শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও করণীয়

0
81

লে. কর্নেল নাজমুল হুদা খান:

সারা বিশ্বের শিশুদের মধ্যে স্মার্টফোনের আসক্তি দেখা দিয়েছে প্রকটভাবে। বিশেষ করে গত আড়াই বছরে এ ক্ষেত্রে করোনা অতিমারির প্রভাব লক্ষণীয়। করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের পদক্ষেপ হিসেবে বিশ্বের দুই শরও বেশি দেশে বিভিন্ন মেয়াদে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, এ সময় বিশ্বের ১৬ কোটি শিশু শিক্ষাজীবন শুরু করতে পারেনি; বাংলাদেশে পারেনি প্রায় ৪০ লাখ।

করোনা প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসেবে ঘরে থাকা কর্মসূচি, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয়। শিশুরা বাধ্য হয় স্মার্টফোন, আইপ্যাড, ট্যাব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটাতে। ফলে তাদের মধ্যে মানসিক ও আচরণগত সমস্যা, স্থূলতা, স্নায়ুতন্ত্রের বৈকল্যসহ নানা সমস্যা দেখা দেয়।
ইউনিসেফের মতে, করোনা অতিমারিকালে বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় পৌনে দুই লাখ শিশু ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, ফেসবুক ব্যবহারকারী ২৫ শতাংশেরই বয়স ছিল ১০ বছরের নিচে। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, করোনাকালে ৬৭ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থীর মোবাইল ফোনে আসক্তি জন্মেছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী ৫০ শতাংশেরও বেশি শিশুর মাথা ব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা ও পানি পড়া উপসর্গ লক্ষণীয়। ৫৪ শতাংশ শিশু মোবাইলবিহীন থাকাকে বিরক্তিকর এবং ৬৬ শতাংশ ভীতিকর মনে করে।

এটি সত্য যে ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের ব্যবহার সবার জন্য এবং শিশুদের জন্যও জ্ঞানার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম। তবে অতিরিক্ত ব্যবহার বা আসক্তি নানা জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকির জন্ম দেয়। গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে মোবাইল ফোনের চুম্বকীয় রশ্মির প্রভাবে মস্তিষ্কের ক্ষতির আশঙ্কা প্রবল; এমনকি মস্তিষ্কে টিউমারও দেখা দিতে পারে।

অনেক বাচ্চা স্কুলে স্মার্টফোন নিয়ে ক্লাসের ফাঁকে বা টিফিনের সময় চ্যাটিং বা ভিডিও গেমস খেলে সময় পার করে। ফলে ক্লাসের কার্যক্রমে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এসব শিশু অনেক সময় পরীক্ষা চলাকালে স্মার্টফোনের ক্যালকুলেটর ব্যবহার, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ছবি, সূত্র অথবা প্রশ্নোত্তর ইত্যাদি কপি করা বা অন্যের সঙ্গে শেয়ারের মতো অসদুপায় অবলম্বনের মাধ্যমে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়। এ অবস্থা শুধু তাদের একাডেমিক দক্ষতায়ই নয়; চারিত্রিক স্খলনও ঘটে। শুধু তা-ই নয়, তারা অনেক সময় অশ্রাব্য মেসেজ বা ছবি শেয়ার করে থাকে; অনেক শিক্ষার্থীকে অল্প বয়সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়তে দেখা যায়। তারা বেশির ভাগ সময় অনেক রাত অবধি বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং, গেমস বা মেসেজ আদান-প্রদান করার ফলে নিদ্রাহীনতায় ভোগে ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে খেলাধুলা, শারীরিক কর্মকাণ্ডে উৎসাহ হারিয়ে স্থূলতা বা বিভিন্ন মানসিক রোগ; এমনকি ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মতো জটিল রোগেও তাদের আক্রান্ত হতে দেখা যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভ্যস্ত ছেলেমেয়েরা সাইবার বুলিংয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে; যা পরবর্তী সময়ে মানসিক বিকারগ্রস্ততায় রূপ নেয়।

বর্তমান যুগে এবং করোনা অতিমারির পরিস্থিতির শিকার শিশুদের সহজে বা হঠাৎ করে এ অবস্থা থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়তো সম্ভব নয়, বরং অনেক সময় হিতে বিপরীতও হতে পারে। পরিবার কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভিভাবকরা পরিস্থিতি বিবেচনায় কার্যকর পদক্ষেপ নিলে এই নেতিবাচক প্রভাব থেকে আগামী দিনের ভবিষ্যৎ শিশুদের রক্ষা করা সম্ভব।

অনেক অভিভাবক সন্তানদের খাওয়ানো, কাপড়চোপড় পরানো বা ভ্রমণকালে তাদের মনোযোগ আকর্ষণে বা অন্যত্র সরাতে স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ নেন; এটি মোটেও ঠিক নয়। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নেতিবাচক। অভিভাবকদের অবশ্যই তাঁদের সন্তানদের আবেগ-অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে হবে; তাদের একান্ত সান্নিধ্যে মানসিক বন্ধন দৃঢ় করার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানই শ্রেয় এবং তা দীর্ঘস্থায়ী সুফল বয়ে আনে।

অনেক মা-বাবা বাচ্চাদের হোমওয়ার্ক বা পড়াশোনায় মনোযোগের বিনিময় হিসেবে স্মার্টফোন ব্যবহারের শর্ত জুড়ে দেন। এতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হয়। বরং মা-বাবারা সন্তানদের হোমওয়ার্ক, অ্যাসাইনমেন্ট বা পড়াশোনা যথাযথভাবে শেষ হওয়ার পর স্মার্টফোন ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারেন। উত্তম হয়, যদি আমরা পারিবারিক মিডিয়া পরিকল্পনায় শিশুদের অভ্যস্ত করতে পারি। এর মাধ্যমে তাদের একটি শিডিউলের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর অভ্যাস তৈরি করা সম্ভব। এতে বাচ্চাদের স্ক্রিনে সময় কাটানো কমানো যাবে। আমরা খাওয়ার টেবিলে, টিভি দেখার সময়, ঘুমাতে যাওয়ার আগে স্মার্টফোন, আইপ্যাড ইত্যাদি ব্যবহার করা যাবে না, এ বিষয়ে শিশুদের উদ্বুদ্ধ করতে পারি।

সবচেয়ে বড় কথা, শিশুদের পারিবারিক আবেগ, অনুভূতি ও বন্ধনের স্বাদ বুঝতে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব অভিভাবক হিসেবে আমরা এড়াতে পারি না। তাদের বাইরে বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, খেলতে উদ্বুদ্ধ করা, পরিবারের বিভিন্ন ছোট কার্যক্রমে দায়িত্ব প্রদানের মাধ্যমে স্মার্টফোন আসক্তি হ্রাস করা সম্ভব। অন্যান্য স্বাভাবিক কার্যক্রম, যেমন গান শোনা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, ছবি আঁকা, বইপড়া, সাঁতার কাটা, হাঁটা ইত্যাদিতে শিশুদের অভ্যস্ত করলে মানসিক কিংবা শারীরিক উভয় দিকেই স্বাস্থ্যকর করে গড়ে তোলা সম্ভব। পরিবারের সবাই মিলে ছুটির দিনগুলোতে সাধ্যমতো বেড়াতে যাওয়া কিংবা ছবি দেখার মাধ্যমে একটি পারিবারিক আবহে তাদের গড়ে তুলতে পারি। শারীরিক কর্মকাণ্ড বা খেলাধুলা শিশুদের মেধা বিকাশ, শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি, চ্যালেঞ্জ গ্রহণে দক্ষতা এবং মানুষ হিসেবে সমাজের উপযোগী হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করে। এভাবেই আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্মার্টফোন, আইপ্যাড, ট্যাব ও ইন্টারনেট ব্যবহারের আসক্তি থেকে এবং জটিল সব স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে মুক্ত করা সম্ভব।

আধুনিক বিশ্বে স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট প্রযুক্তির ভালো-মন্দ দুটি দিকই রয়েছে। ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন প্রযুক্তি শিক্ষা ও জ্ঞানলাভের একটি শক্তিশালী মাধ্যম; তাতে সন্দেহ নেই। আজকের যুগে বাচ্চাদের এই আসক্তি নির্মূল করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অভিভাবক ও শিক্ষকদের সচেতনতা, একনিষ্ঠ চেষ্টা এবং শিশুদের প্রতি দায়িত্বশীলতাই তাদের এ ঝুঁকি থেকে মুক্ত করতে পারে।

লেখক : সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা
nazmul29@yahoo.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here