যুদ্ধ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা

0
182

বাংলা খবর ডেস্ক:
কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে বিশ^ যখন ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজছে, তখনই দামামা বেজে ওঠে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের সম্ভাবনা দেখা দিলে দেশটিতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে রাশিয়া। ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানের ব্যাপারে ঘোর আপত্তি জানিয়ে আসছিল দেশটি। এক বছর ধরে চলমান এ যুদ্ধের নিষ্পত্তি তো হয়ইনি, বরং সব পক্ষ নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকায় যুদ্ধ আরও ভয়াবহ হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ইউক্রেনে নতুন অস্ত্র আসছে। মিত্রদের কাছে কিয়েভের নতুন চাওয়া যুদ্ধবিমান। ইউক্রেনের অনুরোধে সাড়া দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি সেখানে তাদের ট্যাংক পাঠাতে সম্মত হয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ অস্ত্র পাঠানো মানে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ইউক্রেনের দীর্ঘদিনের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এভাবে অস্ত্র পাঠানোর বিষয়টিকে ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন মোড় হিসেবে দেখা হচ্ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ বলেছেন, ইউক্রেনে রুশ ‘আগ্রাসন আমাদের যৌথ চেতনায় এক অপমান’ এবং জাতিসংঘ সনদের লংঘন যা ‘বহুপাক্ষিক পদ্ধতির নীতি ও মূল্যবোধের’ পক্ষে এক চ্যালেঞ্জ। এ অবস্থা বিশ্বকে অস্থিরতায় ঠেলে দিয়েছে। ১৯৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত বুধবার ইউক্রেন বিষয়ক বিশেষ জরুরি বৈঠকে তিনি এ কথা বলেন।

এদিকে যুদ্ধের এক বছর পূর্ণ হওয়ার ঠিক আগে, গতকাল বৃহস্পতিবার পরমাণু অস্ত্রসম্ভার বাড়ানোর হুশিয়ারি দিয়ে রাখলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। একটি কর্মসূচিতে যোগ দিয়ে তিনি জানান, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদন আরও বাড়াতে চলেছেন তারা। এমনকি সমুদ্রের ভেতর দিয়েও যেতে পারে এমন ক্ষেপণাস্ত্রও রুশ সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। এরই মধ্যে চীনের অন্যতম শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই সাক্ষাৎ করেছেন পুতিনের সঙ্গে। পুতিন জানিয়েছেন, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের আসন্ন মস্কো সফরের জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনঅনুযায়ী, মার্চ কিংবা এপ্রিল মাসে রাশিয়া যেতে পারেন চীনের প্রেসিডেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ইউক্রেন সফরের পরই সে দেশের সঙ্গে নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত ‘নিউ স্টার্ট’ চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার কথা জানিয়েছিলেন পুতিন। তার পরই তার এই হুশিয়ারিতে অন্য ইঙ্গিত দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ।

অন্যদিকে ন্যাটোপ্রধানের আশঙ্কা, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়াকে অস্ত্র ও রসদ দিয়ে সাহায্য করতে পারে চীন। চীনকে এ কাজ থেকে বিরত থাকার কথা জানিয়েছেন তিনি। এই আবহে দক্ষিণ আফ্রিকায় পরীক্ষামূলক যৌথ মহড়ায় নামতে চলেছে রাশিয়া ও চীন। এই মহড়ায় অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পারে মস্কো। পুতিনের নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি থেকে সরে আসাকে ‘মারাত্মক ভুল’ বলে বর্ণনা করেছেন বাইডেন। যুদ্ধের বর্ষপূর্তির ঠিক আগে ইউক্রেনে রুশ ‘আগ্রাসনে’র নিন্দা করে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ ‘শুভবুদ্ধি জাগ্রত’ হওয়ার প্রত্যাশা করেছেন। তবে পুতিনের এই প্রচ্ছন্ন হুশিয়ারি যুদ্ধের গতিপথকে বদলে দেয় কি না, তা-ই এখন দেখার।
এদিকে যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ‘দীর্ঘস্থায়ী শান্তি’র খোঁজে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় একটি প্রস্তাব আনতে চলেছে ইউক্রেন। ইউক্রেন ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে এই প্রস্তাবের খসড়া। কিছু দিনের মধ্যেই জাতিসংঘের সাধারণ সভার জরুরি অধিবেশনে পেশ করা হবে প্রস্তাবটি। ইতোমধ্যে ফ্রান্স এবং জার্মানির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো এই প্রস্তাবে সমর্থন জানানোর কথা বলেছে। এ ছাড়া এই যুদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশকে ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়তা করেছে। এই জোট তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করছে। রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দিয়ে চলেছে। এই জোট প্রথমবারের মতো ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র কিনতে অর্থ দিচ্ছে।

যুদ্ধের ফল শুধু ইউরোপ নয়, ভোগ করছে পুরো বিশ্ব। ইউক্রেনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব¡াধীন পশ্চিমা বিশ্ব পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রচুর সামরিক সহায়তাও দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইউরোপে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে মস্কো। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এ যুদ্ধ প্রভাবিত করেছে সমগ্র বিশ্বের উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা। এতে বিশ্ব জ্বালানি বাজার হয়ে পড়েছে অস্থিতিশীল। দুই দেশের সংঘাতের কারণে শরণার্থী হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। খাদ্য, সার, জ্বালানিসহ নানা সংকট দানা বেঁধে উঠেছে বিশ্বজুড়ে। কোনো কোনো দেশে মুদ্রাস্ফীতি এক লাফে হয়েছে দ্বিগুণ। আর এসব সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো তৃতীয় বিশ্বের নিরীহ জনসাধারণ।
রাশিয়া ও ইউক্রেনে উৎপাদিত গমে বিশ্ব চাহিদার ৩০ শতাংশ পূরণ হয়। দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া ইউক্রেনের ওডেসা বন্দর অবরোধ করে রাখে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার দেশগুলো ইউক্রেনের গমের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ অঞ্চলের, বিশেষ করে আফ্রিকার দেশগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইতোমধ্যে জানিয়েছে, তারা বাস্তুচ্যুতদের খাবারের বাজেট কমিয়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। যদি এ অবস্থার দ্রুত উন্নতি না হয়, তবে এই বাজেট আরও কমাতে বাধ্য হবে সংস্থাটি।

রাশিয়া বিশ্বে প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান জোগানদাতা। দেশটি বিশ্বে তেল রপ্তানিতে দ্বিতীয় এবং কয়লা রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে। তবে পশ্চিমা অবরোধের কারণে বিভিন্ন দেশ রাশিয়া থেকে তেল-গ্যাস আমদানি করতে পারছে না। এর ধাক্কা লেগেছে বিশ্ব তেল বাজারেও। জ্বালানি মূল্যের হঠাৎ বৃদ্ধি, কোভিড-পরবর্তী সময়ে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর যেন ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্র জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়ামের মতো দেশগুলো জ্বালানির জন্য অতিমাত্রায় রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল ছিল। ইউরোপের মোট গ্যাস চাহিদার ৪০ শতাংশ রাশিয়া সরবরাহ করত। যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়া জ্বালানি সরবরাহ কখনো কমিয়ে দিয়েছে অথবা নানা অজুহাতে বন্ধ রেখেছে। ফলে ইউরোপের ধনী দেশগুলো পড়েছে তীব্র জ্বালানি সংকটে। জ্বালানির দাম বৃদ্ধি দ্রব্যের উৎপাদন ও সরবরাহ খরচ সবই বাড়িয়ে দিয়েছে।
জ্বালানি ও খাদ্যসংকটের কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি চাবুকের আঘাত হয়ে এসেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। উন্নত কী উন্নয়নশীল, ইউরোপ থেকে আফ্রিকা সবদেশে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। ইউরোপের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯ শতাংশের বেশি। আর নি¤œ মাথাপিছু আয়ের দেশগুলোতে মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কের বেশি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির বোঝা স্বল্প আয়ের মানুষের ঘাড়েই বেশি চেপেছে। তাদের জীবনযাত্রার খরচ বেড়েছে ঠিকই, কিন্ত আয়ের পরিমাণ বাড়েনি, বরং অনেকের ক্ষেত্রে কমেছে।

বিশ্ব যখন শরণার্থী সমস্যায় নাকাল, তখন ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত তৈরি করেছে অতিরিক্ত ৭.৩ মিলিয়ন শরণার্থী। ফলে আগেই শরণার্থী সমস্যায় জর্জরিত ইউরোপ পড়েছে আরও সংকটে। চলমান এই সংকট ইউরোপের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যায় তা এক বড় প্রশ্ন। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশকে নিজেদের নিরাপত্তার ভাবনা নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের ফলে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ তাদের সামরিক খাতের ব্যয় বাড়িয়েছে। ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের মতো শান্তিপ্রিয় দেশ দুটোও এখন ন্যাটোতে যোগ দিতে আবেদন করেছে। আধুনিক বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিটি দেশই অন্যান্য দেশের ওপর কোনো না কোনো দিক দিয়ে নির্ভরশীল। তাই কোনো এক অঞ্চল আক্রান্ত হলে পুরো বিশে^ই যে তার প্রভাব পড়বে, তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আর এই প্রভাব সারাবিশ্বের ধনী-গরিবের ব্যবধানকে যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে দিন দিন। এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হতে হচ্ছে স্বল্প আয়ের মানুষদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here