অসহিষ্ণু মেধাবী

0
305

প্রভাষ আমিন

কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই খুব সুকৌশলে একটা বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোটার কারণে মেধাবীরা বঞ্চিত হচ্ছে, অমেধাবীরা চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। ফলে দেশের প্রশাসন মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এই সরলীকরণের ফলে আন্দোলনটা দাঁড়াচ্ছে, মেধা বনাম কোটা। স্বাভাবিকভাবেই সবাই মেধার পক্ষে দাঁড়াবে। এটাই এ আন্দোলনের সবচেয়ে বড় যুক্তি। কিন্তু এই যুক্তিটাই সবচেয়ে অন্তসারশূন্য।

এমন নয় যে মেধাবীরা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করে আসছে। আর কলেজ থেকে এসেই অন্যরা কোটায় চাকরি পেয়ে যাচ্ছে। বাস্তবতা হলো প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষার পরই কেবল কোটা প্রয়োগ করা হয়। তার মানে ভাইবার জন্য যারা মনোনীত হন, তাদের সবাইই মেধাবী। তাদের মধ্যে মেধার পার্থক্যটা খুব সামান্য। তাই যারা কোটায় চাকরি পান, তাদের অমেধাবী বলে হেয় করাটা অন্যায়। তবুও আমি আমি আন্দোলনকারীদের দাবিই মেনে নিচ্ছি। ধরে নিচ্ছি, তারা সবাই মেধাবী। কিন্তু মেধাবীরা যে আন্দোলনটা করছে, তার মেধা নিয়ে আমার বারবারই সংশয় জাগছে।

বরাবরই আমি নৈতিকভাবে কোটার পক্ষে। আন্দোলনটিকে আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি, বড় বেশি স্বার্থপর আন্দোলন মনে হয়েছে। কিন্তু আমার মনে হওয়া না হওয়ায় কিছু যায় আসে না। যারা আন্দোলন করছেন, তাদের কাছে নিশ্চয়ই দাবিটি যৌক্তিকই মনে হচ্ছে। নৈতিকভাবে কোটার পক্ষে হলেও আমি বরাবরই আন্দোলনকারীদের মতপ্রকাশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাদের আন্দোলন করার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার থেকেছি। আমার কাছে যৌক্তিক মনে হোক আর না হোক, তাদের আন্দোলন করার পূর্ণ অধিকার ও স্বাধীনতা রয়েছে। তাই যখনই আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ অন্যায়ভাবে হামলা চালিয়েছে, ছাত্রলীগ হামলা চালিয়েছে, পুলিশ আন্দোলনের সংগঠকদের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গেছে; আমি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি। আমি আন্দোলনকারীদের কাছ থেকেও এই পরমতসহিষ্ণুতাটা আশা করেছিলাম। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, মেধাবী প্রজন্মের মধ্যে সহিষ্ণুতার বড় বেশি ঘাটতি দেখা গেছে।

শুরু থেকেই আন্দোলনকারীরা গণমাধ্যমের কাছ থেকে তাদের আন্দোলনের প্রতি পক্ষপাত আশা করেছিল। কেন গণমাধ্যম তাদের আন্দোলনের প্রতি শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছে না, এ নিয়ে তাদের ক্ষোভও ছিল। কিস্তু গণমাধ্যমের কাজ তো কোনো আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নেয়া নয়। তাদের কাজ হলো, ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ তুলে ধরা। আর এটা করতে গিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা বারবার আন্দোলনকারীদের হামলার শিকার হয়েছে। এ কারণে শুরুর দিকে গণমাধ্যম কর্মীরা একবার আন্দোলনের কাভারেজ বর্জনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। যদিও আমি এই বর্জনেরও বিপক্ষে ছিলাম। যত বাধাই আসুক, গণমাধ্যমের কাজ হলো সংবাদ সংগ্রহ করা এবং তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া।

আন্দোলনকারীরা বারবার বলে আসছে, কোটা দিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে, মেধাবীদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। ব্যাপারটা কিন্তু একদম উল্টো। দেশে-বিদেশে সর্বত্র কোটা ব্যবস্থা করাই হয় বৈষম্য দূর করতে। সামনে বিশ্বকাপ ফুটবল। এই
ফুটবলেও কিন্তু অঞ্চল কোটা আছে। সাধারণভাবে কোটামুক্ত ধারণার প্রয়োগ হলে, বিশ্বের সেরা ৩২টি দলেরই শুধু বিশ্বকাপে খেলার কথা। তাহলে কিন্তু ইউরোপ আর ল্যাতিন আমেরিকার দলগুলোই শুধু খেলার সুযোগ পাবে। এশিয়া বা আফ্রিকার কোনো দেশ কখনোই বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাবে না। তা কিন্তু হয় না। বৈষম্যহীনভাবে ফুটবলকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতেই আঞ্চলিক কোটা থাকে। থাকে বলেই এশিয়া-আফ্রিকার পুচকে দলগুলো বিশ্বকাপ খেলে, আর ইউরোপের বাঘা বাঘা দেশ ঘরে বসে থাকে দর্শক হয়ে। যেমন এবার সৌদি আরব বিশ্বকাপ খেলবে আর ইতালি ঘরে বসে হা-হুতাশ করবে। কোটা না থাকলে কিন্তু ইতালিই বিশ্বকাপ খেলতো। এবার বিশ্বকাপ খেলবে, এমন অনেক দেশের চেয়ে কিন্তু ইতালি অনেক ভালো।

বলছিলাম পরমতসহিষ্ণুতার কথা, ধৈর্য্যের কথা। প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন। পরে তাঁর সংবাদ সম্মেলনেও তিনি একই ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এই সময়ে প্রধানমন্ত্রী দুই দফায় দেশের বাইরে ছিলেন।

কোটা বাতিলের জন্য কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে বলেও পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও আন্দোলনকারীরা যেমন অধৈর্য্য হয়ে পড়েছেন, সকাল-বিকাল আলটিমেটাম দিচ্ছেন, তা অশোভনীয়। আন্দোলনকারীরা যেভাবে বিকাল
৫টার মধ্যে প্রজ্ঞাপন করার ডিকটেট করছেন, তাও শিষ্টাচারবহির্ভূত। ৪৭ বছরের পুরোনো সমস্যা রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়, সেটা তাদের বোঝা উচিত।

প্রধানমন্ত্রী তাদের রাজপথ ছেড়ে ক্লাশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন।

কিন্তু আন্দোলনকারীরা প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় আশ্বস্ত না হয়ে আবার রাজপথে নেমেছে। এভাবে কি সমস্যার সমাধান হবে?

আন্দোলন নিয়ে আমার সবচেয়ে আপত্তির জায়গা ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাদের অবস্থানে। বরাবরই আমার মনে হয়েছে আন্দোলনের মূল লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ।

সুকৌশলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। যারা আন্দোলনের কলকাঠি নাড়ছেন, তারা খুব সফলভাবে এটা করতে পেরেছেন। এই আন্দোলনের সুবাদে মুক্তিযোদ্ধাদের যত অপমান করা হয়েছে, তা বাংলাদেশের
ইতিহাসে কখনো হয়নি। এমনকি যখন বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় ছিল, তখনও মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে প্রকাশ্যে হেয় করা হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভাষায় অপমান করা হয়েছে; তা অবিশ্বাস্য, উচারণেরও অযোগ্য। আন্দোলনকারীরা
মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে বলে ‘বন্দুক কোটা’, এটাই সবচেয়ে ভদ্র ভাষা।

আন্দোলনের নামে যারা মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে তাণ্ডব চালিয়েছে, মতিয়া চৌধুরী সংসদে তাদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলেছিলেন।

আমিও জানি, সুকৌশলে মুক্তিযুদ্ধ বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে বটে, তবে আন্দোলনের সবাই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে নয়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেক তরুণও ব্যক্তিগত স্বার্থে আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। তাই আন্দোলনকারীদের ঢালাও স্বাধীনতাবিরোধী বলার পক্ষে নই আমি। আমি অনেকবার মতিয়া চৌধুরীর বক্তৃতা শুনেছি। তিনি কখনোই ঢালাওভাবে আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বলেননি।

তারপরও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের অন্যতম অগ্রসেনানী, সৎ রাজনীতিবিদ মতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে আন্দোলনকারীরা যে ভাষায় ট্রল করেছেন, তাকে রুচিহীন বললেও কম বলা হবে। মতিয়া চৌধুরীকে ব্যঙ্গ করতে এক মেধাবী তরুণ বুকে ‘আমি রাজাকার’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন। ব্যঙ্গ করে হোক আর যে কারণেই হোক; স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো তরুণ ‘আমি রাজাকার’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাজপথে দাঁড়াতে পারে, তা অবিশ্বাস্য। এই ছবিটি দেখে বেদনার্ত হয়েছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও জনপ্রিয় লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। তারপর যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা আরো অবিশ্বাস্য।

কোটার পক্ষে থাকার কারণে গত কয়েকদিনে আমাকে প্রচুর গালি শুনতে হয়েছে। যার অনেকগুলো ছাপার অযোগ্য। আমি না হয় চুনোপুটি সাংবাদিক। আমি গালি দেয়া না দেয়ায় কিছু যায় আসে না। কিন্তু জাফর ইকবালকে আন্দোলনকারীরা যে ভাষায় গালাগাল করছে, তা দেখে, লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায়।

দেখা যাচ্ছে, যারাই আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন, তারাই আন্দোলনকারীদের নোংরা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। আপনার যেমন আন্দোলন করার অধিকার রয়েছে, তেমনি যে কারো সে আন্দোলনের বিরোধিতা করারও অধিকার রয়েছে। সবাই আপনার পক্ষে থাকবে, এমন ভাবা কি ঠিক? ভিন্নমতের প্রতিও আপনার শ্রদ্ধা থাকতে হবে। আমি জানি, লেখাপড়া শেষ করে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি না পাওয়াই ক্ষুব্ধ করেছে তরুণ প্রজন্মকে। তাদের বেদনাটা, হতাশাটা আমি বুঝি।

অন্তর দিয়ে তা অনুভবও করি। তাদের আন্দোলন করার অধিকারের প্রতি এখনও আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা রয়েছে। কিন্তু যে তারুণ্য জাতীয় নেতাদের সম্মান করতে জানে না, যে তারুণ্য শিক্ষককে সম্মান করতে জানে না, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যাদের
হৃদয়ে আবেগ নেই, ভিন্নমতের প্রতি যাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধা নেই; যতই মেধাবী হোক, তাদের জন্য আমার করুণা হয়।

আপনার দাবির পক্ষে যুক্তি থাকলে অবশ্যই আপনি যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন। আর যুক্তি ফুরিয়ে গেলে দেবেন গালি। আন্দোলনকারীরা বরাবরই ভিন্নমতাবলম্বীদের অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে আসছেন।

আমি এই মেধাবী প্রজন্মের কাছে আরো উন্নত রুচি, আরো একটু আদব-কায়দা, পরমসহিষ্ণুতা, ধৈর্য্য, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা আশা করেছিলাম।
সাংবাদিক, কলাম লেখক; বার্তা প্রধান : এটিএন নিউজ।
probhash2000@gmail.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here