‘হুজুর’ বললেন… ধর্ষণের কারণ ‘মেয়েদের অশ্লীলতা’!

0
101

সজীব সরকার

আমি যে বাসায় থাকি, তার ঠিক পাশের ভবনটিই একটি মসজিদ। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয়সহ নানা ইস্যুতে এ মসজিদের ‘হুজুর’ নিয়মিত বয়ান করে থাকেন। তার বয়ানগুলো বিনামূল্যে বেশ বিনোদন দেয়। এই যেমন—এখনকার বাপ-মায়েরা ভালো না, তারা নিজেদের সঠিক দায়িত্ব পালন করে না। বাপ-মায়ের প্রকৃত কর্তব্য হলো পিটিয়ে সন্তানদের ‘নামাজি’ বানানো যা এখনকার বাপ-মায়েরা করে না। সম্প্রতি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর তার বক্তব্য ছিল, যারা ইসলামের আদর্শে বিশ্বাস করে, তাদের করোনা হয় না; যারা বিধর্মী ও ইসলামের শত্রু এবং ইসলামে বিশ্বাস করে না, তাদেরই আল্লাহ করোনার গজব দেয়। (ইচ্ছে থাকলেও ‘হুজুরকে’ অবশ্য জিজ্ঞেস করা হয়নি, যে সৌদি আরবকে তারা ইসলামের পূণ্যভূমি মনে করেন, সেখানে করোনা হলো কেন বা মানুষ মরল কেন!)

আবার যেমন—করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে সরকার যখন সব ধরনের জমায়েত বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়, তখন ওই ‘হুজুরের’ বক্তব্য ছিল, এই সরকার ‘ইসলামের শত্রু’, তাই ষড়যন্ত্র করে ইসলামপ্রিয় আল্লাহর বান্দাদের ঘরে আটকে রাখতে চায়, মসজিদ বন্ধ করে দিতে চায়। হুজুরের ভাষ্যে, যারা আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে নামাজ পড়তে মসজিদে আসে, তাদের করোনা হবে না; বরং যারা ঘরে বসে থাকবে, তাদেরই আল্লাহ করোনার শাস্তি দেবে।

এমন হাজারো বিনোদনের সাক্ষি হচ্ছি প্রতিদিন। সর্বশেষ আজ দুপুরে জুমার নামাজশেষে তিনি ব্যাখ্যা করলেন ধর্ষণ কী ও কেন হয়। এ ব্যাপারে ‘হুজুরের’ বক্তব্য একেবারে সোজাসাপটা—তার মতে, ধর্ষণের কারণ হলো ‘মেয়েদের অশ্লীলতা’! ‘হুজুরের’ কথা হলো, মেয়েরা গেঞ্জি আর জিন্স পরে কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে, তাহলে ধর্ষণ তো হবেই!

মেয়েরা গেঞ্জি আর জিন্স পরার মানে ‘অশ্লীলতা’ কীভাবে হলো—এই প্রশ্ন এই ‘হুজুরকে’ করা নিরর্থক। কেবল এই ‘হুজুর’ কেন, যারা মসজিদে বসে এমন বয়ান শুনে চিৎকার করে উঠছে, তাদের কাছেও এই প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যাবে না; তাই এই প্রশ্ন বাদ রাখলাম। তবে যে প্রশ্নের উত্তর দিতে মস্তিষ্কে বেশি ঘিলু থাকা জরুরি নয়, সেই প্রশ্নটি না করে পারছি না : বাংলাদেশেরই অনেক মেয়ে—এই ‘হুজুরদের’ ভাষায় যারা ‘পর্দানশীন’ – তারা তো কোনো ‘অশ্লীলতা’ করছে না, তবু কেন তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে? ‌‘হুজুরের’ ভাষ্যমতে, ইসলামি শরীয়ত মেনে পোশাক পরলে ধর্ষণ হয় না। এখানে তাহলে প্রশ্ন থাকে, যেসব দেশে শতভাগ নারী বাধ্যতামূলকভাবেই ‘পর্দা’ করছে, সেসব দেশে ধর্ষণের মতো ঘটনা কেন ঘটছে? একটি সম্পূরক প্রশ্ন : কোনো মেয়ে ‘অশ্লীল পোশাক’ পরলে তাকে ধর্ষণ করা জায়েজ বা ধর্ষণ করে তাকে শাস্তি দিতে হবে – এই কথা কোথায় লেখা আছে?

একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হলে উল্টো তাকেই বেত্রাঘাত বা পাথর নিক্ষেপে শাস্তি দেওয়া হতো। এমন আইন ছিল, নারীটি যদি ধর্ষণের অভিযোগ আনে, তাহলে তাকে চারজন পুরুষ সাক্ষি হাজির করতে হবে যারা ধর্ষণের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে নারীটির পক্ষে সাক্ষ্য দেবে! নারীর পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার মতো চারজন পুরুষ যদি ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকে, তাহলে কি নারীটি আদৌ ধর্ষণের শিকার হবে? বলাই বাহুল্য, এই আইন কেবল পুরুষকে রক্ষার জন্যেই নয়, এর মধ্যে নারীর প্রতি বিদ্বেষও তীব্রভাবে স্পষ্ট।

বছরখানেক আগে আমার একটি লেখায় আমি ধর্ষণের সঙ্গে পোশাকের প্রশ্ন যে অবান্তর, সে বিষয়ে আলোচনা করেছিলাম। ওই লেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেকে অনেক রকম মন্তব্য করেছেন তখন। দু-একজনের মন্তব্য ছিলো এমন : কলা, আনার – এসব ফল খোসার (পর্দা) ভেতরে ‘ঢাকা থাকে’ বলেই ‘নিরাপদ’ থাকে আর আঙ্গুর-আপেল মানুষ হাতে পেলেই খেয়ে ফেলে! একইসাথে প্রচণ্ডভাবে পুরুষতান্ত্রিক ও নারীবিদ্বেষী এই সমাজে আমাদের বিবেচনাবোধ এতোটা হ্রাস পেয়েছে যে আমরা একজন নারীকে খাদ্যবস্তুর সাথে তুলনা করা যে কতখানি নির্বুদ্ধিতার কাজ, সেটুকু পর্যন্ত বুঝতে পারি না! নারীর শরীরের ওপর পুরুষের নিঃশর্ত অধিকার ও সর্বময় কর্তৃত্বের লিপ্সা থেকে এসব কুযুক্তির প্রচলন ঘটানো হয়েছে। নারী কোনো খাদ্যবস্তু নয় যে তার দায়িত্ব হলো নিজেকে সবসময় আপাদমস্তক এমনভাবে ঢেকে রাখা, যেন কোনো পুরুষ কখনো তার সন্ধান না পায়। নারীকে এমন বাধ্যবাধকতা দেওয়ার মানে কেবল নারীকে বন্দি করে ফেলা নয়, এতে পুরুষের সংযম শক্তির দুর্বলতা এবং তার চরিত্রের অন্তঃসারশূন্যতাও প্রকাশ পায়। নারীকে কেবল ‘মাংসপিণ্ড’ হিসেবে দেখলে আমাদের এই ভ্রান্তি ইহজীবনে দূর হবে না।

ধর্ষণ পোশাকে থাকে না, থাকে পুরুষের মস্তিষ্কে; না হলে চার মাসের শিশু ধর্ষণের শিকার হতো না। চার মাস বয়সী একটি শিশু কীভাবে ‘পর্দা’ করবে? কেন করবে? চার মাসের একটি শিশুও কি ‘অশ্লীলতা’ করার জন্যে ধর্ষিত হয়? যে মেয়েটি রাতে ঘরে ঘুমন্ত অবস্থায় দুর্বৃত্তের হাতে ধর্ষিত হয়, তারও কি দোষ ‘অশ্লীল পোশাক’ পরা? যুদ্ধের সময় সামরিক বাহিনী তাদের প্রতিপক্ষ বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে দিতে প্রতিপক্ষের এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঢুকে নির্বিচারে ধর্ষণ চালায়; ধর্ষণকে তারা একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। এসময় যারা ধর্ষণের শিকার হয়, তাদেরও কি দোষ ‘অশ্লীলতা’?

পোশাক একটি সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ। একেকটা সময়ে একেকটা সমাজে মানুষের চর্চা ও গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে একেক ধরনের পোশাক নির্ধারিত হয়; সেখানে কেবল নারীকে ‘শ্লীল’ বা ‘অশ্লীল’ পোশাক নির্ধারণ করে দেওয়াটা কি বৈষম্য নয়? সমাজের সবার স্বস্তির জন্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবারই মার্জিত ও রুচিশীল পোশাক পরার প্রয়োজন রয়েছে, তবে কেবল নারীর পোশাকের ক্ষেত্রেই এই শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্ন আনা আর ‘অশ্লীলতার’ অভিযোগ এনে ধর্ষণের মতো অপরাধকে জায়েজ বানানোর চেষ্টা করা গোটা সমাজের পক্ষেই অকল্যাণকর। মেয়েরা নিজের ঘরে নিরাপদ নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিরাপদ নয়, কর্মস্থলে এমনকি গণপরিবহনে নিরাপদ নয়। নিজের বাবা-ভাই-শ্বশুর-মামা-দেবর-ভাসুর-চাচা-শিক্ষকসহ সব ধরনের সম্পর্কেই নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে; তাহলে নির্বিচারে কেবল নারীর পোশাককে ধর্ষণের একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার মানসিকতা আসলে পুরুষ হিসেবে নিজের দোষকে আড়াল করার অপচেষ্টারই প্রমাণ দেয়।

আমরা নাটক-সিনেমা বা বাস্তব জীবনেও দেখি, কোনো মেয়ে ধর্ষণের বিচার চাইতে গেলে ধর্ষণের সময় সে কী ধরনের পোশাক পরা ছিলো, রাতে কেন একা বাইরে গিয়েছিলো, ঠোঁটে কেন লাল রঙ্গের লিপস্টিক ছিলো – এ ধরনের অন্যায়-অযৌক্তিক প্রশ্নে তাকে জর্জরিত করা হয় এবং এসব অজুহাতে শেষ পর্যন্ত মেয়েটিকেই দোষী বানানো হয়। সভ্য দেশগুলোতে ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েরা নিজেরাই বিচার চেয়ে আদালতে যায়; ওই সমাজ তাদের এই জায়গাটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে। কিন্তু এশিয়ার অন্য কয়েকটি দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশে এই চিত্র একেবারে উল্টো; ধর্ষণের শিকার হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেয়েটির পরিবার জান-প্রাণ দিয়ে এই ঘটনা ধামা-চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। সমাজ মেয়েটিকেই দোষী করে এবং সমাজের ভয়ে মেয়েটির পরিবারও একই ভূমিকা নেয়; এসব কারণে অসহায় মেয়েটি শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মাধ্যমে নিজের শান্তির পথ খোঁজে।

আমরা বড় গলায় নিজ নিজ ধর্মকে সেরা দাবি করি, শান্তির উপায় বলে দাবি করি। অথচ আমাদের কর্মকাণ্ড একেবারে উল্টো। সবার কথা বলছি না, তবে প্রায়ই আমরা দেখি, সমাজের ধর্মীয় নেতাদের কেউ কেউ প্রচণ্ডভাবে নারীবিদ্বেষী। এটি প্রচলিত প্রায় সব ধর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তারা ধর্মের ভুল বা মনগড়া ব্যাখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য তৈরি করতে চায়। এর ফলে সমাজের একটি অংশ ভুল পথে চালিত হতে শুরু করে। তাই সমাজের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে অনেক বেশি মেধা, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা থাকা দরকার; তাদের স্থিতধী হওয়া দরকার। তা না হলে এমন কপট ‌‘হুজুরদের’ কারণে মানুষ ধর্মের প্রতি আস্থা হারাবে এবং সমাজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী-পুরুষের সমতার কথা পড়ানো হয়। তবে তা কখনোই কাজে আসবে না, যদি ব্যক্তি তার সামাজিকীকরণের সব পর্যায়ে এই একই বার্তা না পায়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় ধর্ম ও ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাই ধর্মীয় নেতাদের কাছে প্রত্যাশা হলো, অযথা পুরুষতান্ত্রিক পক্ষপাতের বশবর্তী হয়ে নারীর প্রতি বিদ্বেষ না ছড়িয়ে সমাজে নারী-পুরুষ পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের বার্তা দিন। একটি সমাজের সব মানুষ একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং সহানুভূতি-সমানুভূতিশীল হতে শিখলে ওই সমাজে কোনো অন্যায়-অনাচার ঘটার সুযোগ থাকবে না।

সমাজটা মানুষের হোক, সুন্দরের হোক; ধর্ষণের নয়, অজ্ঞতার নয়, বিদ্বেষের নয়, কোনো কুৎসিতের নয়।

লেখক : সজীব সরকার : সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারপারসন, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি। প্রতিষ্ঠাতা : মিডিয়াস্কুল ডট এক্সওয়াইজেড।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here