ইসি থেকে সরলে এনআইডি হবে রাজনৈতিক হাতিয়ার

0
72

বাংলা খবর ডেস্ক,ঢাকা
জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধন কার্যক্রম নির্বাচন কমিশন থেকে সরিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে দেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তা নির্বাচন কমিশনের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। তাঁরা বলছেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে দেশ-বিদেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এটি রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে নির্বাচনব্যবস্থা আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।

গতকাল রবিবার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) আয়োজনে ‘সরকার কর্তৃক জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার উদ্যোগ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক নাগরিক সংলাপে এসব বক্তব্য এসেছে।

সকাল ১১টায় ভার্চুয়ালি শুরু হওয়া এই সংলাপে সভাপতিত্ব করেন সুজনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বিচারপতি এম এ মতিন। এতে অংশ নেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম, বিশিষ্ট সাংবাদিক সোহরাব হাসান ও আবু সাঈদ খান, সুজনের কোষাধ্যক্ষ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রাজনীতিবিদ রাজেকুজ্জামান রতন ও রুহিন হোসেন প্রিন্স, সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন প্রমুখ। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজন সমপাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। সংলাপে ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করে শোনান সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

জাতীয় পরিচয়পত্র প্রণয়ন শুরুর সময় নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দায়িত্ব পালনকারী ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘ভোটার তালিকার সঙ্গে যুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে অর্পণ করা হলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ইসির একটি বৃহৎ অংশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত হবে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা খর্ব হবে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এটি নিয়ে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অন্যদিকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ব্যবহারে জটিলতা সৃষ্টি হবে।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব কমিশনের। বিদ্যমান আইনে এর ভাগীদার অন্য কোনো সংস্থাকে করা যাবে না। আইন অনুযায়ী নির্বাচনকালে কমিশন আসনভিত্তিক প্রতিযোগী প্রার্থীদের ওই আসনের ভোটার তালিকা প্রদান করে মাত্র। সম্পূর্ণ ভোটার তালিকা দলকেও দেওয়া হয় না। কাজেই অন্য কোনো সংস্থাকে ভোটার তালিকা সরবরাহ সংবিধানসম্মত হবে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্র কার্যকর করলে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে। কাজেই সরকারকে এ বিষয়ে আরো বিশদভাবে ভাবতে এবং অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। আমার মতে, কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে চাইলে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠন করে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে অবকাঠামো তৈরি করে এটি করা উচিত।’

শাহদীন মালিক বলেন, ‘বেশ কয়েক দিন ধরে বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানানো হয়নি কী উদ্দেশ্যে এটি করা হচ্ছে। কমিশনের হাতে থাকলে কী অসুবিধা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে গেলে কী সুবিধা, তা-ও জানানো হয়নি। এটি পরবর্তী নির্বাচনের নতুন তরিকার পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনকে সরকার নির্বাহী অনুবিভাগ মনে করে। দেশের মানুষও সরকারের কাছে নাগরিক নয়, প্রজা। সরকার যে জবাবদিহির ধার ধারে না, এটি তার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। একই সঙ্গে এটি কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাকে আরো চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ বলে মনে হয়।’

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোটার ডাটাবেইস যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যায়, সরকার বিভিন্ন রকম কারসাজির মাধ্যমে কাউকে ভোটার করতে পারে এবং কাউকে বাদ দিতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের একটা সুযোগ থেকে যায়, দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা আমাদের গর্বের ধন, এটিতে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। আর সরকার করতে চাইলে জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করতে পারে।’

আবু সাঈদ খান বলেন, ‘একটি দেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন প্রতিষ্ঠান দিয়ে কী দায়িত্ব পালন করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোনো কাজে সফলতা দেখায়, সেটিও ধরে রাখা উচিত। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির মতো একটি সফল প্রকল্প, যেটি দেশ-বিদেশে সমাদৃত, সেটিও আমাদের ধরে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি।’

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার, তা কিভাবে ব্যবহৃত হয় তা তো দেখছি এখন আরো ব্যাপক হবে। নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সরকার কি মনে করে না? পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে পুলিশি হয়রানি ও আর্থিক বাণিজ্য বাড়বে। ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের নাগরিক কার্ড দেওয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া দরকার। নতুন প্রকল্পের নামে খরচের নতুন খাত সৃষ্টি করা হবে।’

সোহরাব হাসান বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনটা কোথায় এখন সেই প্রশ্ন থেকে যায়। তিন বছর ধরে আমরা দেখছি সরকার কমিশনকে অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের বেশি কিছু মনে করে না। কমিশনকে আগে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে হতে হবে, তারপর না হয় তার অধিকার।’

আসিফ নজরুল বলেন, ‘কমিশনের বোঝা উচিত তারা নিজেদের কোথায় নামিয়েছে। সরকারের জন্য তারা একের পর এক অন্যায় করেছে। কাজেই তারা কতটা মর্যাদাহীন, সেটা যেন তারা একটু অনুধাবন করে। কমিশনের ওপর আমাদের আস্থা নেই এটা ঠিক, কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে গেলে আরো শঙ্কাজনক ও বিপজ্জনক হবে। কারণ কমিশন তো নিজে সরাসরি জনগণকে নিপীড়ন করেনি, গত নির্বাচনে এজেন্টদের, ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়নি। এই কাজগুলো করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ। তাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ চলে গেলে আমাদের জন্য অনেক ভীতিকর। প্রধান নির্বাচন কমিশনের প্রতি বলতে চাই, আপনাদের যে কিছু মেরুদণ্ড আছে এই ইস্যুতে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।’

শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, জাতীয় নিবন্ধন কমিশন নামে একটি নতুন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এই দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

এম এ মতিন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছে না। নির্বাচন কমিশনের এখন যে ক্ষমতা, সেটা সাংবিধানিক ক্ষমতা আর আইন করে সেই ক্ষমতা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিলে সেটা সাব-অর্ডিনেট হয়ে যাবে। বড় ক্ষমতা থাকতে ছোট ক্ষমতায় যাব কেন, সেটাও একটা বিষয়।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here