পুঁজিবাজারে এক অস্বস্তিকর সময় কাটছে। এতে অনেকটাই দিশাহারা হয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। পতনে কমেই চলেছে কম্পানির শেয়ারের দাম। কেনা দামের চেয়ে অনেক নিচে নামায় ক্ষতির মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। তবু পুঁজিবাজারের ‘অস্বাভাবিক’ চিত্রে কারো টনক নড়ছে না। একটানা ১২ দিনের পতনে পুঁজিবাজারের মূলধন কমেছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। আর সূচক কমেছে ৩৭০ পয়েন্ট।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ২৬ এপ্রিল থেকে একটানা পতনের মুখে পুঁজিবাজার। গতকাল বৃহস্পতিবারও পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। বিক্রির চাপে কমছে শেয়ারের দাম। কোনো কোনো কম্পানির শেয়ারের দাম এক-তৃতীয়াংশও কমেছে। বৃহৎ মূলধনী কম্পানিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পুঁজিবাজারে বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন অনেক বেশি। এই ব্যাংকগুলো ২০১৭ সালে ভালো মুনাফা করতে না পারায় লভ্যাংশ কমেছে। কোনো কোনো ব্যাংক নগদ অর্থ জমা রেখে শুধু বোনাস শেয়ার ইস্যু করেছে। এতে ব্যাংক খাতের শেয়ারে বিক্রির চাপ বেশি। যার দরুন পুঁজিবাজারে বড় প্রভাব পড়েছে।
ব্যাংকের ঋণ আমানত (এডিআর) কমানো হলে ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট দেখা দেয়। এ জন্যই বেসরকারি ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সুদে আমানত সংগ্রহে মাঠে নেমে পড়ে। তবে এই সংকট কাটাতে ব্যাংক মালিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ১ এপ্রিল ব্যাংকে সিআরআর কমানো ও সরকারি আমানতের অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ঘোষণা দেন অর্থমন্ত্রী।
ঘোষণা অনুযায়ী, সিআরআর সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। পাশাপাশি সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকেও নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। সিআরআর কমানোয় ব্যাংকের ১০-১২ হাজার কোটি টাকা বাজারে এলেও সরকারি আমানত এখনো পায়নি বেসরকারি ব্যাংক।
পুঁজিবাজার সূত্র বলছে, সরকারি আমানতের অর্ধেক ব্যাংকে পেতে একটি গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবেই শেয়ার বিক্রি করছে। ব্যাংকের সহযোগী প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানও শেয়ার কিনছে না। বাজারের পতন দীর্ঘায়িত হওয়ায় ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করছে। সব দিকের পতনে বাজারে পতন ঘটছে।
ডিএসইর এক শীর্ষ ব্রোকারেজ হাউসের এমডি নাম না প্রকাশের শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, সুখবরেও পুঁজিবাজার উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। সবাই শেয়ার বিক্রিই করছে। আর বিক্রির চাপে পতনও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। কোনো একটি গোষ্ঠী দাবি আদায়ে পরিকল্পনামাফিক পুঁজিবাজারকে ফেলে দিচ্ছে। বাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলেও জানান তিনি।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ২৬ এপ্রিল থেকে পুঁজিবাজারের পতনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজারের মূলধন হারিয়েছে ১৭ হাজার ২০৪ কোটি ২৬ লাখ টাকা। টানা ১২ দিনের পতনে প্রতিদিন গড়ে প্রায় এক হাজার ৪৩৩ কোটি টাকার বেশি মূলধন কমেছে। কেউ শেয়ার বিক্রি করে চলে গেছে আবার কেউ বাজার পর্যবেক্ষণ করছে। গত ২৬ এপ্রিল পুঁজিবাজারে মূলধন ছিল চার লাখ চার হাজার ৬৬৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। ১২ কার্যদিবস পর গতকাল মূলধন দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বলা যায়, ১৭ হাজার কোটি টাকা পুঁজিবাজারের বাইরে চলে গেছে।
এদিকে সূচকের পর্যালোচনায় দেখা যায়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে সূচক কমেছে ৩৭০ পয়েন্ট। সেই হিসাবে প্রতিদিনই ৩০ পয়েন্টের বেশি সূচক হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি প্রতিদিন বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দাম কমেছে। ২৬ এপ্রিল ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল পাঁচ হাজার ৮১৩ পয়েন্ট। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার এই সূচক কমে দাঁড়িয়েছে পাঁচ হাজার ৪৪৩ পয়েন্ট।
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তাক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাজারে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশও ভালো না হওয়ায় বাজারে শেয়ার বিক্রির চাপ বেশি। সে জন্যই বাজারে নেতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’
সপ্তাহে ৭৮ শতাংশ কম্পানির শেয়ারের দাম হ্রাস : ক্রমাগত শেয়ার বিক্রিতে সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবস দেশের পুঁজিবাজারে মূল্যসূচক ও লেনদেন কমেছে। এতে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে ৭৮ শতাংশ কম্পানির শেয়ারের দামও হ্রাস পেয়েছে। আর লেনদেন কমেছে ২৫ শতাংশ; সূচক কমেছে ২৫৫ পয়েন্ট বা ৪.৪৮ শতাংশ। ১৩ থেকে ১৭ মে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। এতে সূচক কমার সঙ্গে লেনদেন ও বেশির ভাগ কম্পানির শেয়ারের দাম হ্রাস পেয়েছে। কমেছে বাজার মূলধনও।