‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ২৮)

0
95

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ২৮)

নেতৃত্বে

দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে রিপোর্টার হিসেবে মাঠে ঘাটে দৌড়ে অনেক রিপোর্ট করেছি। ঘুরেছি জেলায় জেলায়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সফরসঙ্গী হয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছি। বিদেশেও অনেক সফর করেছি। আবার সম্পাদক হয়ে ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে পত্রিকার সবধরনের কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতাও হয়েছে। এরই মাঝে সুযোগ হয় সাংবাদিক ইউনিয়ন, সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতা নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালনেরও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে অন্য কোন চাকরি না খুঁজে সোজাসুজি সাংবাদিকতায় আসি। রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু। তখন থেকে সাংবাদিকতা পেশা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কিছুদিন কাজ করেছি। সাংবাদিকতা শুরু সেখান থেকেই। ১৯৭৫ সালে চারটি দৈনিক ছাড়া অন্য পত্রিকাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ওই সাপ্তাহিক পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে অন্যান্য পত্রিকা প্রকাশিত হলেও আমার জীবনে প্রথম কাজ করা সেই সাপ্তাহিক পত্রিকাটি আর প্রকাশ হয়নি। সেই পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক ‘প্রসঙ্গ’। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের সে সময়কার সাধারণ সম্পাদক আলী আকসাদ। এই সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা। সাপ্তাহিক প্রসঙ্গ শান্তি পরিষদের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। বামপন্থী আলী আকসাদ একসময় সাংবাদিক ছিলেন। দৈনিক ইত্তেফাকেও কাজ করেছেন। পরে সম্পৃক্ত হন শান্তি পরিষদের সাথে। আমৃত্যু তিনি শান্তি পরিষদের সঙ্গেই ছিলেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জুলিওকুরি শান্তি পদকে ভূষিত করা হয়। এই শান্তি পরিষদই ঢাকায় পদক বিতরণে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বিশ্ব শান্তি পরিষদ তখন বিশ্বব্যাপী অনেক বড় সংগঠন। আজও তা আছে। তবে এত শক্তিশালী নয়। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের নেতৃত্বে মূলত আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীদের আধিক্য। তখন এই সংগঠনে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দাপট ছিল বেশি। আলী আকসাদও ছিলেন কমিউনিস্ট। আমি আকসাদ সাহেবের মুখে শুনেছি সাপ্তাহিক প্রসঙ্গের ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সালের মাঝামাঝি থেকে পত্রিকাটি প্রকাশ শুরু হয়। আমি ছিলাম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমরা চার-পাঁচ জন কাজ করতাম। এর মধ্যে আকসাদ ভাইয়ের এক ভাতিজা মলয়ও ছিলেন। আর একজন হিসাবরক্ষক ও একজন পিয়ন। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে যেতাম। আলী আকসাদের কাছ থেকেই প্রথম সাংবাদিকতা শেখা। লিখতাম আবার প্রকাশনাও দেখতাম। পত্রিকাটি ছাপা হত নওয়াবপুরের অভ্যুদয় নামের একটি প্রেস থেকে। একই প্রেসে তখন অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত ‘কণ্ঠস্বর’ নামে একটি লিটল ম্যাগাজিন ছাপা হত। প্রেসে প্রায়ই তার সঙ্গে দেখা হতো। তিনি তখন ঢাকা কলেজের অধ্যাপক। প্রসঙ্গ পত্রিকায় তখন ‘হিং টিং ছট’ নামে একটি কলাম লিখতেন আজকের সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। তখন তিনি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের চিফ সাব-এডিটর। আর লিখতেন দৈনিক সংবাদের তৎকালীন সিটি এডিটির হাসান আলী। তার স্ত্রী বেবী মওদুদও লিখতেন। আর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদ করতেন নাজীমউদ্দিন মোস্তান। বেবী মওদুদ তখন সংবাদের রিপোর্টার আর নাজীমউদ্দিন মোস্তান সংবাদের সাব এডিটর। বেবী মওদুদ ছিলেন একজন বিচারপতির কন্যা, আর হাসান আলী পঞ্চগড়ের এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পরিচয়। সেই সূত্র ধরেই সম্পর্ক এবং বিয়ে। দু’জনই তখন সংবাদে। তাদের বাসা ছিল তোপখানা রোডে। আর প্রসঙ্গ অফিসও তোপখানা রোডে। জাতীয় প্রেসক্লাবের উল্টোদিকে বিশাল যে পরিসংখ্যান ভবন এর তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ শান্তিপরিষদের অফিস। এই অফিসের দু’টি রুম নিয়ে করা হয় সাপ্তাহিক প্রসঙ্গ অফিস। প্রসঙ্গ অফিসেই বেবী আপার সাথে আমার পরিচয়। তিনি প্রথম দিন থেকেই আমাকে ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করতেন। প্রসঙ্গ অফিসে হাসান আলী সাহেব এলে প্রায় দিনই তিনি আমাকে বাসায় দুপুরের খাবারের জন্য নিয়ে যেতেন। বেবী মওদুদ চাকরি করেও নিজ হাতে রান্না করতেন। প্রথম থেকেই বেবী আপা আমাকে সাংবাদিকতায় আসার জন্য উৎসাহ দেন। তখনও ভাবিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেব।

১৯৭৫ সালে প্রসঙ্গ বন্ধ হয়ে গেলেও বেবী মওদুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকে। তিনি তখন চাকরি নেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ তথ্য অধিদপ্তরের ফিচার ব্যুরোতে। মাঝে মাঝে আমিও ফিচার লিখতাম। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার অনুপ্রেরণায় সরাসরি দেশের প্রাচীনতম দৈনিক আজাদ-এ স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কাজ শুরু করি। প্রসঙ্গত আমরা যারা কাজ করতাম এক দশকের মধ্যে মোটামুটি সবাই দৈনিক ইত্তেফাকে আবার একসাথে হই। গোলাম সারওয়ার তখন বার্তা সম্পাদক হয়ে যান। মোস্তান সাহেব সংবাদ থেকে ইত্তেফাকে গিয়ে সিনিয়র রিপোর্টার, বেবী মওদুদ মহিলা পাতার দায়িত্বে। আমি সবার পরে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগদান করি। এই বেবী মওদুদকে সাংবাদিকরা সবাই জানেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবী হিসেবে। একসাথে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শেখ হাসিনা দেশে ফিরে যাদের কথা প্রথম বলেন তাদের মধ্যে বেবী মওদুদ একজন। তিনি এখন আমাদের মাঝে নেই। নির্লোভ, নিরহংকারী বেবী মওদুদ আজীবন বঙ্গবন্ধু কন্যার সুসময়ে, দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। নবম সংসদে তিনি সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি ছিলেন। তিনি সর্বশেষ দেশের প্রধান অনলাইন সংবাদ সংস্থা ও সংবাদপত্র বিডিনিউজ-এর সোশ্যাল ওয়েলফার এডিটর ছিলেন। বেবী আপার স্বামী হাসান আলী মারা গেছেন আরো অনেক আগে। সংবাদ বন্ধ হয়ে যাবার পর তিনি আর সাংবাদিকতায় ফেরেননি। সরকারি চাকরি দেয়া হলেও তা নেননি। ওকালতি পেশা শুরু করেন। পেশায় ভালই করছিলেন। কিন্তু অকালেই মারা গেলেন হাসান ভাই। আর বেবী আপাও অনেক স্মৃতি রেখে চলে গেছেন আমাদের ছেড়ে।

বলেছিলাম দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে কয়েক বছর ইউনিয়ন ও সাংবাদিকদের সংগঠনের নেতা নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। আশির দশকের শুরুতেই আমি সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে সম্পৃক্ত হই। তখন ইউনিয়ন ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। সাংবাদিকদের অধিকার ও দাবি-দাওয়া আদায়ে বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করে আসছিল। এখন সাংবাদিক ইউনিয়নে বিভক্তির কারণে নেতৃত্বের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় শাক্তিশালী ভূমিকা পালন সম্ভব হয় না। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) সাংবাদিকদের শীর্ষ সংগঠন। এর অধীনে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভাগীয় জেলা পর্যায়ের ইউনিয়ন। আমার ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার সময় ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বগুড়া, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর ও যশোরে সাংবাদিক ইউনিয়নের ইউনিট ছিল। তখন ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচনে ভোটার ছিলেন কাউন্সিলররা। অর্থাৎ প্রতিটি ইউনিটের ১০জন ভোটার মিলে একজন কাউন্সিলর নির্বাচিত করতেন। এই কাউন্সিলররা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করতেন সভাপতি, সাধারণ সম্পাদসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। এখন সরাসরি ভোট। কাউন্সিলর সিস্টেম নেই।১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আমি বিএফইউজের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে নির্বাচনের জন্য আমার ফোরাম থেকে মনোনীত হই। তখন ইউনিয়ন ছিল একটি। আর ফোরাম দুটি। একটি আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থীদের সমর্থিত। অন্যটি তখনকার ডানপন্থী, বিএনপি ও চীনাপন্থীদের সমর্থিত। আমি প্রথম থেকেই প্রথমোক্ত ফোরামের পক্ষে। বিএফইউজে’র এই পদে সাধারণত আগে থেকে যারা ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে নির্বাচন করে আসছেন তারাই মনোনয়ন পান। আর আমি আগে ইউনিয়নের কোন নির্বাচনে অংশ নেইনি। এরপরও মনোনয়ন পাই। নির্বাচিত হই সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে। প্রথমবার আমাদের সভাপতি ছিলেন হাবিবুর রহমান মিলন ও সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ জাফর। সফলভাবে প্রথম মেয়াদের দু’বছর পার হয়। দ্বিতীয়বারও আমি একই পদে নির্বাচন করে জয়ী হই। সেবারও সর্বোচ্চ ভোট। তখন সভাপতি ছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমানুল্লাহ কবীর। এই দু’ কমিটিতেই তৎকালীন দুই ফোরমের শীর্ষ নেতা যেমন ইকবাল সোবহান চৌধুরী, গিয়াস কামাল চৌধুরীও ছিলেন। তারা নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে নির্বাচিত এবং মনোনীত হন। দ্বিতীয় মেয়াদের পর আমি ইউনিয়ন কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। আমি মনে করেছি ইউনিয়ন ও সাংবাদিকতা দু’টি সমানতালে করা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। একটি করতে গিয়ে আরেকটির ক্ষতি হচ্ছে। তাই ইউনিয়ন পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় মনোযোগ দেই। এর সুফলও আমি পেয়েছি। মেধা, শ্রম দিয়ে একাগ্রভাবে কাজ করার কারণেই হয়তো আজ আমি সম্পাদক। আর ইউনিয়ন করলে ঐক্যবদ্ধ ইউনিয়নেরও আরো বড় নেতা হয়তো নির্বাচিত হতে পারতাম। আর বর্তমান ইউনিয়নের সর্বোচ্চ পদেও নির্বাচিত হয়ে যেতে পারতাম। তবে আমি বর্তমান অবস্থায়ই খুশি। কেননা নিরেট সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে থাকতে চাই। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে চাই। তবে আমি কিন্তু ইউনিয়নসচেতন। এখনও আমার পছন্দের ফোরামের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক আমি। কেননা আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। সেই সঙ্গে রাজনীতি সচেতন।

বিএফইউজে আমার দ্বিতীয় মেয়াদের সময় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নির্বাহী কমিটির বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়। এই সময় সভাপতি ছিলেন রিয়াজউদ্দিন আহমদ ও সেক্রেটারি জেনারেল আমানুল্লাহ কবীর। আমি সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল। বিএফইউজে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে বৈঠক করে আসছিল। এমনই একটি বৈঠক চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার স্থান নির্ধারণ হয়। কক্সবাজারে তখন ইউনিট ছিল না। চট্টগ্রামের কারণে কক্সবাজার সংযুক্ত করা হয় ভ্রমণের জন্য। কক্সবাজার বলে পরিবার-পরিজনসহ ব্যবস্থা। চট্টগ্রামের থাকা-খাওয়ার আয়োজন করবে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন। আর ঢাকা থেকে যাওয়া-আসা এবং কক্সবাজারে থাকা-খাওয়া ইত্যাদির আয়োজনের ভার আমার ওপর। সভাপতি রিয়াজউদ্দিন আহমদের শুশুরবাড়ি চট্টগ্রাম শহরতলীতে। কিন্তু তিনি সে-সময় দেশে থাকবেন না। থাকলে সব তিনিই করতে পারতেন। চট্টগ্রাম যাতায়াতের জন্য আমরা প্রথমে বাস সংগ্রহের চেষ্টা করলাম। পরিবার-পরিজনসহ শতাধিক লোক আমরা। বাসের ব্যবস্থা হলো না। অবশেষে ঠিক করলাম ট্রেনে যাব। তখন যোগাযোগমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। ইত্তেফাক সম্পাদক। জাতীয় প্রেস-ক্লাবের এককালের সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিকবান্ধব। আমরা গেলাম তার কাছে। বললাম একশ’ লোকের চট্টগ্রামে ফ্রি আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বললেন, তোমরা পাগল নাকি? এত লোককে ফ্রি। দু’চার জন হলে দেখা যেতো। আমরা বললাম, হয় ট্রেন ফ্রি করতে হবে না হয় আপনাকে ভাড়া দিতে হবে। তিনি বললেন, ভাড়া আমি দিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এত লোকের জন্য ফ্রি করা যাবে না। আমি ভাবলাম তার নিজ মন্ত্রণালয়ের ট্রেন দিয়ে ভ্রমণের জন্য তার কাছ থেকেই ভাড়া নেয়া কেমন যেন হয়ে যায়। হঠাৎ মনে এলো ভিআইপি কেবিনের কথা। প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীদের সরকারি সফরে ব্যবহারের জন্য রেলের ভিআইপি কেবিন রয়েছে। আমি কয়েকবার পেশাগত কারণে মন্ত্রীদের সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। তুললাম ভিআইপি কেবিনের কথা। কিন্তু দেখা গেল ভিআইপি কেবিনে স্থান সংকুলান হয় না। এরপর আমি বললাম, একটি ট্রেন চট্টগ্রাম আসা-যাবার জন্য যা বগি থাকে এর বাইরে অন্য একটি বাড়তি বগি সংযোজনের জন্য। অনেক সময় খালি বগি স্টেশনে পড়ে থাকে। একটি বাড়তি বগি সৌজন্য হিসেবে দিলে আর সমস্যা হয় না। এই প্রস্তাবে তিনি রেলের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললেন। সমাধান এলো আমাদের প্রস্তাবের পক্ষে। আমাদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিলেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। এবার কক্সবাজারে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা। তখন কক্সবাজারে জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন জিয়াউদ্দিন বাবলু।

তৎকালীন জ্বালানি মন্ত্রী বর্তমানে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ ভাল। আমরা গেলাম জিয়াউদ্দিন বাবলুর কাছে। তিনি বললেন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা তখন পর্যটকদের আনাগোনা ছিল বেশি। সার্কিট হাউজ, পর্যটনকেন্দ্রসহ হোটেলের অধিকাংশ আসন বুকিং ছিল আগে থেকেই। তিনি যোগাযোগ করলেন কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সঙ্গে। তখন জেলা প্রশাসক ছিলেন কামাল উদ্দিন সাহেব। তিনি একসময় আমার নিজ উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। তাই আমারও পরিচিত ছিলেন। বাবলু সাহেব জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে জানালেন। এক বা দুই জায়গায় সবাইকে রাখা যাবে না। থাকতে হবে বিভিন্ন হোটেল, রেস্টহাউজ, গেস্ট হাউজে বিক্ষিপ্তভাবে। তখন কক্সবাজারে এত হোটেল, গেস্টহাউজ ছিল না। জেলা প্রশাসককে আমাদের থাকার ব্যবস্থার জন্য মন্ত্রীর নির্দেশে বেশ কয়টি হোটেল, গেস্টহাউজ রিকুইজেশন করতে হয়েছিল। আর সে-সময় কক্সবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন সালাউদ্দিন আহমদ। আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তিনি এমপি এবং পরে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন। আমার বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাকেও বললাম। তিনিও আমাদের বেশ সহযোগিতা করেন। নির্ধারিত সময়েই আমরা সফলভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সফর করি। চট্টগ্রামে সফলভাবে বিএফইউজে’র বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তখন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন আজিজুল ইসলাম ভুঞা। সংগ্রামী নেতা। পরে বাসস-এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হন। আর সেক্রেটারি ছিলেন নাসির আহমদ। আজিজুল ইসলাম ভুঞাকে আমাদের আপ্যায়নের জন্য সকালে নিজ হাতে ডিম ভাজতে দেখেছি। আগেই বলেছি আমাদের সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন সাহেবের শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামের শহরতলীতে। তিনি না থাকলেও তার শ্বশুরবাড়িতে আমাদের জন্য ভুরিভোজের ব্যবস্থা করা হয়। তার শ্যালক আফসারুল আমিন (পরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী) নিজে থেকে আমাদের আপ্যায়ন করেন। সাংবাদিক ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলাম ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। এরপর ইউনিয়ন কার্যক্রম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেই। পরে ইউনিয়ন বিভক্ত হয়ে গেলে সাংবাদিকদের মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামও দুর্বল হয়ে পড়ে। আর এর মধ্যে বড় বড় শিল্পপতি, ব্যবসায়ীরা পত্রিকার ব্যবসায় আসেন। সংবাদপত্রে গড়ে উঠে একধরনের কর্পোরেট কালচার। তাদের নিজস্ব নিয়ম-কানুনে চলে সেই সংবাদপত্রগুলো। এখন অনেক সংবাদপত্র আছে যেখানে সাংবাদিকদের ইউনিট পর্যন্ত নেই। ব্যক্তিগতভাবে ইউনিয়নের সদস্য হয়ে ভোটার হন।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here