মার্কিন রাজনীতির গোলকধাঁধায় করোনার টিকা

0
96

আ ব ম ফারুক

করোনার টিকা আমাদের আগের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী অক্টোবর নাগাদ প্রায় তৈরি। কিন্তু মনে হচ্ছে, সংকটগ্রস্ত পৃথিবীর জন্য আশীর্বাদরূপ এই টিকা সহজে জনগণের নাগালে আসছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এখানে বড় একটি ভূমিকা রাখছে। টিকার পক্ষে-বিপক্ষে নয়, আসলে এখন ইস্যু হয়েছে টিকা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে আসবে, না পরে। এ প্রসঙ্গে আগের সব ঘটনা বাদ দিয়ে অতি সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে আসি।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন ওষুধ কম্পানি মডার্নার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিন্যানশিয়াল টাইমসকে জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই তাঁদের টিকা প্রস্তুত হয়ে যাবে। কিন্তু তাঁরা নির্বাচনের আগে এফডিএর কাছে এই টিকার ইমার্জেন্সি ইউজ অ্যাপ্রুভাল বা জরুরি ব্যবহারের অনুমতির জন্য আবেদন করবেন না। তাঁরা এই আবেদন করবেন নভেম্বরের শেষের দিকে।

আগের দিন অর্থাৎ ২৯ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার বহুল প্রচারিত প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, টিকা প্রস্তুতকারী বিভিন্ন কম্পানির সঙ্গে আলোচনার পর তিনি আশা করছেন, ফাইজার ও মডার্না আগামী ১ নভেম্বরের আগেই তাদের টিকা বাজারে নিয়ে আসতে পারবে।

এর আগে ফাইজার শিগগিরই তাদের টিকার ফেজ-৩ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করবে এবং অক্টোবরে টিকার এফডিএ অনুমোদন নিয়ে এই মাসের শেষের দিকে বাজারে আসবে বলে কথা দিয়েছিল। সব ফলাফল সন্তোষজনক থাকার পরও তারা ফেজ-৩ পরীক্ষা সেপ্টেম্বরে শেষ করার বদলে আকস্মিকভাবে কোনো কারণ না দেখিয়ে সময়সীমা এক মাস বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে অক্টোবরে এই টিকা বাজারে আসবে না।

এর এক সপ্তাহ আগে মার্কিন ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা এফডিএ বলেছিল, জনগণের স্বার্থে তারা অক্টোবরের শেষের দিকে দু-একটি টিকা অনুমোদনের আবেদন দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারে। অর্থাৎ দু-একটি টিকা বাজারে আসার মতো প্রায় তৈরি হয়েছে। এখন তারা বলছে, টিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে অনুমোদনের জন্য সময় সংক্ষিপ্ত করবে না। তারা নভেম্বরের শেষের দিকে হয়তো এসব আবেদন বিবেচনা করতে পারবে।

এরও আগে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি অর্থাৎ সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন তাদের সব স্টেটকে জানিয়েছিল, অচিরেই দুটি টিকা দেশের সর্বত্র পাঠানো হবে এবং এসব টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ লোক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অগ্রাধিকার পায় তার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হোক। কিন্তু এখন সিডিসি সেসব নিয়ে আর কোনো কথা বলছে না। প্রভাবশালী পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতে, সম্ভবত তখন ফাইজার ও মডার্নার টিকার কথাই সিডিসি বলেছিল।

গত মাসের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউটের প্রধান জানিয়েছিলেন, যে টিকাই বাজারে আসবে তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েই আসবে। এসব বিষয়ে বিজ্ঞানীরা যে কোনো আপস করবেন না তা একজন স্বেচ্ছাসেবকের মেরুদণ্ডে প্রদাহ দেখা দেওয়ার পরই অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা সারা বিশ্বে বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাই প্রমাণ করে। সিনেট কমিটির শুনানিতে তিনি জানিয়েছিলেন, অনুমোদিত এ রকম টিকা বাজারে আসার পর মানুষের জীবন রক্ষার জরুরি প্রয়োজনে অতি দ্রুত টিকা দেওয়ার সুবিধার্থে ফার্মেসিগুলোতে ফার্মাসিস্টরা মানুষকে কিভাবে এই টিকা দেবেন তার নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এখন সব চুপচাপ।

অর্থাৎ আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে যে কয়টি টিকা বাজারে আসার মতো প্রতিযোগিতায় ছিল, সেগুলোর সবই নির্বাচনের পরে আসার ব্যাপারটা এখন মোটামুটি নিশ্চিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নানা রকম চেষ্টার অংশ হিসেবে নিজের দেশসহ পৃথিবীর দেশে দেশে যেখানেই টিকা আবিষ্কারের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেখানেই অগ্রিম টাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণ টিকার ডোজ কিনেছেন, যেন সবার আগে মার্কিন জনগণ টিকা পেতে পারে। এ জন্য নাকি তিনি সর্বমোট ১০.৭ বিলিয়ন ডলার দেশ-বিদেশের বিভিন্ন কম্পানিকে অগ্রিম দিয়েছেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই তিনি এ নিয়ে নানা উল্টাপাল্টা কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, এর ফলে মহামারি আরো ছড়িয়েছে। না হলে যুক্তরাষ্ট্রে নাকি এত লোক মারা যেত না। তিনি নিজেও মাস্ক ও সামাজিক দূরত্বকে অবহেলা করে এখন কভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তিনি নাকি এসব করেছেন ব্যবসায়ীদের কথা শুনে অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার চেষ্টায়। কিন্তু এখন বিপুলসংখ্যক মার্কিনের মৃত্যু, মহামারির ব্যাপক বিস্তার ও অবৈজ্ঞানিক মন্তব্যের কারণে তিনি সরকারি সংস্থাগুলোসহ অনেকেরই বিরাগভাজন হয়ে গেছেন বলে মনে হচ্ছে। মার্কিন টিকাও এই ফ্যাসাদে পড়ে গেছে বলে প্রতীয়মান।

অনেকেই বলছেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে কোনো টিকা অনুমোদন পেলে কথা উঠতে পারে যে ট্রাম্পের চাপে তাঁকে রাজনৈতিক সুবিধা পাইয়ে দিতে এটা করা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তাকেই হয়তো মানুষ অবিশ্বাস করবে। কোনো পক্ষ যাতে এই টিকার ইস্যুকে নির্বাচনে ব্যবহার করতে না পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই নাকি মার্কিন প্রশাসনিক সংস্থা ও কম্পানিগুলো এমন অবস্থান নিয়েছে। ফলে মার্কিন রাজনীতির গোলকধাঁধার আবর্তে এখন করোনার টিকা।

মার্কিন রাজনীতির প্রায় পুরোটাই এখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেন্দ্রিক। নির্বাচন ঘিরে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দুই দলের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা। ট্রাম্পের অসুস্থতার পর তাঁকে চিকিৎসা করা হয়েছে গিলিয়াড কম্পানির রেমডেসিভির, বাজারে আসার অনুমতির অপেক্ষায় থাকা পরীক্ষাধীন রেজেনেরন কম্পানির একটি মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি এবং ইলি লিলি কম্পানির আরেকটি পরীক্ষাধীন অ্যান্টিবডি, ফেমোটিডিন, জিংক ও ভিটামিন ডি দিয়ে। একজন প্রেসিডেন্টের সর্বোত্তম চিকিৎসার নিশ্চয়ই কোনো কমতি হয়নি।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সব প্রটোকল সমাপ্ত করার পর নির্বাচনের মাত্র এক মাস আগে, কোনো কোনো রাজ্যে যেখানে ভোটগ্রহণও শুরু হয়ে গেছে, যদি কোনো প্রার্থী গুরুতর অসুস্থ হন বা হাসপাতালে ভর্তি থাকেন কিংবা মারা যান তখন কী হবে এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে কিছু বলা নেই। কারো মতে, ট্রাম্প প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে খুব খারাপ করায় এবং জনসমর্থন নিম্নমুখী হওয়ায় এখন তিনি ভোটারদের সহানুভূতি পাওয়ার জন্য করোনা আক্রান্ত বলে নাটক করেছেন, মনে হয়তো অন্য চিন্তা রয়েছে। বিশ্বাস হয় না। করোনা আক্রান্ত হওয়া-না হওয়া নিয়ে কেউ নাটক করতে পারে? তবে মোদ্দা কথা হলো, নির্বাচনী গোলকধাঁধা বেশ জটিল হয়েছে। মার্কিন টিকা হয়তো এই আবর্তে আরো ফ্যাসাদে পড়ল।

ফ্যাসাদ মার্কিন মুলুকের বাইরে অক্সফোর্ডের টিকারও হয়েছে। ফেজ-৩ পরীক্ষার প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে টিকা নেওয়ার পর ব্রিটেনে একজন স্বেচ্ছাসেবকের মেরুদণ্ডে ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিস ধরনের প্রদাহ সৃষ্টির কারণে বিশ্বব্যাপী পরীক্ষাটি বন্ধ করা হয়।

তবে ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিস টিকা দেওয়া ছাড়াও বিভিন্ন কারণে হতে পারে। ১৯৭০ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত ‘পাবমেড’, ‘এমবেস’ ও ‘ডায়নামেড’ সার্চ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত পৃথিবীর তাবৎ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত হাজার হাজার বৈজ্ঞানিক গবেষণাকাজ জরিপ করে ‘রিসার্চগেটডটনেট’ ২০০৯ সালের নভেম্বরের রিপোর্টে বলেছে, এই সময়ে টিকাগ্রহীতারা যেসব টিকা নিয়েছিল তার মধ্যে রয়েছে—হেপাটাইটিস-‘বি’, মিসলস, মাম্পস, রুবেলা, ডিপথেরিয়া, টিটেনাস, পারটুসিস ও অন্যান্য টিকা। রোগীরা ছিল শিশু, অপ্রাপ্তবয়স্ক ও তরুণ-তরুণী। এই দীর্ঘ ৩৯ বছরে শতকোটি মানুষকে এসব টিকা দেওয়ার পরও মাত্র ৩৭ জনের ক্ষেত্রে ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিসের মতো বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, যা আবার চিকিৎসাযোগ্য। তার পরও বিশদ তদন্ত করে দেখা গেছে, এই ঘটনাগুলোর জন্য টিকার মূল উপাদানটি দায়ী নয়। দায়ী এর কোনো কোনো অনুষঙ্গী উপাদানে এই বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের অতিসংবেদনশীলতা। অতএব যাঁরা অক্সফোর্ডের টিকার নিরাপত্তা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আছেন, আশা করি তাঁরা সংশয়মুক্ত হবেন।

উপরোক্ত ব্যাপক আকারের গবেষণাটি করা ও প্রকাশিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১১ বছর আগে। অতএব এর নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ নেই। দ্বিতীয়ত, শত শত কোটি মানুষকে বাঁচানোর জন্য পৃথিবীতে এত টিকা আজ ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৭ জনের এ রকম বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেওয়ার পরও এসব টিকা কর্মসূচি চলমান রয়েছে। কারণ ফার্মাকোলজির নিদানিক সূত্র রিস্ক-বেনিফিট রেসিওতে এখানে রিস্কের তুলনায় বেনিফিট অনেক বেশি। আজ সারা পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর প্রশ্নটা যেখানে বড়, সেখানে কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকলেও এর চেয়েও তুলনামূলক ভালো কিছু না পাওয়া পর্যন্ত আমাদের কারোরই কোনো করোনার টিকা নিয়ে অপপ্রচারের সুযোগ নেই। বিশেষ করে অক্সফোর্ডের টিকা নিয়ে। কারণ এখন পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী বিশ্বে এই টিকাটিই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের ওপর পরীক্ষিত এবং এই বিবেচনায় কার্যকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার প্রশ্নে তুলনামূলক সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।

গত ১ অক্টোবর রয়টার্সের খবরে জানা যায়, ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (এমা) সেদিন অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তার চূড়ান্ত পর্যালোচনা শুরু করেছে। তারা এই টিকার শুরু থেকে এ পর্যন্ত যত হাজার রোগীর ওপর এই টিকার পরীক্ষা হয়েছে, তার সব তথ্যই পর্যালোচনা করবে। তার মানে হলো, পাহাড়প্রমাণ এসব ডাটা সন্তোষজনক পাওয়া গেলে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই টিকা অনুমোদন করবে। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারির ব্যাপক ভয়াবহতার মধ্যে এই খবরটি স্বস্তিদায়ক। হয়তো এতে এই টিকা নিয়ে ফ্যাসাদ কিছুটা কমবে।

কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ অনুমোদনকারী কর্তৃপক্ষ ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) অক্সফোর্ডের এই টিকার আটকে থাকা ফেজ-৩ আবার শুরু কিংবা আগের তথ্য পর্যালোচনা—কোনোটাই শুরু করেনি। কবে শুরু করবে তা-ও বলেনি। তারা শুধু জানিয়েছে, সময় লাগবে। নিশ্চয়ই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ছাড়া আগে এই সময় হবে না বলে আমরা আশা করতে পারি।

তবু বিশ্বজুড়ে টিকার এই ফ্যাসাদ কিছু কমুক। নানা প্রচার আর অপপ্রচারের গোলকধাঁধার মধ্য থেকে কার্যকর ও নিরাপদ টিকাগুলো বেরিয়ে আসুক। কারণ প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব টিকা দিয়ে মানুষকে সাহায্য করা দরকার।

তবে পত্রিকায় সম্প্রতি একটি খবর পড়ে অবাক হয়েছি। গণচীনের যে টিকাটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে এই মাসে শুরু হওয়ার কথা ছিল তা নাকি না-ও হতে পারে। চীন নাকি এখন আর এতে আগ্রহী নয়। বাংলাদেশে এটি নতুন ফ্যাসাদ।

তবে সান্ত্বনা এই যে চীন বাংলাদেশে তার টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বন্ধ করলেও যেহেতু অক্সফোর্ডের টিকা আমরা পাচ্ছি, সেহেতু এই ট্রায়াল বন্ধ হলেও তা পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। কারণ অক্সফোর্ডের টিকা হলো একটি ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন। ঠাণ্ডা জ্বরের বা সর্দি-কাশির এডিনোভাইরাসকে কিছুটা পরিবর্তন করে একে নির্জীব করে ফেলা হয়েছে, যাতে এটি আর কোনো ক্ষতি বা বংশবিস্তার করতে না পারে। এর উপরিভাগে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন বসিয়ে এই টিকা তৈরি হয়। ফলে এই প্রোটিনের বিরুদ্ধে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। পরবর্তী সময়ে আসল করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে একই স্পাইক প্রোটিন দেখে শরীরের ভেতরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডিগুলো একযোগে করোনাকে আক্রমণ করে। ফলে শরীরে এই ভাইরাস ধ্বংস হয়ে শরীরকে রক্ষা করে। এই কৌশলে শুধু অক্সফোর্ডই টিকা তৈরি করছে তা নয়। রাশিয়ার গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট ও রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর বিজ্ঞানীদের যৌথভাবে তৈরি টিকাও একই কৌশলে তৈরি। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’-এর ‘নেচারনিউজ’ ৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ সংখ্যা থেকে জানা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসন অ্যান্ড জনসন কিংবা গণচীনের সামরিক বাহিনী ও ক্যানসিনো বায়োলজিকসের যৌথভাবে তৈরি টিকা—এগুলোও একই কৌশলের টিকা। শুধু উৎপাদনকারী ও নামের পার্থক্য। অতএব চীনের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল না হলেও তেমন হারাবার কিছু নেই। বরং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এই একই টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এখন অফিশিয়াল অনুমোদনের অপেক্ষায়, এর পরই তা বাজারে আসতে পারবে। জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকা তো ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আসছেই। সেই সঙ্গে পাশাপাশি আসছে রাশিয়ার টিকা।

কিন্তু টিকা বেরোলেই করোনা মহামারি চলে যাবে তা কিন্তু নয়। টিকা নেওয়ার পরও আমাদের এখনকার স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলতে হবে। যেমন—ঘরের বাইরে গেলেই মাস্ক ও চোখে বড় চশমা পরা, ঘন ঘন ২০-৩০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া, মুখে ও চোখে অপরিষ্কার হাত না লাগানো, করমর্দন না করা, রেস্টুরেন্টে না খাওয়া ও আড্ডা না দেওয়া, ছয় ফুটের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড়ে বা লোকারণ্যে না যাওয়া, গাদাগাদি করে যানবাহনে না ওঠা, যারা জোরে কথা বলে তাদের সামনে না যাওয়া ইত্যাদি মেনে চলতে হবে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা বেশি মারাত্মক হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। কিন্তু টিকা নিয়ে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়িয়ে উপরোক্ত সাবধানতাগুলো মেনে চলতে পারলে আমরা কার্যকরভাবে এই মহামারিকে প্রতিরোধ করে জনস্বাস্থ্য রক্ষা করতে পারব বলে আশা করা যায়। টিকার পাশাপাশি মানুষের সচেতনতা তাই আজ অত্যন্ত জরুরি।

লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক
বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টার; সাবেক চেয়ারম্যান ফার্মেসি বিভাগ, সাবেক চেয়ারম্যান ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগ, সাবেক ডিন ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সাবেক আহ্বায়ক জাতীয় ওষুধনীতি ২০১৬ প্রণয়ন উপকমিটি
abmfaroque@yahoo.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here