সাহিত্য একাডেমি’র ৯০তম আসর

0
752

পলি শাহীনা:
গত ২৫ মে জ্যাকসন হাইটসের একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো ‘সাহিত্য একাডেমি, নিউইয়র্ক ‘ এর মাসিক ৯০-তম আসরটি।

অনুষ্ঠানের শুরুতেই সাহিত্য একাডেমির পরিচালক মোশাররফ হোসেন সবাইকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানিয়ে সদ্য প্রয়াত প্রফেসর নুরুল ইসলামের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। এসময়ে তিনি জানান, রমজান মাসে সময়সূচী পরিবর্তনের জন্য এবারের আসরে লেখকদের স্বরচিত পাঠের সুযোগ করে দেওয়া সম্ভব হবেনা। তবে আজ আমরা কাজী নজরুল ইসলাম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন উপলক্ষে গুণীজনদের কথা শুনবো।

এরপরেই নজরুলকে নিয়ে কথা বলেন সংগীতজ্ঞ মোত্তালিব বিশ্বাস। উল্লেখ্য, ২৫ মে ছিল বিদ্রোহী কবির ১১৯তম জন্মদিন। তার পরেই রবীন্দ্রনাথের ‘শিক্ষা ভাবনা’ নিয়ে কথা বলেন ডক্টর আতিউর রহমান।

২৫ বৈশাখ ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। সাহিত্য একাডেমির এবারের আসরে আমন্ত্রিত অতিথি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, রবীন্দ্র গবেষক ডক্টর আতিউর রহমান কবির জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই আসরে তাঁর নির্ধারিত বিষয়বস্তু রবীন্দ্রনাথের “শিক্ষা ভাবনা”র উপরে বক্তব্য রাখেন। আলাচনার প্রারম্ভেই তিনি বলেন, আজ তৃতীয়বারের মত এসেছি সাহিত্য একাডেমিতে।এখানে যে ছোট্ট বাংলাদেশ দেখছি এমন বাংলাদেশ সারা বিশ্বের চারপাশে ছড়িয়ে আছে। বিশ্বাস করি বাংলাদেশ আরো অনেকদূর এগিয়ে যাবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুলের জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, তাঁর কাজের আরো গভীর চর্চা প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কাজ করায় নজরুল সম্পর্কে ব্যাপক জানা হয়নি। তবে দু’জনের মধ্যে যে গভীর মিল রয়েছে তা নিয়ে কাজ করছি।
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা ভাবনা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আতিউর রহমান বলেন বাংলাদেশে বড় দূর্যোগ ঘূর্ণিঝড় নয়, দেশের বড় দূর্যোগ হলো শিক্ষাক্ষেত্র। শিক্ষার হার বাড়ছে কিন্তু মান বাড়ছে না। “পৃথিবীটা আমার শিক্ষালয় ” উদ্ধৃতিটি টেনে আতিউর রহমান বলেন রবীন্দ্রনাথ গতানুগতিক ছিলেন না। তখনকার সময়ে এলিট শ্রেণীর মানুষ যখন তাঁদের সন্তানদের কেমব্রিজ, অক্সফোর্ডে পাঠাতেন অন্যান্য শিক্ষার জন্য তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেকে কৃষি বিষয়ে শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যা সে সময়ে ছিল বিরল। নিজের সমাজের ভেতরে যে শক্তি রয়েছে সে বিষয়ে প্রাকটিক্যাল এবং থিওরিক্যাল শিক্ষা অর্জন করা দরকার। লেখালিখির পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ কাজের মানুষ ছিলেন। নারী শিক্ষার জন্য কাজ করেছেন। তরুণরা তাঁর শিক্ষায় বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। পূজোর ছুটিতে তরুণরা বাড়ী আসলে তাঁদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বসতেন এবং গ্রামের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। তিনি সৃজনশীল শিক্ষা ব্যবস্থা চেয়েছেন। পুরো বিশ্বের সাথে ছেলেমেয়েদের পরিচয় এবং তাঁদের জ্ঞানের জানালা খুলে দেওয়া শিক্ষকদের কর্তব্য বলে মনে করতেন। রবীন্দ্র শিক্ষা ভাবনায়, গুরুজনকে পিতামাতা না হলে চলেনা। বিলেতে ইংরেজদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করে “ভারতবর্ষের ইতিহাস ” প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, সেখানকার ছেলেমেয়েরা আলোক, আলোচনা এবং খেলা হতে বঞ্চিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথ প্রাথমিক শিক্ষার উপরে জোর দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, সাহিত্যে বিজ্ঞান চর্চা আসা উচিৎ। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর সাথে এই বিষয়ে অনেক কাজও করেছেন।

রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেমন শিক্ষা চাই? উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘ জীবন আর শিক্ষা কি আলাদা হতে পারে? যেমন জীবন চাই তেমন শিক্ষা চাই। শিক্ষার মাধ্যমে সভ্যতার মহাসড়কে উঠা যায়। ‘ রবীন্দ্র ভাবনার আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থায় জীবনের স্পষ্টতা থাকতে হবে। কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, কোথায় যাব তা ঠিক করা দরকার।
ডক্টর আতিউর রহমানের মতে, শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক করা দরকার যা রবীন্দ্র ও নজরুলের ভাবনার আলোকে আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষা ব্যবস্থাকে উন্নত করা যেতে পারে। তাঁদের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবনা আমাদের নিরন্তর শক্তি ও সাহস যোগাবে।
আবৃত্তিকার মুমু আনসারীর দরাজ কন্ঠে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সুনেত্রা ঘটকের লেখা পাঠ আসরে উপস্থিত সবাইকে বিমোহিত করে রেখেছিল।

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সংগীতজ্ঞ মোত্তালিব বিশ্বাস বলেন, কবির কাব্য চর্চা হয়না বললেই চলে। কবির প্রায় আড়াই হাজার গানের মধ্যে মাত্র পাঁচশত গান গাওয়া হয়। নজরুল মেলার নামে আত্মপ্রচার চালানো হয় যা খুবি দু:খজনক। নজরুলের সৃষ্টির মধ্যেই নজরুল আছে। তাঁকে খুঁজতে হবে তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই। নজরুলের রচনা পড়লে তাঁকে খুব সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। অনেক আবৃত্তিকার আছেন যাঁরা কবিতার অর্থ না বুঝেই আবৃত্তি করেন। তিনি বলেন গানের চেয়ে এখন বাদ্যযন্ত্রের আধিপত্য বেশী। গান শুনি, তাল শুনি, বাজনা শুনি কিন্তু গানের অর্থ বুঝিনা। নজরুলের গানেরও সঠিক চর্চা হয়না। যা হয় তাও বণিক বৃত্তি। তারপরও আমি আশাবাদী এজন্য যে নজরুলকে জানার চেষ্টা হচ্ছে।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আসরে কবি কাজী নজরুল ইসলামের “মানুষ” কবিতার অংশবিশেষ আবৃত্তি করে শুনান গোলাম মোস্তফা।

রবীন্দ্র গবেষক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর আতিউর রহমান সম্পর্কে ছড়াকার মনজুর কাদের বলেন, বাংলাদেশে সোনালি ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় তাঁর তীক্ষ্ণতা বুঝতে পেরেছি। দেশে অনেক জাঁদরেল কর্মকর্তা আছেন যাঁদের আমরা মনে রাখিনা। মনে রাখি তাঁদের যাঁদের মনে মমতা আছে। ডক্টর আতিউর রহমানকে আমরা মনে রেখেছি। তিনি আপাদমস্তক একজন রবীন্দ্র বিশারদ। তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন – সাহিত্য একাডেমিতে আপনার সৌরভ পেয়ে গর্ববোধ করছি।

কথাসাহিত্যিক ফেরদৌস সাজেদীন সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, নিউইয়র্ক শহরে নানান উৎসব হচ্ছে। আমরা উৎসবের মধ্যে বাস করি। এতকিছুর ভীড়েও সাহিত্য একাডেমির আসরটি অনন্য সাধারণ উৎসব হয়ে আছে। এখানে কবিতার চাষ হয়। কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়। আমরা একটি পরিবারের মত মিলেমিশে আছি।

হলভর্তি রমজান মাসের এই গুরুত্বপূর্ণ আসরে উপস্থিতির মধ্যে অন্যতম , তমিজ উদ্দীন লোদী, আহমাদ মাযহার, আদনান সৈয়দ, এম.এ আজিজ, ওয়াসি চৌধুরী, শাহ মাহবুব, ফরিদা ইয়াসমিন, নীরা কাদরী, মুমু আনসারী, এনি ফেরদৌস, রাহাত কাজী শিউলি, পপি কুলসুম, মনিজা রহমান, শিরীন বকুল, আবু সাঈদ রতন, ইশতিয়াক রুপু, খালেদ শরফুদ্দীন, শাহীন ইবনে দিলওয়ার, আনোয়ার হোসেন লাভলু, মিশুক সেলিম, কামাল হোসেন মিঠু, এবিএম সালেহ উদ্দীন, মাসুম আহম্মেদ, নাসিমা আক্তার, সালেহীন সাজু, তাহমিনা সাঈদ,লুৎফা শাহানা, ওয়াহেদ হোসেন, মোহাম্মদ ফজলুর রহমান, বেনজির শিকদার, নাসির উদ্দীন, ফারজানা ইয়াসমিন, সুতপা মন্ডল, পল্লব সরকার, সবিতা দাস, লুবনা কাইজার, দীপু চৌধুরী, সিরাজ উদ্দীন সোহাগ, আনোয়ার সেলিম, পারভীন পিয়া, লিয়াকত আলী এমপি, উইলি মুক্তি, মেহের চৌধুরী, রিমি রুম্মান, লুছি হাসান, ডলি, হ্যাপি জীবন, কামরুন নাহার রীতা, ফজলুর রহমান, শফিক আহম্মেদ, সৈয়দ জুয়েদ আহম্মেদ, স্বপ্ন কুমার, আবু রায়হান, ওবায়েদউল্লাহ মামুন, এইচ বি রিতা, শওকত রিপন, দানিয়েল, শহীদ উদ্দীন, ক্লারা রোজারিও, পলি শাহীনা।

সাপ্তাহিক ঠিকানা পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ফজলুর রহমান আসরে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানান।
কবি কাজী আতিকের দোয়া এবং মোনাজাত শেষে ইফতার পরিবেশনের মাধ্যমে চমৎকার ভালোবাসায় মোড়ানো আসরটির সমাপ্তি টানা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here