‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ২৩)

0
119

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ২৩)

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

বিরোধীদলের অসহযোগ ও নেতৃবৃন্দ গ্রেফতার

১৫ ফেব্র“য়ারির একদলীয় নির্বাচনের পরদিন বিরোধীদল সরকার পতনের চূড়ান্ত অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। ২৪ ফেব্র“য়ারি থেকে ২৬ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ের অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনেই সারাদেশের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। আর সেদিন থেকে সরকারবিরোধী নেতৃবৃন্দের গ্রেফতার করাও শুরু হয়। প্রথম দিনে আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ নাসিম, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠনো হয়। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে গ্রেফতার করা হয় রাজপথ থেকে। এ গ্রেফতার প্রক্রিয়া নজিরবিহীন। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তেজগাঁওয়ের রাস্তা দিয়ে সোনারগাঁয়ের দিকে আসার সময় নাবিস্কো কোম্পানির কাছে এলে আগে পিছে দু’টি গাড়ি কমান্ডো স্টাইলে তার গাড়ির গতিরোধ করে। কোন পরোয়ানা ছাড়াই গতিরোধকারী গাড়ির আরোহীরা তার গাড়িকে স্কট করে কেন্দ্রীয় কারাগার পর্যন্ত নিয়ে যায়। তার ব্যক্তিগত কর্মচারী, ড্রাইভারকেও কারাগারে সারারাত আটক রেখে ভোররাতে ছাড়া হয়। গাড়ি সমেত কোন নেতাকে ব্যক্তিগত কর্মচারীসহ কারাগারে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বের কোথাও কোনদিন ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। রাতে মওদুদ আহমদ ও মোহাম্মদ নাসিমের গ্রেফতারের খবর পেলেও আনোয়ার হোসেন মঞ্জু গ্রেফতার হয়েছেন তা জানতে পারিনি। তিনি এমনিতেই রাত করে বাসায় ফেরেন। তাই গভীর রাত পর্যন্ত উদ্বেগের কোন কারণ ছিল না। আমি সেদিন কিছুটা আগে অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছিলাম। একবার সাড়ে ১১টার দিকে অফিস থেকে একজন টেলিফোন অপারেটর আমাকে খবর দেন মঞ্জু সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন। আমি তখন নিউজ ডেস্কের সঙ্গে কথা বলি। তারাও শুনেছেন বলে জানান। সবার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, তিনি গ্রেফতার হননি। বাসায় সন্ধ্যার পরও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কিন্তু আমি যখন অফিসে যোগাযোগ করি তখন তিনি কারাগারে। গভীর রাতে ইত্তেফাক ছাপা হওয়ার পরে খবর পাই তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। ইত্তেফাকে সেদিন তার প্রেফতারের খবর ছাপা সম্ভব হয়নি। অবশ্য অন্য একটি সংবাদপত্রে এ খবর ছাপা হয়।

২৭ ফেব্র“য়ারি আওয়ামী লীগের তোফায়েল আহমদ ও জামায়াতের কাদের মোল্লাকে গ্রেফতার করা হয়। তোফায়েল আহমদ গ্রেফতার হন তার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে। তাকে গ্রেফতারের জন্য জোর প্রচেষ্টা গ্রহণ করে সরকার। সরকার গ্রেফতারের পথ গ্রহণের পর থেকে নেতৃবৃন্দ বাসায় থাকতেন না। মোহাম্মদপুরে তার আত্মীয়ের বাসায় থাকতেন। আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাকসহ বড় নেতা, মধ্যম পর্যায়ের নেতারাও আত্মগোপনে থাকতেন। সক্রিয় কর্মীদের অধিকাংশ গ্রেফতার করা হয় আগেই। আত্মগোপনকারী অনেক বিরোধী নেতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। আত্মগোপনে থেকে গোপনস্থানে তাদের বৈঠকের খবরও আমি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। বৈঠকের পর নেতৃবৃন্দ আমার সঙ্গে যোগাযোগও করেছেন। কেউ-কেউ তাদের পালিয়ে থাকা স্থানের টেলিফোন নম্বরও আমাকে দিয়েছেন। কেউ কেউ নিজেরাই প্রতিদিন টেলিফোনে যোগাযোগ রেখেছেন। তোফায়েল আহমদের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ ছিলো। গ্রেফতারের কিছুক্ষণ আগেই তোফায়েল সাহেবের সঙ্গে কথা শেষে আমি দুপুরের আহারে বসি। খাবারের টেবিলে থাকতেই আবার টেলিফোন করে বললেন, শাহজাহান আমি বোধ হয় গ্রেফতার হতে চলেছি। পুলিশ বাড়ির চারিদিক ঘেরাও করে রেখেছে। একজন অফিসার উপরে উঠে আসছে। এ পর্যন্ত বলেই তিনি টেলিফোন রেখে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি সে বাসায় টেলিফোন করলে ধরেন বাসার মালিক। তিনিও আমার পরিচিত। তিনি জানালেন, নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পুলিশ অফিসাররা অপেক্ষা করছেন। তিনি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাবির টেলিফোন পেলাম। তিনি বললেন, আপনার ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে কারাগারে। ভাবিকে জানালাম, কারাগারের দিকে এখনই রওনা হচ্ছি। সঙ্গে-সঙ্গে রওনা দিয়েও তাকে ধরতে পারিনি। তোফায়েল সাহেবকে ঢাকা কারাগারে কয়েক মিনিট রেখেই রাজশাহী কারাগারের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার দেখা করা সম্ভব হয়নি। ভাবিসহ পরিবারের অন্য কেউও দেখা করতে পারেননি। তবে কয়েকজন নিকটাত্মীয় গাড়িতে করে আরিচায় গিয়ে দু’একটি কথা বলতে পেরেছিলেন।

বিরোধী নেতৃবৃন্দ কারাগারে থাকার সময় প্রতিদিনই তাদের পরিবার পরিজনদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়েছে। বিশেষ করে তোফায়েল সাহেবের স্ত্রী আনু ভাবি এবং মওদুদ সাহেবের স্ত্রী হাসনা ভাবির সঙ্গে। কোন খবর থাকলে তারাও দিতেন। নাসিম সাহেবের স্ত্রী বীথি ভাবির সঙ্গেও গ্রেফতারের পরদিনই কথা হয়। নাসিম ভাইয়ের সঙ্গে প্রতিদিন কয়েকবার যোগাযোগ হতো। তিনি সম্মিলিত বিরোধীদলের মুখপাত্র হিসাবে কাজ করতেন। তার সঙ্গেও আমার সম্পর্ক ভ্রাতৃসুলভ। তাকে গ্রেফতারের পর ভাবির সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরা সবাই রাজনীতিবিদের স্ত্রী। কারও মনে তেমন কোন উদ্বেগ লক্ষ্য করিনি। রাজনীতিতে কখনও কারাগার, কখনও ক্ষমতা এইতো স্বাভাবিক। তবে আনু ভাবি এবং হাসনা ভাবি সাক্ষাৎকারের অনুমতি না পাওয়ায় এবং তাদের স্বামীদের তৃতীয় শ্রেণীর বন্দি হিসাবে রেখে শুকনো রুটি ও বাসি ডাল খেতে দেয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। হাসনা মওদুদ জানান, কারাগারে এমনকি মশারিও দেয়া হচ্ছে না। ডিভিশনের আবেদন অবহেলায় পড়ে থাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। বেশ ক’দিন পরে তোফায়েল আহমদ ও মওদুদ আহমদ ডিভিশন পান। আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীসহ ঢাকার একজন মহিলা ওয়ার্ড কমিশনারকেও অসম্মানজনকভাবে সচিবালয়ের সামনে থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদেরও ডিভিশন দেয়া হয় অনেক পরে। বিরোধী নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দেয়। অপরদিকে বিরোধী আন্দোলনও তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ২৮ ফেব্র“য়ারি বিরোধীদলগুলো ৯ মার্চ ’৯৬ থেকে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের তৎকালীন সিটি মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাকেও গ্রেফতার করা হয়। এতে প্রতিবাদে চট্টগ্রামবাসী গর্জে ওঠে। বিক্ষোভের ঝড় ওঠে চট্টগ্রামে। আন্দোলনে আন্দোলনে সারাদেশ উত্তাল হয়েছিল। এই আন্দোলনের মধ্যে ৫ মার্চ তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা ও নতুন নির্বাচন প্রশ্নে আলোচনার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পত্র পাঠান। শেখ হাসিনা ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচন বাতিল না করা পর্যন্ত আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে শেখ হাসিনার সমাবেশে বোমা হামলা হয়। শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে একটি চলন্ত মাইক্রোবাস থেকে এই হামলা হয়। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান। এ অবস্থায় অবিরাম অসহযোগ শুরুর পূর্বমুহূর্তে প্রেসিডেন্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নতুন নির্বাচন প্রশ্নে আলোচনার জন্য বিরোধী নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ জানান। বিরোধীরা আলোচনার পূর্বশর্ত হিসাবে গ্রেফতারকৃত নেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করলে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। সাবাই শর্তানুযায়ী মুক্তি পেলেও জাতীয় পার্টির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মুক্তি পেতে বিলম্ব হয়। আর কুষ্টিয়া কারাগার থেকে সড়কপথে ঢাকা আসতেও অনেক সময় লেগে যায়। অবশ্য তখনকার বেসরকারি বিমান সংস্থা এ্যারো বেঙ্গল এয়ারলাইন্সের বি এইচ হারুন সাহেবকে ত্বরিত মঞ্জু সাহেবকে ঢাকা আনার জন্য যশোরে তাদের বিমান পাঠানো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগেই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু যশোর ত্যাগ করেন। মঞ্জু সাহেব ১০ মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতে পারেননি। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিরোধী নেতৃবৃন্দের আলোচনায় কোন সুফল বয়ে আনেনি। তাই অসহযোগ যথারীতি চলতে থাকে।অবিরাম অসহযোগের ১৬তম দিবস, ২৩ মার্চ ঢাকায় সরকারের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ ঘটে। এদিন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফের নেতৃত্বে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে স্থাপিত হয় জনতার মঞ্চ। জনতার মঞ্চকে কেন্দ্র করে লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটে। বিকালে অফিসে যাবার পথে প্রেসক্লাবের সামনে এবং আশপাশ এলাকার বিপুল জনসমাগমের দৃশ্য দেখে আমি আশ্চর্য হয়ে যাই। এত লোক এলো কোত্থেকে। বিকাল থেকে সন্ধ্যার পর পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করি জনতার এ জাগরণ। রাতে অফিসে গেলে বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার আমাকে বললেন, জনতার মঞ্চ নিয়ে রিপোর্ট লেখার জন্য। যা দেখেছি, যা হয়েছে সঠিকভাবে লিখলাম। পরদিন ইত্তেফাকে তিন কলামে বিশেষ গুরুত্বসহকারে এ রিপোর্ট ছাপা হলো। অসহযোগের দিনগুলোয় আমি নানা কারণে বাসায় থাকিনি। কাকরাইল এলাকার এক হোটেলে অবস্থান করেছি রাতে। সারওয়ার সাহেবের বাসা উত্তরায়, আসা-যাবার অসুবিধার জন্য তিনি উঠেছিলেন এ হোটেলে। পরে হাসান শাহরিয়ার (তখন ইত্তেফাকের বিশেষ সংবাদদাতা) মাঝে মধ্যে থাকতেন। আমরা বাইরে হোটেল থেকে খাবার নিয়ে যেতাম আবার কোনদিন শাহরিয়ার সাহেব অথবা শফিকুর রহমান (বর্তমানে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি) বাসায় খেতাম। মাঝে মধ্যে দিনে বাসায় যেতাম। প্রায়ই টেলিফোনে বেনামে নানাপ্রকার হুমকি আসতো। কে বা কারা হুমকি দিতো জানতাম না। কেউ-কেউ গ্রেফতার করার ভয়ও দেখাতো। এরই মধ্যে অনুজ সাংবাদিক বোরহান কবীর (তখনকার আজকের কাগজের রিপোর্টার) গ্রেফতার হলো। অনেকেই আমাকে সাবধানে চলাফেরার উপদেশ দিলেন। বাসায় আমার স্ত্রী-পুত্ররা সর্বক্ষণ উৎকণ্ঠার মধ্যে থাকতো। কিন্তু এই প্রতিকূল অবস্থায় কখনো মনের জোর হারাইনি। কোন কিছুতেই ভীত হইনি। আমি বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য ঘটনা তুলে ধরার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। অবশ্য এই সঙ্গে যথাসম্ভব সাবধানেও থেকেছি। প্রথম দিকে কিছুদিন সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে থাকতাম। একদিন খবর পেলাম আমার গতিবিধি লক্ষ্য করা হচ্ছে। আমি ওই রাতে অন্য আরেক হোটেলে অবস্থান করি। পরদিন যমুনা গ্র“পের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলকে বিষয়টি জানালাম। তিনি ঢাকায় তার নিজস্ব গেস্ট হাউজে আমাকে নিয়ে রেখে এলেন। বার্বুচি আছে, খাবার-দাবারের সমস্যা নেই। টেলিফোনও আছে। যোগাযোগ করতে পারছি। নিউজ সংগ্রহ করে অফিসে দিচ্ছি কিন্তু দু’দিনেই আমি হাঁপিয়ে উঠি। তৃতীয় দিন সকালে অফিসে সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, তোমার তো কোন অন্যায় দেখছি না। তুমি তো রিপোর্ট করছ। তাই ভয় কিসের? অফিসে চলে এসো। পরদিন থেকেই আবার অফিস শুরু করি।

এবার ‘জনতার মঞ্চ’ প্রসঙ্গে আসি। ২৩ মার্চ রাতে হোটেলে অবস্থান করে পরদিন খুব সকালে প্রেসক্লাবের সামনে জনতার মঞ্চের অবস্থা দেখতে আসি। এসে দেখি চারিদিকে হৈ-চৈ দৌড়াদৌড়ি। সকালেই জানিতে পারি বোমাবাজি হয়েছে। পুলিশ ভোররাতে জনতার মঞ্চ ভেঙে লোকজনকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়। সকালে লোকজন এসে জড়ো হয়ে জনতার মঞ্চ পুনঃদখলের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এ সংঘর্ষকালে পুলিশের একজন সার্জেন্ট নিহত হন এবং বিরোধীদলের অনেক কর্মী আহত হয়। ২৪ মার্চ জনতার মঞ্চ পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে মেয়র হানিফের নেতৃত্বে ও তত্ত্বাবধানে সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত জনতার মঞ্চের কার্যক্রম নির্বিবাদেই চলে। বেগম জিয়া সরকারের পতন এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের পর জনতার মঞ্চ বিজয়মঞ্চে রূপান্তরিত হয়। বিজয় উৎসব শেষে মঞ্চের কার্যক্রমেরও সমাপ্তি ঘটে। এ ক’দিন জনতার মঞ্চ হয়ে উঠেছিল ঢাকার নারী-পুরুষ-শিশুদের এক অভূতপূর্ব মিলন মেলা।

এরই মধ্যে সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘটে। ১৪৪ ধারা, কার্র্ফু ভঙ্গ করে সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সচিব ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীর ও কর্মচারী নেতা সৈয়দ মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে জনতার মঞ্চে এসে বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সরকারি কর্মকতা ও কর্মচারীদের এ আন্দোলনের সংগঠকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন উ র ম মুক্তাদির চৌধুরী, মিজানুর রহমান, আবু আলম শহীদ খান, ইব্রাহিম হোসেন খান, শামীম আহমদ চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদসহ অনেকে। এর আগে সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ১৫ ফেব্র“য়ারির নির্বাচনের পর নিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী আমানউল্লাহ আমানকে কেন্দ্র করে। একজন লিফটম্যানের সঙ্গে তার দুর্ব্যবহারের ঘটনায় সচিবালয়ের কর্মচারীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মন্ত্রীদের সচিবালয়ে প্রবেশের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। এতে সচিবালয় অচল হয়ে পড়ে। এ বিক্ষোভকে কাজে লাগায় সচিবালয়ের আন্দোলনের সংগঠকরা। জনতার মঞ্চ স্থাপনের পর তারা আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সরকারবিরোধীদের কাতারে শামিল হয়ে যান।

আওয়ামী লীগের উদ্যোগে জনতার মঞ্চ স্থাপনের পর বিএনপিও পুরানা পল্টন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ‘গণতন্ত্র মঞ্চ’ স্থাপন করে কর্মসূচি চালাতে থাকে। বিএনপি সমর্থকরা গণতন্ত্র মঞ্চে হাজির হয়ে শক্তি বর্ধন করে। জাতীয় পার্টি বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে অনুরূপভাবে এরশাদ মঞ্চ স্থাপন করে। ঢাকার বাইরেও চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র স্থাপিত হয় অজস্র জনতার মঞ্চ।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here