চায়ের বহুমুখী ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ প্রধানমন্ত্রীর

0
198

ঢাকা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চায়ের বহুমুখী ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেছেন, সরকার চায় বাংলাদেশের চা গুণগত মানে উন্নত হয়ে সারাবিশ্বে নিজের স্থান করে নেবে।

তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আমাদের চা সারা বিশ্বে নিজের স্থান করে নিক। আরো উন্নত হোক এবং চা গবেষণা ইনস্টিটিউট চায়ের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্যও গবেষণা আরো জোরদার করবে।’

রবিবার সকালে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে বাংলাদেশ চা প্রদর্শনী ২০১৮’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি এ কথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন ফ্লেভারযুক্ত চা ছাড়াও চা থেকে বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী, যথা- টি সোপ, টি শ্যাম্পু, টি টুথপেস্ট প্রভৃতি এবং খাদ্য সামগ্রী, যেমন-টি কোলা, চা-এর আচার প্রভৃতি উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে। এ সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চা উৎপাদনের জন্য যে দুটি পাতা একটি কুঁড়ি আমরা নিচ্ছি তা ছাড়াও যে চা গাছটা থেকে যাচ্ছে তা বহুমুখীকরণে আমাদের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’

বাংলাদেশ চা বোর্ড চা ও চা জাত পণ্য বহুমুখীকরণের উপর কাজ করছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে বর্তমানে মূল্য সংযোজিত বিভিন্ন ধরনের চা উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছে। সাতকড়া চা, লেমন চা, মশলা চা, জিনজার চা, তুলসি চা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেমিক্যাল ফার্টিলাইজার ও পেস্টিসাইডস ব্যবহার না করে অর্গানিক পদ্ধতিতেও চা উৎপন্ন করা হচ্ছে। বিভিন্ন বাগানে সিটিসি ব্ল্যাক টি এর পাশাপাশি গ্রিন টি ও অর্থোডক্স টি তৈরি করা হচ্ছে। চায়ের মোড়কজাত ও বাজারজাতকরণে এসেছে নতুনত্ব।

বিভিন্ন কম্পানি আকর্ষণীয় মোড়ক, সিলিন্ডার ও টি ব্যাগে চা বাজারজাত করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ভ্যালু এডেড চা উচ্চমূল্যে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। চা গাছের পোকা মাকড় দমনে নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করাসহ ফ্লেভার্ড চা’এর বিষয়েও গবেষণা চলছে।

তিনি আশা প্রকাশ করেন, এতে করে চায়ের উৎপাদন যেমন বৃদ্ধি পাবে তেমনি এর গুণগত মান আরো উন্নত হবে, সেটাই আমাদের আশা।

প্রধানমন্ত্রী চা উৎপাদনের জন্য প্রচুর বৃষ্টিপাত লাগার পাশাপাশি সেই বৃষ্টির পানি যেন বাগানে দাঁড়াতে না পারে তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হয় উল্লেখ করে ধানের বিভিন্ন প্রজাতির মত ক্ষরা সহিষ্ণু বা অল্পবৃষ্টি সহিষ্ণু চা উৎপাদনের দিকেও সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়ার আহ্বান জানান।

এবার দেশে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হওয়াকে চা বাগানের মালিকদের জন্য সুখবর উল্লেখ করে তিনি চা শ্রমিকদের কল্যাণে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়ার জন্যও বাগান মালিকদের প্রতি আহ্বান জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, তিনিই পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ অঞ্চলে চাষকে উৎসাহিত করেছিলেন এবং সে সরকারি খাতকে উন্মুক্ত করে দেওয়াতেই এই পঞ্চগড়ে চা চাষের শুরু। আজকে এই চা ইংল্যান্ডের হ্যারডস-এও পাওয়া যাচ্ছে।

মাটির রকম ভেদে চায়ের স্বাদ ভিন্ন হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আবার এক জায়গার চায়ের সঙ্গে আরেক জায়গার চা ব্লেন্ড করেও খাওয়া হয়। খুব কড়া চায়ের জন্য আসাম টি এবং সুগন্ধি চা হচ্ছে দার্জিলিং টি। শ্রীলংকায় হয় মসলা চা, সর্দি-কাশিতে এটি খুবই ভাল শরীরের জন্য। আসামের সঙ্গে দার্জিলিং চা মিক্স করে খেতে ব্যক্তিগতভাবে তিনি পছন্দ করেন বলেও উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে চা বাগান ও কারখানাগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাগানের কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে। শ্রমিকদের বাড়িঘর ও চা কারখানা জ্বালিয়ে দেয়। অনেকেই মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। সে সময় অনেক চা বাগানের বিদেশি মালিকগণ এ দেশ ছেড়ে চলে যান। ফলে অনেকগুলো চা বাগানই পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এই অবস্থায় জাতির পিতা ক্ষতিগ্রস্ত চা বাগানগুলো পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে চা উৎপাদনকারীদের ভর্তুকি প্রদানসহ স্বল্পমূল্যে সার সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।

ক্ষতিগ্রস্ত চা বাগানগুলো পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের লক্ষ্যে জাতির পিতার উদ্যোগ সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি (জাতির পিতা) ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভলপমেন্ট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া’ থেকে ৩০ লাখ রুপি ঋণ নিয়ে চা শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করেন এবং সেগুলো চা বাগানগুলোকে প্রদান করে সহজ শর্তে মূল্য পরিশোধ করার সুযোগ দেন।

চা বাগানের শ্রমিকদের বঙ্গবন্ধু নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার প্রদান করেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বঙ্গবন্ধু চা বাগানের মালিকদেরকেও ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি প্রদান করেন।

জাতির পিতার যুগান্তকারী পদক্ষেপের ফলে চা হয়ে ওঠে বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি পণ্য, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার জাতির পিতার আর্দশ অনুসরণ করে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে।

২০০১ সালে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় চা শিল্পের উন্নয়নে উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমরা ‘চা আইন ২০১৬’ প্রণয়ন করেছি।’

চা শিল্পের উন্নয়নে তাঁর সরকার ২০১৬ সালে ‘উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প’ শিরোনামে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ফলে দেশে বর্তমানে চায়ের উৎপাদন প্রায় ৮ কোটি ৫০ লাখ কেজিতে দাঁড়িয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে মধ্যম মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২৫ সালে দেশে চায়ের মোট উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ১৪ কোটি কেজি।

ঢাকার মতিঝিলে চা বোর্ডের নিজস্ব জায়গায় ৩০ তলা ‘বঙ্গবন্ধু চা ভবন’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তাঁর সরকার, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, চা বাগানের শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের শিক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাগানগুলোতে পর্যাপ্ত স্কুল ও হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। চা বাগানে কর্মরত গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং অন্যান্য নারীদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য বাংলাদেশ চা বোর্ডকে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।

বর্তমান সরকারের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা। এ লক্ষ্য অর্জনে তাঁর সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এ সময় তাঁর সরকারের শাসনে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের খণ্ড চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, বর্তমানে জনগণের মাথাপিছু আয় ১,৬১০ মার্কিন ডলার। মানুষের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। চায়ের অব্যাহত চাহিদা মেটাতে আমরা ‘ক্ষুদ্র চা চাষ প্রকল্পে’ উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। এর ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারি, দিনাজপুর, লালমনিরহাট এবং পার্বত্য অঞ্চলের বান্দরবান জেলায় ক্ষুদ্র চা চাষ প্রকল্প ব্যাপক বিস্তার ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।

প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী পর্ব শেষে প্রদর্শনীর বিভিন্ন স্টলগুলো ঘুরে দেখেন এবং উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য সচিব শুভাশিষ বোস এবং চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের চেয়ারম্যান আর্দাশিল কবির।

সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ চা বোর্ড (বিটিবি) যৌথভাবে বসুন্ধরা আন্তর্জাতিক কনভেনশন সেন্টারে তিন দিনব্যাপী এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। দেশ-বিদেশের চা প্রেমীদের কাছে চায়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরা হবে এই প্রদর্শনীতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here