সঙ্গীসহ মেজর জিয়ার সন্ধানে ৪২ কোটি টাকার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের

0
84

বাংলা খবর ডেস্ক:
বাংলাদেশি বিজ্ঞান লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যায় দণ্ডিত পলাতক মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ জিয়াউল হক, আকরাম হোসেনসহ হামলার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের সন্ত্রাসবিরোধী পুরস্কার কর্মসূচি রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস গতকাল সোমবার মেজর জিয়া ও আকরামের সন্ধান চেয়ে ৫০ লাখ মার্কিন ডলার (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা হিসাব ধরে ৪২ কোটি ৫০ লাখ টাকা) পুরস্কার ঘোষণা করেছে।

রিওয়ার্ড ফর জাস্টিসের ঘোষণার প্রায় দুই ঘণ্টা পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্রের কার্যালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এরই মধ্যে অভিজিৎ হত্যাকারীদের তথ্যদাতাদের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করেছেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগ তার ‘রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিসের’ মাধ্যমে এরই মধ্যে তথ্য আহ্বান করেছে।

অভিজিৎ হত্যার দায়ে জিয়া ও আকরামকে খুঁজছে বাংলাদেশও। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গত ১৬ ফেব্রুয়ারি অভিজিৎ হত্যার দায়ে মেজর (চাকরিচ্যুত) সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক ওরফে জিয়া, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (সাংগঠনিক নাম শাহরিয়ার), আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আকরাম হোসেন ওরফে আবির ও মো. আরাফাত রহমানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন শফিউর রহমান ফারাবিকে। এঁরা আনসার আল ইসলামের সদস্য। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে।

পলাতক জিয়া ও আকরামকে এখনো ধরতে পারেনি বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে দণ্ড পাওয়া অন্য আসামিরা কারাগারে আছেন।

তবে রিওয়ার্ড ফর জাস্টিসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, জঙ্গিগোষ্ঠী ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার (একিউআইএস) এক নেতা বলেছেন, হামলাকারীরা ধরা পড়েননি। অভিজিতের ওপর হামলাকারীরা এখনো বাংলাদেশে আছেন বলেই বিশ্বাস করা হয়—এমন তথ্যও রয়েছে মার্কিন বিজ্ঞপ্তিতে। বাংলাদেশের পুলিশও মেজর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে পারলে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা করেছে।

তদন্ত চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; সন্দেহে এবিটি, একিউআইএস : বাংলাদেশ অভিজিৎ হত্যার বিচার করলেও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, অভিজিৎ হত্যার তদন্ত এখনো চলছে। গত রাতে পররাষ্ট্র দপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার হোতাদের বিচারের আওতায় আনতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য সহায়ক হবে এমন তথ্য আমরা খুঁজছি।’

পররাষ্ট্র দপ্তর আরো জানায়, দুটি গোষ্ঠী ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। আল-কায়েদায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশভিত্তিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) প্রথমে ওই হামলার দায় স্বীকার করে। এর পরপরই একিউআইএস নেতা অসীম ওমর দাবি করেন, একিউআইএস অনুসারীরাই অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদের ওপর হামলা করেছে।

বাংলাদেশে ট্রাইব্যুনালের রায়ে আনসার আল ইসলাম সদস্যদের সাজা : ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমান গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, বাংলা একাডেমির বইমেলায় বিজ্ঞানমনস্ক লেখকদের আড্ডায় অংশ নিয়ে ফেরার পথে অভিজিৎ ও তাঁর স্ত্রী বন্যা আক্রমণের শিকার হন। নাস্তিকতার অভিযোগ এনে নিষিদ্ধ সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্যরা অর্থাৎ এই মামলার অভিযুক্তরাসহ মূল হামলাকারীরা সাংগঠনিকভাবে অভিজিৎ রায়কে নৃশংসভাবে হত্যা করে। স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশের জন্য অভিজিৎ রায়কে নিজের জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হয়। অভিজিৎ রায়কে হত্যার উদ্দেশ্য ছিল জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ এবং নিরুৎসাহ করা, যাতে ভবিষ্যতে কেউ স্বাধীনভাবে লেখালেখি ও মত প্রকাশ না করতে পারে।

যা বলছে রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস :
রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস তার ফেসবুক ও টুইটার পেজে অভিজিৎ হত্যার দুই পরিকল্পনাকারীর সন্ধান ও পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে গতকাল পোস্টারও প্রকাশ করেছে। ওই পোস্টারে হামলার শিকার অভিজিৎ ও বন্যার ছবি ব্যবহার করা হয়েছে।

তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী আমেরিকান নাগরিক অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদ ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বইমেলার জন্য ঢাকা সফরকালে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের চাপাতি হামলার শিকার হন। ওই ঘটনায় অভিজিৎ নিহত ও বন্যা গুরুতর আহত হন।

রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস বলেছে, লেখক, ব্লগার ও কর্মী হিসেবে অভিজিৎ মত প্রকাশের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে বাংলাদেশে মৌলবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। বাংলাদেশে ব্লগারদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিবাদ কর্মসূচি সমন্বয় করেছিলেন। এ ছাড়া সামাজিক নিপীড়নের বিষয়ে সমালোচক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন।

রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস বলেছে, অভিজিৎ রায় তাঁর বিশ্বাস ও কাজের জন্য হামলার শিকার ও নিহত হন। বাংলাদেশি জঙ্গিগোষ্ঠী আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল। কাউকে ইসলামবিরোধী মনে করলে তাকে হত্যা করতে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে এবিটি। সংগঠনটিকে বাংলাদেশ সরকারও নিষিদ্ধ করেছে।

রিওয়ার্ড ফর জাস্টিসের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর অভিবাসন ও নাগরিকত্ব আইনের ২১৯ ধারা অনুযায়ী একিউআইএসকে বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। এর আগে ওই বছরের ৩০ জুন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর ১৩২২৪ নম্বর নির্বাহী আদেশের আলোকে একিউআইএসকে ‘বিশেষভাবে চিহ্নিত বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ ঘোষণা করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অধীন এলাকায় একিউআইএসের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের একিউআইএসের সঙ্গে যোগাযোগ ও লেনদেন নিষিদ্ধ। একিউআইএসকে জ্ঞাতসারে সহযোগিতা করাও যুক্তরাষ্ট্রে অপরাধ।

রিওয়ার্ড ফর জাস্টিসের প্রকাশিত পোস্টারে জিয়া, আকরাম হোসেন বা হামলার সঙ্গে জড়িত অন্য কারো সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকলে, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তা পাঠাতে বলা হয়েছে। এ জন্য দেওয়া ফোন নম্বর +১-২০২-৭০২-৭৮৪৩ এবং টুইটার হ্যান্ডেল — @RFJ_USA।

পোস্টারের নিচে বাঁ দিকের কোনায় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাম ও প্রতীক, কূটনৈতিক নিরাপত্তা বিভাগ ও রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিসের নাম রয়েছে।

রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস হচ্ছে সন্ত্রাস দমনের কাজে ভূমিকার জন্য পুরস্কার দেওয়ার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র দপ্তরের একটি কর্মসূচি। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা সম্পত্তির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিহত করা। এ কর্মসূচির অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোনো তথ্যের জন্য কাউকে পুরস্কৃত করতে পারেন, যার ফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা কর্মকাণ্ডের চেষ্টা অথবা এর পরিকল্পনা, অর্থায়ন বা সহায়তার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার বা দোষী সাব্যস্ত করা যায়। এ উদ্যোগের আওতায় এ পর্যন্ত ১০০-এরও বেশি লোককে ২০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ পুরস্কার হিসেবে দিয়েছে তারা।

ন্যায়বিচার নিয়ে প্রশ্ন ছিল রাফিদা আহমেদের : অভিজিতের স্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত রাফিদা আহমেদ গত রাতে তাঁর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পররাষ্ট্র দপ্তর ও রিওয়ার্ড ফর জাস্টিসের বিজ্ঞপ্তিগুলো পোস্ট করেছেন। বাংলাদেশে ওই মামলার বিচার ও ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে তিনি আগেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রায়ের পরপরই ফেসবুকে জানান, তিনি অভিজিৎ রায়ের ওপর হামলার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি নিজেও হামলার শিকার হয়েছেন। অথচ অভিজিৎ হত্যা মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িতদের কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি, বক্তব্যও নেননি।

রাফিদা আহমেদ জানান, অভিজিতের মতো লেখক, ব্লগারদের হত্যার পেছনে যারা টাকা খরচ করেছে, তাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পুলিশের তদন্তে উঠে আসেনি। অল্প কিছু চুনোপুঁটির বিচারকাজ সম্পাদন করে এবং জঙ্গিবাদের উত্থান ও শিকড় উপেক্ষা করে এ হত্যার ন্যায়বিচার হতে পারে না।

অভিজিৎ হত্যার ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে ২০১৫ সালের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেসম্যান তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে চিঠি লিখেছিলেন। তদন্তে সহযোগিতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল তদন্ত সংস্থা এফবিআইকেও ঢাকায় পাঠানো হয়েছিল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here