স্কুল সার্টিফিকেট, ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলার এজাহার, আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি সব জায়গায় ধর্ষণের শিকার কিশোরীর বয়স ‘১৫ বছর’। সেই কিশোরীকেই বিয়ে করবেন এমন প্রতিশ্রুতিতে গ্রেপ্তারের মাত্র আট দিনের মাথায় জামিন পেয়েছেন রূপগঞ্জে স্কুলছাত্রী ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার আসামি কারারক্ষী মৃদুল হোসাইন।

সোমবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিন শুনানি শেষে বিচারক আনিসুর রহমান আসামির সাত দিনের জামিন মঞ্জুর করেন। জামিনপ্রাপ্ত আসামি মৃদুল হোসাইন কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের একজন কারারক্ষী।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী খোকন জানান, আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রব ওই কিশোরীকে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে আদালতে হলফনামা উত্থাপন করেছেন। আদালত সেটা আমলে নিয়ে ওই কিশোরীর বাবা, মা ও আসামির পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কিশোরীর সঙ্গে আসামির বিয়ের জন্যই জামিন মঞ্জুর করেছেন।

গত ২৬ জানুয়ারি রূপগঞ্জ থানায় ওই কিশোরীর মায়ের করা মামলার এজাহারে দেখা যায়, ২৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থী (১৫) তার নানাবাড়িতে ওয়াজ শুনতে এসে ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় রূপগঞ্জ কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ছাতিয়ান এলাকার মৃদুল হোসেইন, সিয়াম মিয়া ও নিজাম উদ্দিনকে আসামি করে মামলা হয়। ২৭ জানুয়ারি বিকেলে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে মামলার প্রধান আসামি মৃদুল হোসাইন গ্রেপ্তার হন।

আদালতে দেওয়া হলফনামায় দেখা যায়, দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীর এক দিন আগে বয়স তিন বছর বেশি ছিল। হলফনামা মতে, গত ২৪ জানুয়ারি উভয় পরিবারের সম্মতিতে ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে নারায়ণগঞ্জের নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে মৃদুল ও ওই কিশোরীর বিয়ে হয়। হলফনামায় দশম শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীর বয়স দেখানো হয় ১৮ বছর। তবে ওই কিশোরীর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা সনদ ও আদালতে দেওয়া ২২ ধারার জবানবন্দি অনুযায়ী বয়স ১৫ বছর।

ধর্ষণের এক দিন আগে কেমন করে ওই কিশোরীর বয়স তিন বছর বেড়ে গেল? জানতে চাইলে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুর রব প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না। নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহসিন ভালো বলতে পারবেন।’ এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মোহসিন বলেন, ‘বারের সেক্রেটারি হিসেবে আজকে অন্তত ৩০টি মামলার পক্ষে দাঁড়িয়েছি। মামলাটা আমার না হওয়ায় এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই বলতে পারছি না।’

ওই কিশোরীর নানার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কিশোরীর মা কারারক্ষীর বিরুদ্ধে মামলা করার পর থেকেই বিষয়টি আপস মীমাংসার প্রস্তাব আসতে থাকে বিভিন্ন মহল থেকে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘জামিনে সুবিধা করার জন্য ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে কোর্টে ওদের বিয়া হইছে। কথা হইছে ছেলে পক্ষ মাইয়ারে ৮ শতাংশ জমি লিখে দিব। মামলার অন্য দুই আসামি মোট ছয় লাখ টাকা জরিমানা দিব।’ অপ্রাপ্তবয়স্ক একজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কীভাবে বিয়ে হলো? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যা করার অ্যাডভোকেট করতাছে।’ একজন ধর্ষণের আসামির সঙ্গে কেন বিয়ে দেওয়া হলো? এ প্রশ্নের জবাবে নানা বলেন, ‘ওসি সাহেব আর এসআই (মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা) যেভাবে বলছে, সেভাবেই কাজ হইছে। এর বাইরে যাওয়ার তো উপায় নাই।’

সোমবার বিকেলে ওই কিশোরীর পৈতৃক বাড়িতে গেলে কথা হয় কয়েকজন আত্মীয়ের সঙ্গে। পুলিশের মধ্যস্থতায় দুপক্ষের আপস মীমাংসা হয়েছে বলে তাঁরা জানান।

তবে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আপস-মীমাংসা কিংবা আসামির জামিন কোনো কিছু সম্পর্কেই আমার জানা নেই।’ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার এসআই ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘মীমাংসার কথা শুনেছি। তবে এ বিষয়ে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ ছিল না।’

মহিলা পরিষদ নারায়ণগঞ্জ জেলার সভাপতি লক্ষ্মী চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধর্ষণ এখন একটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ওই কিশোরীর পরিবার রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাইতে আসে ঠিকই, কিন্তু আমাদের সামাজিক অবস্থা ও ন্যায়বিচারের অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আসামির সঙ্গে আপস-মীমাংসায় বাধ্য হয়। এর ফলে সমাজে ধর্ষণ আরও উৎসাহিত হচ্ছে।’

নারী সংহতি নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক পপি রানী সরকার বলেন, ‘এমন ঘটনার পর মনে হয় আমাদের সকল আয়োজনই যেন ধর্ষণের আসামিকে বাঁচানোর পক্ষে। বিয়ে দিয়ে হোক কিংবা আপস-মীমাংসা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন।’

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ওয়াজেদ আলী খোকন প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হলে এ বিষয়ে নতুন করে মামলা হবে। রাষ্ট্রীয় আইন ও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে ওই কিশোরী এবং তার পরিবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আপস মীমাংসায় বাধ্য হয়। আইনের সংশোধনের মাধ্যমে এমন ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here