নিজের মত করে একটি দিন

0
114

পপি চৌধুরী :
এদেশে আসার প্রথম দিকে এখানকার মানুষগুলিকে দেখে কেমন যেন যান্ত্রিক মনে হতো। মনে হতো, সবাই কেন এত ব্যস্ত, আমি কোনদিন এমন ব্যস্ত হবো না। সেই আমার ঘুম ভাঙ্গে এখন ভোর পাঁচটায়, সাতটায় বের হতে হয় বাসা থেকে। জব শেষে ক্লাশ সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। রান্না, রাতের খাবার, হোমওয়ার্ক সেরে ঘুমাতে রাত ২/৩টা। শনি/রবি দু’দিন ছুটি থাকলেও কলেজের বিভিন্ন সোশাল ওয়ার্কে জড়িত থাকার কারণে অধিকাংশ শনিবারও হাজিরা দিতে হয় কলেজে। তার ওপর পত্রিকা প্রকাশ, বইপ্রকাশনা অনুষ্ঠান এবং এই সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা- সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।

কয়েক দিন পূর্বে বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানটি ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হয়েছে, পরীক্ষাও শেষ। আজ ছিল রেজাল্ট প্রকাশের দিন, যদিও কিছুটা আভাস আগেই পেয়েছিলাম তবুও হাজিরা দিতে গেলাম কলেজে। চারটা সাবজেক্ট ছিল এই সেমিস্টারে। তিনটাতে ‘এ’ পেয়েছি কিন্তু বইপ্রকাশনা অনুষ্ঠানের আগের দিন যে পরীক্ষাটি ছিল সেটিতে ‘বি’। কারণ পরীক্ষার পূর্বে যতবার বইয়ের পাতায় চোখ মেলেছি ততবারই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে অনুষ্ঠানের কথা, মাথায় অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই ছিল না। ফলাফল ‘বি’। গত সেমিস্টারে চারটি সাবজেক্টের চারটিতেই ‘এ’ ছিল। মনকে সান্তনা দিলাম- ‘মানুষ নিজের ভালোবাসার জন্য, নিজের শখের জন্য কত কিছুই তো করে, আমি না হয় এইটুকু সেক্রিফাইস করলাম! কারণ অনুষ্ঠানটি এখন না করলে আর সহসা করার কোন সুযোগ ছিল না।

১৪ জুন থেকে শুরু হচ্ছে মুক্তধারা আয়োজিত নিউইয়র্ক বইমেলা। ২০০৮ সাল থেকে নিয়মিত এই বইমেলায় অংশ নিয়ে আসছে ‘প্রীতম প্রকাশ’, কেবল গতবছর অংশ নিতে পারেনি কোন বই ছিলনা বলে। সেজন্য মনটা খুব খারাপ হয়েছিল গতবার। এবার মুক্তধারার মাধ্যমে বই আসছে বাংলাদেশ থেকে, তাই কিছুতেই আর মিস করতে চাইলাম না এবারের বইমেলাটি। মেলা শেষ না হতে হতেই ১৭ জুন থেকে শুরু হবে নতুন ক্লাশ। আর তাইতো পরীক্ষার মধ্যেই রিস্ক নিয়ে আয়োজন করতে হলো বইপ্রকাশনা অনুষ্ঠানটির। তবে একটি সাবজেক্টে ‘বি’ পাওয়ার মনোকষ্ট কিছুটা লাঘব হলো যখন কলেজের ASAP থেকে মেট্রোকার্ডের জন্য ৬০০ ডলারের ভাউচার এবং বই ক্রয়ের জন্য ৩০০ ডলার ক্যাশ পেলাম। মনটা আনন্দে ফুরফুরে হয়ে গেলো। ভাবলাম, না, আজ আর ঘরে ফিরবো না এখনই, আজকের দিনটি কাটাবো নিজের মত করে।

কলেজ থেকে বের হয়ে ৩২ নম্বর বাস ধরে চলে এলাম জ্যাকসন হাইটস। এলামেলো ঘুরলাম অনেকক্ষণ। একসময় পেট জানান দিল- রসদ চাই। চলে গেলাম আমার প্রিয় ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’তে। একটি নেপালী পরিবার চালায় ছোট্ট রেস্টুরেন্টটি। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন, কম তেল-মশলায় রান্না করা সুস্বাদু খাবার। অর্ডার দিলাম ‘গোট্ থালি’র। আধাসেদ্ধ রাইশাক ভাজা, পাঁচমিশালী সব্জি, পাপড়, মাশকলাই ডাল, খাসির মাংস ভুনা, সাথে কয়েক পদের আচার ও চাটনি এবং ছোট্ট এক বাটি চিকেন স্যুপ। অমৃতের মত লাগলো প্রতিটি খাবারের স্বাদ।

কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে বের হয়ে গেলাম আমার পছন্দের গুজরাটি বিউটি পার্লারটিতে। তিনমাস হতে চলল এ পথ মাড়ানো হয়নি। মাঝে মধ্যে নিজের প্রতিও তো একটু যত্ন নিতে হয়। পার্লার থেকে বের হয়ে বাঙালি গ্রোসারীর সামনে দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়লো টাটকা লাউ। আমার স্বামীর খুব পছন্দের সব্জি। গোপনে নখ ফুটিয়ে পরীক্ষা করে কিনে নিলাম কচি দেখে একটি, সাথে ধনেপাতা। বাসায় যেহেতু চিংড়ি মাছ আছে তাই আর চিংড়ি কেনার দিকে গেলাম না। তারপর? তার আর পর নেই, আছে শুধু আমার ছোট্ট ঘর।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here