সেপ্টেম্বরের আগে লোডশেডিংপরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম

0
51

বাংলা খবর ডেস্ক:
সারা দেশে লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করার পর বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে একগুচ্ছ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আপাতত সেপ্টেম্বরের আগে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই অবস্থায় ২০০০ মেগাওয়াট চাহিদা কমিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে এই পরিল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনার মধ্যে আছে- বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আলোকসজ্জা না করা, অফিস আদালতে এয়ারকন্ডিশনের তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির মধ্যে রাখা, বিয়ে-শাদীর অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত আটটার মধ্যে শেষ করা, অফিস সূচি ২ ঘণ্টা কমিয়ে ৯ থেকে ৩টা পর্যন্ত করা। এসব নিদের্শনা বাস্তবায়ন হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। অন্যদিকে জাতীয় গ্রিডে নতুন উৎপাদিত বিদ্যুৎ যুক্ত হলে বর্তমান ক্রাইসিস আগামী সেপ্টেম্বরের পর উন্নতি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠক শেষে এসব তথ্য জানান, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। বৈঠকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য অফিস সময় কমিয়ে আনা, সন্ধ্যার পর পর সব ধরনের অনুষ্ঠান শেষ করা, এসি ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার মতো বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন বিতরণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা।

এদিকে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের লক্ষ্যে সকল ধরনের আলোকসজ্জায় নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে সকল সিনিয়র সচিব, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, সকল সচিব ও বিভাগীয় কমিশনারকে দেয়া পত্রে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

পত্রে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশনা না দেয়া পর্যন্ত সারা দেশে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান, কমিউনিটি সেন্টার, শপিংমল, দোকানপাট, অফিস ও বাসাবাড়িতে আলোকসজ্জা না করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো। ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বৈঠক শেষে বৈশ্বিক জ্বালানি সংকটের কারণে দেশে বিদ্যুৎ খাতের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা দূর হতে অন্তত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় লাগবে উল্লেখ করে তৌফিক-ই-এলাহী বলেন, আমরা এখন যে অবস্থায় আছি এটা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্টেইন করতে পারলে আমাদের অবস্থার উন্নতি হবে। এর আগ পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হতে হবে।

এর মধ্যে বেশ কয়েকটি কয়লাভিত্তিক নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। তাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমাতে অফিস সময় কমিয়ে আনার কথা ভাবছে সরকার। আবারও চালু হতে পারে হোম অফিস। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সবাইকে জ্বালানি সাশ্রয়ী হতে হবে। তিনি বলেন, কোভিডের সময় জীবন অন্যভাবে ছিল। অফিসের সময় সংশোধন করা গেলে যেমন ৯টা থেকে ৩টা করা যায় কিনা বা ঘরে বসে কাজ করতে পারি কিনা, এটা সরকারের উচ্চ পর্যায় চিন্তা করতে পারে। কারণ করোনাও বাড়ছে। তবে এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব সাশ্রয়ী নীতিকৌশল অবলম্বন করে বিদ্যুতের চাহিদা ১২ হাজার মেগাওয়াটের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা গেলে বিদ্যুতের সংকট অতটা হবে না। সেপ্টেম্বরের পর কীভাবে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তার কারণ ব্যাখ্যা দিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এলএনজি’র ওপর নির্ভরতার কারণে আমরা যে বিপাকে পড়েছি, সেপ্টেম্বরে কতগুলো কোল পাওয়ার প্লান্ট আসবে। যেমন; আদানির একটি আসবে, রামপাল আসবে, চট্টগ্রামে এস আলম গ্রুপের বাঁশখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। কম-বেশি অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট আমরা পাবো।

বিদ্যুতের আরও কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প উৎপাদনে আসার অপেক্ষায়। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আমরা যে ম্যানেজমেন্টের কথা বললাম এগুলো যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে ৫০০ মেগাওয়াটের চেয়ে বেশি লোডশেডিং হবে না। আমরা ধরেছি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রিডে সাড়ে ১৪ হাজারের মতো বিদ্যুতের ডিমান্ড হতে পারে। এরই মধ্যে সরকার রাত ৮টায় বিপণিবিতান বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন। আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এই পদক্ষেপগুলো যদি আমরা সবাই মিলে নিই তাহলে এটাকে (চাহিদা) সাড়ে ১২ হাজারে নামিয়ে আনতে পারবো। তাহলে আর লোডশেডিং হবে না। তবে আমি এখন এটা বলতে চাই না যে, হবে না। এটার জন্য সকলের সহযোগিতা চাই। আমরা সাশ্রয়ের তালিকা তৈরি করছি। এটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করা হবে। এরপরই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বাগেরহাটের রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন এখনও চালু করা যাচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, প্লান্টটা সিংক্রোনাইজ হতে আরও কিছু কাজ করা লাগবে। ওদের যে সাবস্টেশন আছে এখন সেটা বন্ধ। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ২১শে জুলাইয়ের পরে তারা যদি কাজ শেষ করতে না পারে, তাহলে আমরা এটা ব্যবহার করতে শুরু করবো। তখন কিন্তু এখান থেকে ৭০০-৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসবে। বড় পুকুরিয়াতে আমাদের নতুন যে কয়লা উৎপাদন হচ্ছে, সেটা আসতে আরও মাস দেড়েক সময় লাগবে। বর্তমানে যেটা আছে সেটা দিয়েই ওই পর্যন্ত যেতে হবে। স্টকটা আমরা চেষ্টা করছি যাতে সুষম ব্যবহার হয়। দেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎকেন্দ্র কাপ্তাই নিয়ে তৌফিক-ই-এলাহী বলেন, এটাকে সাধারণত আমরা ব্যবহার করি ব্যালান্সিংয়ের জন্য। এটাকে মেইন সোর্স ধরা হয় না। এ কারণে এর ব্যবহারটা অন্য কেন্দ্রগুলোর মতো হয় না।

এখন পানি বেশি আছে, এখন নিশ্চয়ই প্রোডাকশন বেশি হবে। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, যুদ্ধ কিন্তু শুধু ইউক্রেনে হচ্ছে না। এটা আমাদের দেশেও একটা ভিন্ন প্রকৃতির যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমাদের উন্নয়নের যে মেরুদণ্ডগুলো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, সেটা খুব শক্ত পরীক্ষায় পড়েছে। যে এলএনজি আমরা এক সময় ৫ ডলারেও পেয়েছিলাম, সেটা ৪১ ডলার পর্যন্ত গিয়েছে। শুধু আমরা না পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ জাপানও এখন লোডশেডিংয়ে আছে। তাই সকলকে বলে দেয়া হয়েছে সাশ্রয়ী হতে। জার্মানির মতো দেশও সাশ্রয়ীর জন্য রেশনিং চালু করছে। সারা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই অভিঘাত। আমরা সে তুলনায় ভালো আছি। জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, বিশ্বে যদি অস্থিরতা সৃষ্টি না হতো আমরা কিন্তু সবাইকে বিদ্যুৎ দিতে পারতাম। বিদ্যুৎ উৎপাদন ঘাটতির কারণে যেসব এলাকায় লোডশেডিং হবে, তার তথ্য আগে থেকে গ্রাহকদের জানিয়ে দেয়ার বিষয়টি উঠে এসেছে সভায়। এ বিষয়ে তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী বলেন, যেসব জায়গায় যখন লোডশেডিংয়ের প্রয়োজন হবে আমরা আলোচনা করেছি যে, কীভাবে আগে জানানো যায়। এতে মানুষের একটা প্রস্তুতির সুযোগ থাকবে। ফিল্ড লেভেলে আমাদের কয়েকটি কমিটি আছে। তারাই এ বিষয়টিকে বাস্তবায়ন করবে।

বিলখেলাপি গ্রাহকদের বিরুদ্ধেও কঠোর হওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, যারা বেআইনিভাবে বিদ্যুৎ বা জ্বালানি ব্যবহার করছে বা যারা বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করেনি, তাদের কিন্তু আমরা শক্ত হাতে মোকাবিলা করবো বা ব্যবস্থা নেবো। এত দামি বিদ্যুৎ তারা ব্যবহার করবে আর পয়সা দেবে না মাসের পর মাস- এটা মোটেও গ্রহণযোগ্য না। গ্রাম ও শহরের লোডশেডিংয়ের বৈষম্যের বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, এটি এত সহজ নয়। কোনো কোনো গ্রামে শুধু মানুষের বাস, আবার কোথাও শিল্প কারখানা আছে; এ সব বিষয় বিবেচনা করে স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে ম্যানেজমেন্ট করা হবে। এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সভায় ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত হয়ে বলেছেন, অক্টোবর মাস নাগাদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। সারা বিশ্ব নানারকম কৃচ্ছতা সাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদেরকে গ্যাস ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। লোডশেডিং করতে হলে অবশ্যই শিডিউল করে গ্রাহকদের জানাতে হবে।

এ সময় তিনি গ্রাহকদের সহযোগিতা কামনা করেন। এদিকে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়ে জ্বালানি সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা করেছি। এই মুহূর্তে কোনো রিগ (খনন-যন্ত্র) বসে নেই। তবে রাতারাতি গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়। আগামী বছরের শুরুতে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হবে বলে আমরা আশা করছি। সভায় জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. মাহবুব হোসেন, বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) মো. সামসুল আরেফিন, অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বাজেট) সিরাজুন নূর চৌধুরী, পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনসহ বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগের দপ্তর প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here