লাভ জিহাদ আইন: ভারতে হিন্দু-মুসলিম প্রেম হুমকিতে

0
126
গুজরাটের আহমেদাবাদে তথাকথিত লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে এক সমাবেশ, ২০১৮

বাংলা খবর ডেস্ক:
প্রতি বছর কম-বেশি এক হাজার দম্পতি – যারা ভিন্ন ধর্মের কাউকে জীবনসঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়েছেন- সাহায্যের জন্য দিল্লিতে একটি বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হন।

প্রধানত হিন্দু-মুসলিম এসব দম্পতি যখন বিয়ে করতে গিয়ে পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হন তখন এরা ধানাক নামে এই এনজিও‘র কাছে সাহায্য চাইতে আসেন।

এসব দম্পতির বয়স সাধারণত ২০ থেকে ৩০ বছর। তারা চান ধানাক যেন তাদের বাবা-মার সাথে কথা বলে তাদের রাজি করায়। এতে ব্যর্থ হলে, আইনি সহযোগিতা চায় তারা।

ধানাকের কাছে যারা আসেন, তাদের ৫২ শতাংশ হিন্দু নারী যারা মুসলিম পুরুষকে বিয়ে করতে চান। আর ৪২ শতাংশ মুসলিম নারী যারা হিন্দু প্রেমিককে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

“হিন্দু পরিবার বলুন আর মুসলিম পরিবারই বলুন তারা কেউই চায় না তাদের সন্তানরা অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করুক,“ বিবিসিকে বলেন ধানাকের প্রতিষ্ঠাতা আসিফ ইকবাল। “বিয়ে ঠেকাতে পরিবারগুলো যে কোনো পন্থা নিতে প্রস্তুত। তারা এমনকি তাদের নিজেদের মেয়ের দুর্নাম ছড়াতেও পেছপা হয় না, যাতে মেয়ের প্রেমিক পিছিয়ে যায়। তথাকথিত এই লাভ-জিহাদ এই ধরণের আন্তঃ-ধর্ম প্রেম আটকানোর আরেক চেষ্টা।“

কট্টর হিন্দু দলগুলো বেশ অনেকদিন ধরে এই লাভ-জিহাদ তত্ত্ব ছড়িয়ে বলছে মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার উদ্দেশ্যে প্রেমের ছল দেখিয়ে তাদের বিয়ে করে।

এই তত্ত্ব এখন সত্যিকার অর্থেই ভারতের ভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যে প্রেম চরম হুমকিতে ফেলেছে।

গত সপ্তাহে, উত্তর প্রদেশ রাজ্যের পুলিশ হিন্দু এক নারীকে ধর্মান্তর করার চেষ্টার অভিযোগে এক মুসলিম যুবককে আটক করে। ‘লাভ-জিহাদ‘ অর্থাৎ ধর্মান্তর বন্ধে ঐ রাজ্যে নতুন যে আইন হয়েছে তার আওতায় এটাই ছিল প্রথম গ্রেপ্তার। হিন্দু-জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি শাসিত আরো অন্তত চারটি রাজ্য এই আইন তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে।বিজেপির নেতারা বলছেন “প্রতারণা“ বন্ধে এই আইন দরকার।

টার্গেট মুসলিম পুরুষ

“যখন কোনো মুসলিম নারী হিন্দু কোনো পুরুষকে বিয়ে করে তখন হিন্দু এই গোষ্ঠীগুলো তাকে দেখায় প্রেম হিসাবে। যখন তার উল্টোটা ঘটে তখন সেটা হয়ে যায় প্রতারণা-জবরদস্তি,“ বলছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক চারু গুপ্তা যিনি গবেষণা করে ‘মিথ অব লাভ জিহাদ‘ নামে একটি বই লিখেছেন।


ভারতে ধর্মীয় বিদ্বেষের বিরুদ্ধে দিল্লিতে মুসলিম নারীদের একটি সমাবেশ

ভারতের বিরাট অংশে প্রেম এখনও বিপজ্জনক। পিতৃতান্ত্রিকতার জগদ্দল পাথর, বৃহত্তর পরিবার, ধর্ম, জাত এবং পারিবারিক সম্মানের মত বিষয় নারী পুরুষের প্রেম-প্রণয়কে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। তারপরও এখনও গ্রাম বা ছোটো শহরেও অনেক সাহসী নারী পুরুষ শত শত বছরের এসব সামাজিক-পারিবারিক বাধা অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করে। মোবাইল ফোন, সস্তা মোবাইল ডেটা এবং সোশাল মিডিয়ার সুযোগ নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে নারী পুরুষরা বেশি করে এক অন্যের কাছে আসছে, প্রেমে পড়ছে।

লেখক অরুন্ধতী রয় তার বুকার পুরস্কার বিজয়ী ‘গড অব স্মল থিংস‘ বইতে যে লাভ-ল‘র (প্রেমের আইন) কথা বলেছিলেন – অর্থাৎ কাকে ভালোবাসা যাবে, কীভাবে যাবে এবং কতটা যাবে তার সামাজিক রীতি-মানদণ্ড – তা ভাঙ্গার চেষ্টা করে এসব বিদ্রোহী নারী-পুরুষ।

ভারতে নারী-পুরুষের বিয়ে, পরিবারের ঠিক করা বিয়ে, একই ধর্ম-সম্প্রদায় এবং একই জাতের বিয়ের জয়-জয়াকার। এখনও ৯০ শতাংশেরও বেশি বিয়ের পাত্র-পাত্র ঠিক করে পরিবার।

ভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষের মধ্যে বিয়ের ঘটনা বিরল। এক সমীক্ষা বলছে এরকম বিয়ের সংখ্যা মোট বিয়ের দুই শতাংশ।

লাভ-জিহাদ তত্ত্বের ইতিহাস

অনেকে বিশ্বাস করেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলো রাজনৈতিক ফায়দা লাভের উদ্দেশ্যে সময়ে সময়ে এই লাভ-জিহাদের ধুয়ো তোলে। ভারতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিয়ের বিরোধিতার ইতিহাস বহু পুরনো। এ নিয়ে ঐতিহাসিক নানা তথ্য প্রমাণ রয়েছে।

১৯২০ এবং ১৯৩০ এর দশকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উত্তর ভারতের কোথা কোথাও হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের দ্বারা হিন্দু নারী “অপহরণের“ এক প্রচারণা শুরু করেছিল। মুসলিম পুরুষের বিয়ে করা হিন্দু স্ত্রীদের উদ্ধারের দাবি তোলা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশে সে সময় মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ বন্ধে হিন্দু একটি সংগঠন তৈরি হয়েছিল।

১৯২৪ সালে কানপুর শহরে একজন মুসলিম সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক হিন্দু নারীকে “অপহরণ এবং জোর করে ধর্মান্তর“ করার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। ঐ কর্মকর্তার বাড়ি থেকে ঐ নারীকে “উদ্ধারের“ দাবি উঠেছিল।

ইংরেজ শাসনামলেও হিন্দু নারীদের অপহরণ নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক হয়েছে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, যারা এখন প্রধান বিরোধী দল, তারা একটি প্রস্তাব পাশ করেছিল যাতে বলা ছিল – “যে সব নারীদের অপহরণ করে জোর করে বিয়ে করা হয়েছে তাদেরকে বাড়িয়ে ফিরিয়ে আনতে হবে। দলবদ্ধ ধর্মান্তরকরণ অবৈধ এবং মানুষকে তার নিজের পছন্দের জীবনে ফিরে আসার সুযোগ দিতে হবে।“

১৯৪৭ সালে যখন ভারত ভাগের সময় ১০ লাখ মানুষ মারা গিয়েছি। দেড় কোটি মানুষকে ঘরবাড়ি ছাড়িতে হয়েছিল কারণ বহু মুসলিম পাকিস্তানে চলে যায়, অন্যদিকে হিন্দু এবং শিখরা ভারতে চলে আসে। দেশভাগের সময় সেই সহিংসতার প্রধান বলি হতে হয়েছিল নারীদের। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ আরো গভীর হয়।

লাভ জিহাদ ও রাজনীতি
সাম্প্রতিক সময়ে যে কোনো নির্বাচনের আগে কট্টর হিন্দু গোষ্ঠীগুলো লাভ-জিহাদের ধুয়ো তুলে ভোটার মেরুকরণের চেষ্টা করছে। ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশে রাজ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময় নগ্নভাবে এটি করা হয়েছে।


ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম এক যুবককে বিয়ে করায় কারাগারে যেতে হয়েছিল হাদিয়া জাহানকে। ২০১৮ সালে একটি আদালত তাকে মুক্তি দিয়ে স্বামীর সাথে থাকার অনুমতি

অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, হিন্দু গোষ্ঠীগুলো পোস্টার, গুজব, কানকথা ব্যবহার করে “মুসলিম পুরুষদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ, ধর্মান্তর, ধর্ষণ, জবরদস্তি করে বিয়ে“ ঠেকানোর “সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা“ শুরু করেছে।

কট্টর হিন্দু সংগঠন আরএসএস, যাদেরকে বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক বলে মনে করা হয় – তারা তাদের মুখপাত্র সাময়িকীতে “লাভ জিহাদের“ নানা কাহিনী প্রচার করেছে। “লাভ ফর এভার, লাভ জিহাদ নেভার“ (ভালবাসা চলবে কিন্তু লাভ জিহাদ কখনই চলবে না) স্লোগান তুলতে অনুসারীদের উৎসাহিত করেছে।

শুধু যে মুসলিম পুরুষদের মোটা দাগে একই ব্রাকেটে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে তাই নয়। সেইসাথে হিন্দু নারীদের লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তর করার “আন্তর্জাতিক ইসলামি চক্রান্ত“ তুলে ধরা হচ্ছে। এমন প্রচারণাও চালানো হচ্ছে যে বিদেশ থেকে মুসলিম যুবকদের টাকা পাঠানো হচ্ছে যাতে তারা সুন্দর পোশাক পরে, দামি গাড়ি কিনে এবং উপহার দিয়ে হিন্দু নারীদের আকৃষ্ট করতে পারে।

উত্তর প্রদেশে বিজেপির একজন মুখপাত্র বলেন, “গ্লোবাল জিহাদের অংশ হিসাবে দুর্বল অসহায় হিন্দু মেয়েদের টার্গেট করা হচ্ছে।”

অধ্যাপক গুপ্তা বলেন, “নারীদের নামে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পেছনে মানুষ জড়ো করার চেষ্টা চলছে।“

গবেষক এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন লাভ-জিহাদ নিয়ে অতীতে এবং বর্তমানের প্রচারণার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে বর্তমানে যে প্রচারণা তা অনেক শক্তিশালী কারণ এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

“স্বাধীনতার আগে এসব প্রচারণা শুধু সংবাদপত্রের ভেতরের পাতাতেই সীমিত থাকতো। মূলধারার রাজনৈতিক কোনো দল বা নেতা এসব গুজব কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন না। এখন এসব গুজব এবং প্রচারণা মিডিয়ার প্রথম পাতার খবর এবং রাষ্ট্র এসব আইন তৈরি এবং প্রয়োগের প্রধান উদ্যোক্তা,“ বলছিলেন অধ্যাপক গুপ্তা।

অনেকে বলেন অনেক সময় দম্পতিরা ধর্মীয় বিয়ের পথ নেয় কারণ তারা ভারতের স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট এড়াতে চায়। এই বিশেষ আইনে ভিন্ন ধর্মের নারী পুরুষের বিয়ের অনুমোদন থাকলেও বিয়ের আগে সরকারি কর্তৃপক্ষকে এক মাসের নোটিস দিতে হয় যেখানে দম্পতিদের নাম ঠিকানা থাকে। ফলে এই দম্পতিরা ভয় পায় যে পরিবার জেনে গিয়ে বিয়ে আটকে দেবে।

শুধু ভিন্ন ধর্মের বলে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে তাদের জীবন সঙ্গী পছন্দের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ভয়ের একটি সংস্কৃতি তৈরি করা হচ্ছে যেখানে বাবা-মা বা সরকারি কর্তৃপক্ষকে এই অধিকার হরণের আইনি অধিকার দেওয়া হচ্ছে।

অন্যদিকে, এটাও সত্যি যে ভারতে এখন অধিক সংখ্যায় নারী-পুরুষ জাত ধর্ম অস্বীকার করে প্রেমের সম্পর্কে জড়াচ্ছে এবং পরিবারকে ত্যাগ করছে। এদের অনেকেই সরকারেরই তৈরি সেফ-হাউজে আশ্রয় নিচ্ছে।

ধানাকের প্রতিষ্ঠাতা আসিফ ইকবালের কথায় “ভারতে প্রেম ভালবাসা খুবই জটিল এবং কঠিন ব্যাপার। “

সূত্র: বিবিসি বাংলা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here