‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ২১)

0
121

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ২১)

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

সাক্ষাৎকারে প্রেসিডেন্ট এবং পরবর্তী ভূমিকা

রাজনৈতিক সংকট ক্রমেই গুরুতর আকার ধারণ করায় বিরোধীদলের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) শেখ হাসিনা বারবার রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানান। ৫ জানুয়ারি ’৯৫ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা আমির হোসেন আমু (বর্তমান শিল্পমন্ত্রী), তোফায়েল আহমদ (বর্তমান বাণিজ্যমন্ত্রী) ও মোহাম্মদ নাসিম (বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী) বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেডিডেন্টকে সংকট নিরসনে উদ্যোগী হওয়ার জন্য বলেন। তখনও প্রেসিডেন্টের কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় ছিল না। এ অবস্থায় আমি মনে মনে স্থির করি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবো। কিন্তু কীভাবে সম্ভব? প্রেসিডেন্ট এ পর্যন্ত কোন সংবাদপত্র বা সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেননি। আমাকে কি দেবেন? মাথার মধ্যে বেশ কিছুদিন এ বিষয়টি ঘুরপাক খেতে থাকে। বিরোধীদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য খুবই জরুরি। মাথায় এলো ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেননের কথা। তার সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের সম্পর্ক আত্মীয়তার। অফিসে বসেই ভাবছিলাম, এমন সময় ওয়ার্কার্স পার্টির তরুণ নেতা নূরুল ইসলাম ছোটন ইত্তেফাকে আসেন (পরে তিনি বিএনপির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন)। তাকে আমার সামনে বসতে দিয়ে কথাটা বলি। ছোটন আমার বক্তব্য খুবই সময়োপযোগী আখ্যা দিয়ে জানাল, মেনন ভাইয়ের (রাশেদ খান মেনন, বর্তমানে বেসমরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রী) সঙ্গে তার রাতে দেখা হবে। রাতেই এ বিষয়ে কথা বলবেন। পরদিন ছোটন টেলিফোন করে মেনন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে সাক্ষাৎকার গ্রহণে তার সাহায্য চাইলেন। মেনন সাহেব জানালেন, তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলবেন এবং আমাকে জানাবেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই মেনন সাহেবের বাসায় টেলিফোন করি। তিনি জানালেন, প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। সময়ও দিয়েছেন। তারিখটা ছিলো ১৯৯৬ সালের ৯ জানুয়ারি। মাত্র একঘণ্টা সময় পাওয়া যাবে। মেনন সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি কৃতজ্ঞ। ৮ জানুয়ারি রাতে প্রেসিডেন্টের প্রেস সেক্রেটারি সোবহান সাহেবকে টেলিফোন করে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বললে তিনি কিছু জানেন না বলে উত্তর দিলেন। আমি হতাশ হলাম। কিন্তু সময়টা যেহেতু রাশেদ খান মেনন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারণ করেছেন তাই প্রেস সেক্রেটারি নাও জানতে পারেন। আমি সোবহান সাহেবকে বললাম, আপনি মেনন ভাইয়ের নাম করে প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করুন। আমি আবার যোগাযোগ করব। তিনি জানালেন, সকালে অফিসে গিয়ে তিনি খোঁজ নেবেন।

৯ জানুয়ারি, ৯৬ সকাল ৯টা। হরতালের দিন। ঘুম থেকে উঠে আমি বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। প্রেসক্লাব হয়ে বঙ্গভবনে যাবো। এমন সময় আমার টেলিফোন বেজে উঠলো। বঙ্গভবন থেকে সোবহান সাহেব। তিনি জানালেন, সাক্ষাৎকারের সময় ঠিক আছে। তুমি সময়মতো এসো। আর প্রেসিডেন্ট চান তোমাদের বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সাহেবও আসুন। আমি তাকেও ফোন করে দিয়েছি। প্রেসিডেন্টের সাক্ষৎকার নেয়ার জন্য আমি চেষ্টা করছি, সারওয়ার ভাইকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। অবশ্য সময় সম্পর্কে কিছু বলিনি। কারন সাক্ষাৎকার গ্রহণের পর বলবো। এসব কারণে সম্পাদককেও বলিনি। কেননা একবার কনফার্ম করে পরে ব্যর্থ হওয়ার গ্লানি অনেক বেশি। না পারলে ব্যর্থতার গ্লানি নিজের কাছেই থাকুক। অন্য কেউ জানলো না। সোবহান সাহেব ফোন রাখার পরই সারওয়ার ভাই টেলিফোন করলেন। আমি তাকে সব খুলে বললাম। তিনিও বললেন, বঙ্গভবন থেকে তাকে টেলিফোন করেছে। ঠিক হলো দু’জন একসঙ্গে যাবো। হরতালের মধ্যে সংবাদপত্রের ব্যানার লাগানো বেবি ট্যাক্সিতে নির্ধারিত সময়ের ১১ মিনিট আগেই আমরা বঙ্গভবনে গিয়ে পৌঁছলাম। দোতলায় সোবহান সাহেবের রুমে আধঘণ্টা অপেক্ষার পর প্রেসিডেন্টের রুমে ডাক পড়ে। তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। প্রেসিডেন্ট ও সারওয়ার সাহেব দু’জনই বরিশালের লোক। তাদের জানাশোনা, সম্পর্ক রয়েছে। কুশল বিনিময়ের পর সাক্ষাৎকার পর্ব শুরু হলো। দু’জনই প্রশ্ন শুরু করলাম। আমি লিখছিলাম। সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং আলাপচারিতায় তিন ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। প্রেসিডেন্ট সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা পরিষদ গঠন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের মতামত নেয়া একান্ত প্রয়োজন।’ আরো বলেন, শিগগিরই তিনি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করবেন। আলাপচারিতায় প্রেসিডেন্ট বারবার একটি কথা বললেন বেশ জোর দিয়ে, ‘আমি সারাজীবন একজন সক্রিয় মানুষ। আমি কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার কোন কাজ নেই।’ তার আলাপে আন্তরিকতার ছাপ যেমন পাই তেমন একটি চাপা ক্ষোভ, উত্তেজনার গন্ধও পাই। একপর্যায়ে তিনি বলে ওঠেন, ও যধাব ধ ভষধসব রহ সু সরহফ. এ কথা বলতে তিনি কী বুঝিয়েছিলেন তা আমি তখন বুঝতে পারিনি। পরে বুঝেছিলাম তার মনের মধ্যে আগুন ছিল। সাক্ষাৎকার শেষে বেবি ট্যাক্সিতে প্রেসক্লাবে সারওয়ার সাহেবকে নামিয়ে আমি সোজা বাসায় চলে যাই। সন্ধ্যার আগেই অফিসে পৌঁছে প্রথমেই সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসায় টেলিফোন করে জানলাম দুপুরে তিনি সিঙ্গাপুর চলে গেছেন। আগের দিন কথা না হওয়ায় আমি তার বিদেশ যাওয়া সম্পর্কে জানতে পারিনি। কিন্তু এতবড় ঘটনা তাকে জানানো উচিত। তাই আমি জানতে চাইলাম তিনি সিঙ্গাপুরে গিয়ে পৌঁছেছেন কিনা। বাসা থেকে জবাব এলো পৌঁছাতে বেশ রাত হবে। সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ হলো না। পরদিন ইত্তেফাকে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার সবিস্তারে ছাপা হলো। এ সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে টেলিফোনে অভিনন্দন পেলাম। অগ্রজ ও অনুজ সাংবাদিকরাও অভিনন্দন জানালো। তথ্যমন্ত্রী নাজমুল হুদার সাক্ষাৎকার ছাপা না হওয়ায় মনে যে চাপা দুঃখ পুঞ্জীভূত ছিল তা প্রশমিত হলো অনেকটা। একদিন পর সম্পাদক সাহেব সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসে টেলিফোনে প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গটি জানতে চাইলেন। তাকে বিস্তারিত জানালাম। অনেক প্রচেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি তাও বললাম। তিনি যে বাইরে যাচ্ছেন তা আমি জানতাম না, একথাও বললাম।

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং অন্যান্য প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাসের ইত্তেফাকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারই প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম এবং শেষ সাক্ষাৎকার। এই বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বৈঠক ডাকবেন। তদনুযায়ী তিনি শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়াসহ, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ সব দলকেই আনুষ্ঠানিক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। হরতালের মধ্যে রিকশায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ধানমন্ডি থেকে বিরাট মিছিল নিয়ে বঙ্গভবনে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু সত্য বটে, বিরোধীদের কোন দাবিই প্রেসিডেন্টের কাছে গ্রাহ্য হয়নি। বিরোধীদলের মূল দাবি এবং ইত্তেফাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ প্রসঙ্গে প্রতিশ্র“তি দিলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিষয়টি তিনি সুপ্রিম কোর্টের মতামতের জন্য রেফারেন্স হিসেবেও পাঠাননি। এরই মধ্যেই বিরোধীদলের আহূত অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। অসহযোগের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট ১৯ মার্চ জাতীয় সংসদের বৈঠক আহ্বান করেন।নিনিয়ানের সাক্ষাৎকার

১৯৯৫ সালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত তখন কনমওয়েলথের তৎকালীন মহাসচিব অ্যামেকা অ্যানিকুর প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার সাবেক গর্ভনর সার নিনিয়ান স্টিফেন ঢাকায় আসেন। উদ্দেশ্য বিবদমান দুই রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা করা। একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। ১৯৯৫ সালে দীর্ঘ ৩৯ দিন তিনি ঢাকায় অবস্থান করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সাথে পৃথক পৃথক আলোচনা করেন। আবার দুই জোটের নেতৃবৃন্দকে এক টেবিলে আলোচনার জন্য বসান। কিন্তু তার এই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। নিনিয়ান ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায় অবস্থান করতেন। তিনি যতদিন ছিলেন প্রতিদিনই রিপোর্টারদের মেঘনায় যেতে হতো। মেঘনায় বৈঠকের পর বৈঠক অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু নিনিয়ান কোন সাংবাদিকের সঙ্গেই কথা বলতেন না। সরকার ও বিরোধী নেতৃবৃন্দ কখনও পৃথক ভাবে কখনও একসঙ্গে বৈঠক করতেন। বৈঠক শেষে তারা দ্রুত চলে যেতেন। অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের কেউ কিছু বলতে নারাজ। এমনও হয়েছে নেতারা ঢুকেছেন মেঘনার গেইট দিয়ে, নিনিয়ানের সঙ্গে আলোচনা শেষে বের হয়ে গেছেন সংলগ্ন পদ্মার গেইট দিয়ে। ফাঁকি দিয়েছেন সাংবাদিকদের। কিন্তু এতে একদিনের জন্যেও মেঘনার গেইটে সাংবাদিকদের ভিড় কমেনি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পর কোনদিন রাত ১২টারও পর একলাইনের বিফ্রিং নিয়ে অফিসে ফিরেছি। গোপনীয়তা রক্ষা করা হতো আলোচনার সফলতার স্বার্থে। গোপনীয়তা রক্ষা করা নোতাদের কাজ, কিন্তু রিপোর্টারদের দায়িত্বও অগ্রগতি তুলে ধরা। ভিতরের কথা বের করা। যত গোপনই কিছু থাকুক না কেন সত্য খবর কোন রিপোর্টার বের করে প্রকাশ করতে পারলে ক্রেডিট তত বেশি। তাই নিনিয়ান কিংবা নেতারা মুখ না খুললেও রিপোর্টাররা ঠিকই খবর পেয়েছেন। তবে এ-সময় বেশকিছু অনুমাননির্ভর খবরাখবরও প্রকাশিত হয়েছে, যা সত্যের ধারে-কাছেও ছিল না। এতে মাঝে মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো।

নিনিয়ানের সহকারী ড. আনাফু সর্বক্ষণ নিনিয়ানের সঙ্গেই থাকতেন। অপর সহকারী ড. ক্রিস্টোফার চাইল্ড খুব জরুরি কিছু থাকলে গেইটে এসে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের একলাইন, দুইলাইনের একটি ব্রিফিং দিতেন। গোলগাল চেহারার চাইল্ড একলাইনের ব্রিফিং দিতে এসে কথা বলতেন নানা বিষয়ে। টেলিফোন করলে তিনিই ধরতেন। রেকর্ডের মতো একই কথা বারবার বলতেন সবাইকে। চাইল্ড এলে আমরা তাকে ‘শিশু, শিশু’ বলে সম্বোধন করতাম। প্রথমে তিনি বুঝেননি, পরে জেনেছেন চাইল্ড এর বাংলা অর্থ ‘শিশু’। এরপর শিশু বললে তিনি খুশিই হতেন। আমার সঙ্গে চাইল্ডের বেশ ভাব ছিল। মাঝে মাঝে দুই-এক কথা অন্যদের চাইতে বেশি পেয়ে যেতাম এ কারণে। চাইল্ডেকে আমি প্রেস ক্লাবে নিমন্ত্রণ করলে তিনি খুব খুশি হয়ে তা গ্রহণ করেছিলেন। এমনকি আমার বাসায় টেলিফোন করে নিমন্ত্রণের ব্যাপারে কথাও বলেছেন। কিন্তু সংলাপ ব্যর্থতার কারণে তাকে আর খাওয়ানো সম্ভব হয়নি। চাইল্ড ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বলে গিয়েছিলেন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে এলে আমার দাওয়াত অবশ্যই গ্রহণ করবেন।

নিনিয়ানে সঙ্গে প্রটোকল ডিউটিতে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এনায়েত মাওলা। দীর্ঘদেহী মাওলার সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল না। কিন্তু নিনিয়ান আসার দু’একদিনের মধ্যে পরিচয় হয় ভালভাবে। সিকিউরিটির দায়িত্বে ছিলেন পুলিশের সহকারী কমিশনার মাহবুব সাহেব (বর্তমানে এসবি’র ডিআইজি)। তার সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও এ সময়ে পরিচয় হয়। দু’জন নিনিয়ানের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণই থাকতেন। প্রতিদিন সংবাদপত্রের রিপোর্ট সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন। ইত্তেফাকসহ দু’তিনটি বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত সংলাপ, সরকারি ও বিরোধীদলীয় অবস্থানসংক্রান্ত খবর মাওলা প্রতিদিন ইংরেজিতে অনুবাদ করে নিনিয়ানকে শোনাতেন। প্রথম-প্রথম নিনিয়ান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমি প্রতিদিন তার দৈনিক কার্যসূচির খবর সংগ্রহ করতাম। আর এজন্য সর্বক্ষণ পিছনে লেগে থাকতে হতো। তার সব কর্মসূচি খুব গোপন রাখা হতো। কিন্তু প্রতিদিনই বিভিন্ন সূত্রে খবর পেয়ে যেতাম। খবর ছাপার পরদিন সহকর্মী রিপোর্টারা যেমন জানতে চাইতো কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছি, একইভাবে, নিনিয়ান, তার সহকর্মীরা এবং প্রটোকল ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদ্বয়ও আশ্চর্য হতেন। একদিন প্রটোকল কর্মকর্তা মাওলা জিজ্ঞেস করলেন, এসব খবর আপনি কীভাবে পেয়ে যান? জবাবে বলেছি খবর সংগ্রহ করাই তো আমার কাজ। আসলে নিষ্ঠাবান হলে কোন কিছু অসম্ভব থাকে না। আর রিপোর্টারদের বেলায় যোগাযোগ এবং ভাল সোর্স থাকাটা খুবই জরুরী। নিনিয়ানের থাকা-খাওয়াসহ সব কর্মসূচির ব্যবস্থা করা হতো সরকারি পর্যায়ে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে তার প্রতিদিনের কর্মসূচিসহ আলাপ-আলোচনার ফলাফল মনিটরিং করা হতো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কোন কোন কর্মকর্তার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সদ্ভাব আগে থেকেই ছিল। তাই তাদের যখনই জিজ্ঞেস করেছি কিছু না কিছু খবর পেয়েছি। আবার এমন কিছু খবরও জেনে যাই যা তারা না ছাপার জন্য অনুরোধ করতেন। রিপোর্টারদের ভাল সোর্স তৈরি হয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে, আমি সোর্সের সাথে কোনদিন বিশ্বাস ভঙ্গ করিনি। কাজেই আমার প্রয়োজনীয় খবর পেতে অসুবিধা হয়নি তেমন। নিনিয়ান একদিন বুড়িগঙ্গা সেতু, আহসান মঞ্জিল ও জাদুঘর পরিদর্শনে যাবেন বলে আগেই খবর পেলাম। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম নিনিয়ানের সঙ্গে কথা বলার। তাই এ খবর পেয়ে সুযোগের চেষ্টায় রইলাম। বুড়িগঙ্গা সেতু বা আহসান মঞ্জিল না গিয়ে আমি তার কর্মসূচি জেনে জাদুঘরের গেইটে সময়মত দাঁড়ালাম। দুপুর ১২টার দিকে নম্বরবিহীন গাড়িতে করে নিনিয়ান সহকর্মীদের নিয়ে জাদুঘরে আসেন। সোজা উপরে উঠে যান তিনি। আমাকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রটোকল অফিসার মাওলা অবাক হলেন। কীভাবে খবর পেলেন, প্রশ্ন করলেন তিনি। আমার সাফ জবাব, খবর রাখাই তো আমার কাজ। তাকে জানাই আমি নিনিয়ানের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এ জন্যেই এখানে এসেছি। মাওলা বলেন, এটা সম্ভব নয়। আপনি কথা বলতে গেলে আমাদের সমস্যা হবে। কিন্তু আমার কথা বলতেই হবে, কীভাবে বলবো? মাওলা আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, তিনি নিনিয়ানের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলে জানাবেন। তাকে আমার কথা বলবেন। নিনিয়ান রাজি হলে আমাকে বলবেন। আমার আর কিছু বলার ছিল না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলাম। কিন্তু আশা ছাড়িনি।

১৯ নভেম্বর ’৯৫ সকাল ৯টা। টেলিফোন বেজে উঠলো। আমি তড়িঘড়ি টেলিফোন ধরলাম। টেলিফোনে মাওলা সাহেব বললেন, তাড়াতাড়ি মেঘনায় চলে আসুন। নিনিয়ানের সঙ্গে আপনার ব্যাপারে কথা হয়েছে। তিনি সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হয়েছেন। আসতে হবে সাড়ে ৯টার মধ্যে। ৯টায় টেলিফোন, সাড়ে ৯টায় সাক্ষাৎকার। বাসায় স্ত্রী নেই, ছোট ছেলে ঘুমিয়ে। তাকে কার কাছে রেখে যাই। কিন্তু সাক্ষাৎকার মিস করা যাবে না। অনেকদিন চেষ্টার পর সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ হারানো যাবে না। নিনিয়ান ঢাকায় থাকার ৩৯ দিনই পারিবারিক সমস্যায় আমি ভারাক্রান্ত ছিলাম। এতদ্সত্ত্বেও আমি তার পেছনে ছায়ার মতো রিপোর্টের জন্য ঘুরেছি। রাত সাড়ে ১২টায়, ১টায় বাসায় ফিরেছি। শুধু নিনিয়ানের খবর নয়, বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির খবরও একই সময়ে সংগ্রহ করেছি। তা ছাড়াও ছিল সম্মিলিত বিরোধীদলের বৈঠক। বৈঠক শেষে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বর্তমানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের ব্রিফিং। এতসব সমস্যার মধ্যে যদি সব খবর সংগ্রহ করতে পারি তাহলে আজ নিনিয়ানের সাক্ষাৎকারের সুযোগ পেয়েও যদি না যাই তবে আফসোসের সীমা থাকবে না। তাই আর দেরি না করে কাজের লোককে ছোট ছেলের বিছানার কাছে দাঁড় করিয়ে ছুটে গেলাম মেঘনায়। কাঁটায়-কাঁটায় সাড়ে ৯টায় পৌঁছে গিয়ে দেখি বৈঠকখানায় নিনিয়ান বসে আছেন সস্ত্রীক, সেখানে চাইল্ডও উপস্থিত। চাইল্ড আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here