আশা-নিরাশা

0
254

সাহিদা খান বর্ষা

আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা, চাঁদটাকেও ভালোভাবেও দেখা যচ্ছে না, কখনও মেঘের গভীরে ডুবে যাচ্ছে আবার আবছা আলোয় ভেসে উঠছে কিন্তু ওর কাছে মনে হচ্ছে তলিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে। আজ আকাশে তারা নেই সুবর্ণার মনে হচ্ছে চাঁদও ওর মতো একা। আশা নিরশায় ভাসছে।

কত বছর হয়ে গেল ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলছে। আট বছর বয়স তমালের, সারাক্ষন মনে প্রশ্ন আর প্রশ্ন। এটা হল কেন ওটা হল কেন। সবার বাবা আছে আমার নেই কেন। সবাই নিজেদের বাসায় থাকে আমরা নানু বাসায় থাকি কেন, সুবর্ণা বুঝিয়ে বলে । সুবর্ণা চায় ছেলেটা বাবার মত বাস্তব বাদী হোক। ওর মতো কল্পনা প্রবন নয়, দুঃখকে সইবার ক্ষমতা তৈরি হোক ওর ভেতর। জীবন মানেই যুদ্ধ, যেমন কাল স্কুল থেকে ফেরার পথে তমাল বলছিল ।
– মামুনি জান কালকে তন্ময় আর নিশাত সুন্দর গাড়ি কিনেছে।
– তোমার কি কিনতে ইচ্ছে করছে?
– হ্যা, মামনি।
– কিন্তু তোমার তো অনেকগুলো গাড়ি আছে, চাচ্চু দিয়েছে, ছোট মামা দিয়েছে বিদেশ থেকে।
– হ্যা, দিয়েছে কিন্তু ওদের গাড়িগুলো অন্যরকম।
– কিন্তু বাবা আমাদের তো এত টাকা নেই। সামনের মাসে খালামনি টাকা পাঠাবে তখন কিনে দেব। কিন্তু তার জন্য তো পড়ালেখা অনেক করতে হবে।
– লেখাপাড়া করিতো ।
– আমার সোনা বাবাটা অনেক লেখাপড়া করে। স্কুলে প্রথম হয়, মা ও ছেলে কথা বলতে বলতে প্রায় বাড়ির কাছে চলে আসে।

সুবর্ণা ছেলের কারনে কোন চাকরিতে ঢুকতে পারছে না স্কুলে আনা নেওয়া কে করবে। দুটো টিউশনি করে আর ভাই বোনদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা নিতে হয়। নিজেকে পরগাছা মনে হয় ইদানিং আবার মাঝে মাঝে শামুক মনে হচ্ছে যেন খোলসের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে, গুটিয়ে যাচ্ছে। বাবার সংসারে এসেছে পাঁচ বছর হতে চলল আগে ছোটদের শাসন করা, কোন কিছু খেতে ইচ্ছে করলে আবদার করা। পরিবেশ পরিস্থিতি সময়ের অনেক কিছুই পাল্টে দেয়। আগে বাবা ছিল, বোনদের বিয়ে হয় নি, এখন বাবা নেই, বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইয়েরা বিয়ে করেছে। তাদের সন্তান হয়েছে, নিজেদের সংসার হয়েছে যদিও সবাই একসাথে আছে। সংসারে কারও কোন ভুল হলে চুপ করে থাকে সুবর্ণা। ভাবে, আমি কি বলব, আমি নিজেইতো একটা বোঝা। তরকারিতে ঝাল, লবন কম-বেশি হলেও কিছু বলেনা যে সুবর্ণা একসময় বলত, এটা ওর অভ্যাস ছিল। বললে যদি সংসারে কোন অশান্তি হয় এটা মনে করেই কিছু বলে না।

এইতো সেদিনের কথা, শামীম অফিস থেকে এল। সুবর্ণা দরজা খুলে অবাক হলো, দরজা খুললেই একটা হাসি দিয়ে ঘরে ঢোকে শামীম। আজ কোন হাসি নেই বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না। সময়টা ছিল দুপুর দুইটা ত্রিশ মিনিট। খাবার খেয়ে আবার হাসি খুশি, সুবর্ণার ছোট বোনের জামাই কানাডা থেকে ফোন দিয়েছিল ওটাই বলছিল শুয়ে শুয়ে। আর সুবর্ণা পায়ের কাছে বসে শুনছে। হঠাৎ করে এক ঝটকায় বসে পড়ল শামীম।
– কি হয়েছে
– বুকটা যেন কেমন করে উঠল।
– খুব খারাপ লাগছে?
– না এখন ভালো লাগছে বলে হেসে ফেলল।
সুবর্ণা কিচেনে যাবে কারণ শসার খোসা গুলো ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হয়নি। তখন ডিসেম্বর মাস অল্প অল্প শীত তাই খাট থেকে নামার সময় কাঁথাটা শামীমের শরীরে দিয়ে দেয়। শামীম হাসতে থাকে, সুবর্ণা শামীমের কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে বলে ।
– হাসছো কেন।
– এমনি।
– হাসতে হাসতে সুবর্ণা বলে তুমিতো আমার স্বামী তাই না, বলে কিচেনে চলে যায়। না আর কিছু মনে করতে চায় না সুবর্ণা। ওর বিয়ে হয়েছিল দেখতে এসে, পাঁচ ঘন্টায়। আর সংসার শেষ হয়ে গেল চার ঘন্টায়। পরে জেনেছিল শামীমের কলিগরা বলেছিল অফিসে যাওয়ার পর থেকেই বুকে ব্যাথা ছিল। সুবর্ণা সরকারি কোয়ার্টারে থাকতো টিপ-টপ সাজানো গোছানো, ও সুখ শান্তি হাসি খুশিতে ভরা ছিল ওর সংসার। কখন যে তমাল এসে দাড়িয়েছে খেয়াল করে নি।
– মামনি আমরা কি গরিব ।
– না, বাবা।
– তাহলে আমাদের টাকা নেই কেন। তন্নী আপু যে বলল যাদের টাকা নেই তারাই গরীব। কথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে সুবর্ণা বলে যে পড়া দিয়েছিলাম ওগুলো কমপ্লিট হয়েছে?
– হয়েছে, আমি নানুমনির সাথে গল্প করছিলাম। নানুমনি নামাজ পড়তে গেল। মামনি আমাকে পড়াবে না?
– আসছি, তুমি যাও। শামীমের ইচ্ছে ছিল তমালকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াবে সেটা হলো না অনেক টাকার ব্যাপার তবে এখন যে স্কুলে পড়ছে ওটাও ভালো। তাছাড়া তমাল ক্লাসের ফাস্ট বয়। না, ওকে আর শামুকের মতো গুটিয়ে গেলে চলবে না। নিজের জন্য, তমালের জন্য এই ভাঙ্গাচোড়া পথ পেরিয়ে সুমসৃন পথে পৌছাতে হবে — — — ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here