বাংলা খবর ডেস্ক:
গাজায় ‘গণহত্যা’ চালাচ্ছে ইসরাইল। এর প্রতিবাদে আম্মান এবং বাগদাদ থেকে লন্ডন এবং বার্লিনে মানবতার পক্ষের হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। নির্বিচারে গাজায় যখন হত্যালীলা, ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার তখন এসব মানুষ রাজপথে তাদের ক্ষোভের আগুন ঝরালেন। বিক্ষোভ হয়েছে দোহা, লন্ডন, প্যারিস, মাদ্রিদসহ বিশ্বের বড় বড় শহরে। শনিবার গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে নৃশংস হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। সেখানে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া আল জাজিরা, বার্তা সংস্থা এপির কার্যালয় হিসেবে পরিচিত আল জালা ভবনকে মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরাইল। এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে ফিলিস্তিনি, বিশেষ করে গাজার হামাসদের।
তাদের অপরাধ রকেট হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। ঘটনা সত্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিধর ডেমোক্রেট, ভারমন্টের সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে, তার কোনো উত্তর খোঁজেন না কেউই। বার্নি স্যান্ডার্স প্রশ্ন তুলেছেন, হামাস কেন রকেট হামলা করে? নিজেদের ভূখণ্ড থেকে তাদেরকে ১৯৬৭ সালে উচ্ছেদ করে তা দখল করেছে ইসরাইলের ইহুদিরা। সেই ভূমির দাবিতে হামাস বা ফিলিস্তিন আন্দোলন করে আসছে। কিন্তু এই চরম সত্যের কাছে কেউই ফিরে যান না।
চরম মাত্রায় অসম শক্তি প্রয়োগের কারণে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে ইরাকের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তাদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনি পতাকা। প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা মুকতাদার আল সদরের আহ্বানে ইরাকের ৫টি প্রদেশেই এই বিক্ষোভ হয়েছে শনিবার। রাজধানী বাগদাদ, দক্ষিণের প্রদেশ ব্যাবিলন, ধি কার, দিওয়ানিয়ে এবং বসরায় বিক্ষোভ হয়েছে।
কাতার: বিক্ষোভ হয়েছে কাতারের রাজধানী দোহা’য়। সেখানে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনি পতাকা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এমন ব্যানার প্রদর্শন করেন তারা। দোহা’য় বসবাস করেন ফিলিস্তিনি রীম আলগোউল। তিনি আল জাজিরাকে বলেছেন, আমার দেশে ইসরাইলি বাহিনী যে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। দেশকে স্বাধীন করতে যা যা করার আমরা তাই করবো। যেহেতু আমরা এই মুহূর্তে দেশে নেই, তাই এখানে এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছি। ফিলিস্তিনে যা ঘটছে তাতে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত। এদিন দোহা’য় ইমাম মুহাম্মদ আবদেল ওয়াহাব মসজিদে সমবেত হন হাজার হাজার মানুষ।
ফ্রান্স: ৪২০০ কর্মকর্তাকে দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনি গড়ে তোলার পরও প্যারিসের উত্তরে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক শত মানুষ। এ সময় তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করতে পুুলিশ কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ব্যবহার করেছে। সেখানে কর্তৃপক্ষের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ করার কারণে পুলিশ এই ব্যবস্থা নেয়। প্যারিস কর্তৃপক্ষের আতঙ্ক এই সহিংসতা আরো বড় রূপ নিতে পারে। তবে বিক্ষুব্ধ জনতা বেশ কিছু গার্বেজ বিন বা ময়লা ফেলার ভাগাড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। পুলিশের প্রতি ইটপাটকেল ছুড়েছে। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেখানে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
স্পেন: মাদ্রিদে প্রায় আড়াই হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেছেন। তাদের বেশির ভাগই যুব শ্রেণির। ফিলিস্তিনি পতাকায় নিজেদের মুড়ে নিয়ে বিক্ষোভ করেছেন মাদ্রিদের পুয়ের্তা ডেল সোল প্লাজার সামনে। এ সময় তারা সমস্বরে গাজায় ইসরাইলের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেন। তারা একসুরে বলেন, এটা কোনো যুদ্ধ নয়। এটা হলো গণহত্যা। তারা আমাদেরকে গণহারে হত্যা করছে। ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত ৩৭ বছর বয়সী আমিরা শেখ আলি বিক্ষোভে অংশ নিয়ে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
লেবানন: লেবানন-ইসরাইল সীমান্ত বরাবর কয়েক শত লেবাননি এবং ফিলিস্তিনি বিক্ষোভ করেছেন। কেউ কেউ এ সময় সীমান্ত দেয়াল বেয়ে উঠে যান উপরে। এর ফলে ইসরাইল কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতি গুলি ছুড়েছে। এতে আহত হয়েছেন একজন। শনিবার লেবাননের সীমান্তবর্তী গ্রাম ওদাইশেহ’তে বিক্ষোভকালে সীমান্ত দেয়ালের ওপর দিয়ে কিছু বিক্ষোভকারী ইসরাইলের দিকে হাতবোমা ও পাথর নিক্ষোপ করেছে। বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনি এবং লেবাননের পতাকা। এ ছাড়া তাদের কারো কারো কাছে ছিল যোদ্ধা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর হলুদ ব্যানার।
কাশ্মীর: ভারত শাসিত কাশ্মীরে বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় সেখানে দমনপীড়ন চালিয়েছে পুলিশ। তারা আটক করেছে কমপক্ষে ২০ জনকে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর প্রধান শহর শ্রীনগরের রাস্তায় বেশ কিছু মানুষ ফিলিস্তিনি পতাকা নিয়ে বিক্ষোভ করেন। এ সময় তারা ফিলিস্তিনপন্থি এবং ইসরাইল বিরোধী স্লোগান দেন। এতে যোগ দিয়েছিলেন ২৫ বছর বয়সী এক যুবক। তিনি বলেছেন, গাজায় যখন শিশুদের হত্যা করছে ইসরাইল তখন আমরা কিভাবে নীরব থাকতে পারি। পৃথিবীর প্রতিটি মানবসন্তানের উচিত তাদের পক্ষে দাঁড়ানো। এটা মানবতা এবং সংহতির প্রশ্ন।
বৃটেন: ‘স্টপ বোম্বিং গাজা’ বা গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করো প্লাকার্ড নিয়ে লন্ডনে বিক্ষোভ করেছেন কয়েক হাজার মানুষ। এ সময় তারা ফিলিস্তিন স্বাধীন করো স্লোগানে মার্বেল আর্চে সমবেত হন এবং ইসরাইল দূতাবাসের দিকে অগ্রসর হন। উল্লেখ্য, কেনসিংটন হাই স্ট্রিটে ইসরাইলের দূতাবাস অবস্থিত। বিক্ষুব্ধ জনতা তার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। আয়োজকরা দাবি করেন এতে যোগ দিয়েছিলেন এক লাখ মানুষ।
জার্মানি: সামিদুন প্যালেস্টাইনিয়ান প্রিজনার সলিডারিটি নেটওয়ার্কের ডাকে জার্মানির বার্লিনসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করেছেন হাজার হাজার মানুষ। বার্লিনের নুকোন শহরে তিনটি বিক্ষোভের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এই অঞ্চলটিতে বসবাস করেন বিপুল সংখ্যক তুর্কি এবং আরব বংশোদ্ভূত। বিক্ষোভ থেকে স্লোগান দেয়া হয়েছে ‘ইসরাইলকে বর্জন কর’। এ সময় পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছুড়েছে তারা। পুলিশও গ্রেপ্তার করেছে বেশ কিছু মানুষকে। বিক্ষোভ হয়েছে ফ্রাঙ্কফুর্ট, লিপজিগ এবং হামবুর্গে।
ইসরাইলের উন্মত্ত হামলায় মাটির সঙ্গে মিশে গেছে আল জাজিরা, এপির অফিস:
উন্মত্ত এক যুদ্ধের নেশায় মেতেছে ইসরাইল। কোনো বাছবিচার নেই। উন্মত্তের মতো বেপরোয়াভাবে হামলা চালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছে মুসলিমদের বাসভূমি গাজা। সেখানে রক্ষা পাচ্ছে না আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোও। এরই মধ্যে তারা আকাশচুম্বী একটি ভবনে হামলা চালিয়েছে। সেখানে আল জাজিরা, এপি সহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের অফিস ছিল। আল জালা নামের ওই ভবনটিতে বোমা হামলা চালিয়ে তা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরাইলিরা। এ থেকে স্পষ্ট ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কোনো কিছুর পরোয়া না করে যথেচ্ছ বোমা হামলা চালাচ্ছেন।
তিনি যখন এই উল্লাসে মেতে উঠেছেন তখন আন্তর্জাতিক দুনিয়া থেকে জোরালো কোন প্রতিবাদ নেই। উল্টো বলা হচ্ছে ‘ইসরাইলেরও আত্মরক্ষার অধিকার আছে’। নেতানিয়াহুকে আস্কারা দেয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। কংগ্রেসে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য, ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত রাশিদা তৈয়ব মার্কিন প্রশাসনের তুখোড় সমালোচনা করেছেন। কোনো কিছুর পরোয়া না করে নেতানিয়াহু যখন হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞে মেতেছেন, তখন বিশ্ববিবেক নিশ্চুপ। যা-ও বা দু’চারজন বিশ্বনেতা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তা-ও জোরালো নয়। আজ শনিবারও গাজায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বোমা হামলা চালিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। আজও কমপক্ষে ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আটটি শিশু ও দু’জন নারী। সব মিলে গাজায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ১৪০। এ অবস্থার মধ্যে ইসরাইলের দখলদারিত্ব এবং গাজায় বোমা হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে পশ্চিমতীরে সমবেত হয়েছিলেন ফিলিস্তিনিরা। নাকবা বা বিপর্যয়কে চিহ্নিত করে সারাবিশ্বে হয়েছে সংহতি র্যালি। ইসরাইলে জায়নবাদী জঙ্গিরা কমপক্ষে সাত লাখ ৫০ হাজার জাতিগত ফিলিস্তিনিকে উচ্ছেদ করে প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসরাইল রাষ্ট্র। সেই দিনটিকে নাকবা দিবস বা দ্য ক্যাটাস্ট্রফ হিসেবে পালন করা হয়। গাজায় ইসরাইলের সহিংসতা বৃদ্ধির ফলে সেখানে মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন জাতিসংঘ পরিচালিত স্কুলগুলোতে। জাতিসংঘের হিসাবে প্রায় ১০ হাজার ফিলিস্তিনি ইসরাইলের নৃশংসতা থেকে রক্ষা পেতে ঘরবাড়ি ছেড়েছেন। ওদিকে আজ আল জাজিরা, এপির অফিস গুঁড়িয়ে দেয়ার কড়া নিন্দা জানিয়েছেন এথিক্যাল জার্নালিজম নেটওয়ার্ক। আইদান হোয়াইট বলেছেন, মিডিয়া ভবন ধ্বংস করে দেয়া সবচেয়ে নিন্দনীয় এবং সবচেয়ে বেপরোয়াপনার সর্বনিম্ন স্তরের কাজ। তিনি বলেন, বেসামরিক জনজীবনের ওপর হুমকি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যুদ্ধক্ষেত্রে সাংবাদিকরা এবং মিডিয়া যে কি ভয়াবহতার মুখোমুখি তা আর একবার প্রকাশ পেয়েছে এ ঘটনায়। এ ঘটনায় আমার মনে হয়েছে এই ধ্বংসলীলা চালানো হয়েছে মিডিয়াকে স্তব্ধ করে দিতে এবং সমালোচনার কণ্ঠকে রুদ্ধ করতে। গাজায় কোনো স্থানই এখন আর নিরাপদ নয় বলে জানিয়েছেন গাজার সাংবাদিক ইউমনা আল সাঈদ। তিনি গাজা সিটির আল শিফা হাসপাতাল থেকে রিপোর্ট দিচ্ছিলেন। বলেছেন, এখন রিপোর্ট করার জন্য একমাত্র স্থান হলো হাসপাতাল। আমাদের জানামতে, এটাই নিরাপদ স্থান। শিফা এর আগে টার্গেট করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও গাজায় আমরা এটাকেই নিরাপদ স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছি। এখান থেকেই খবর সম্প্রচার করছি। আল জালা ভবনকে টার্গেট করার আগেই আমরা সেখান থেকে সবকিছু সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। ওই ভবনটির মালিক সবাইকে নিরাপদে সরে যেতে মাত্র এক ঘন্টা সময় দিয়েছিলেন। এ সময়ে ইসরাইলিরা তাকে বার বার ফোন করছিল। জবাবে তিনি তাদেরকে বলেছেন, আর ৩০ মিনিট সময় দিতে, যাতে স্টাফগুলো ভবনটি থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু আর সময় দেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ইসরাইলি সেনা মুখপাত্র। তারা সাফ জানিয়ে দেয় মাত্র এক ঘন্টার মধ্যে হামলা চালাবে তারা। এ সময়ে আর কেউ যাতে ওই ভবনের ভিতরে প্রবেশ না করেন। গাজায় এই ধ্বংসলীলা ভয়াবহ। ওই ভবন থেকে কয়েক শত পরিবারকে উদ্ধার করা হয়েছে। আল জাজিরার পাশাপাশি আল জালা ভবনে অফিস ছিল বার্তা সংস্থা এপির। এর প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা গ্যারি প্রুইত ইসরাইলের এই হামলায় হতাশা এবং ভীতি প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, অবিশ্বাস্যরকম হতাশাজনক হামলা এটা।