন। আমি তখন বাসায় ছিলাম না। আমার স্ত্রী বলেছে আমার জন্য আনা জায়নামাজ হাতে নিয়ে রব মিয়া শিশুর মতো কেঁদেছে। বারবার বলেছে, স্যার আমাকে হজে পাঠায় দিয়া চাকরি ছাইড়া দিছে। স্যার কাজটা ভাল করে নাই। আমি থাকলে পদত্যাগ করতে দিতাম না। এই রব মিয়া এখনও বাংলাদেশ প্রতিদিনের গাড়ি চালান। মাঝেমধ্যে যোগাযোগ হয়। কোন বিষয়ে তার কোন অনুযোগ নেই।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here