সেমিফাইনালে খেলার আশা আগেই শেষ। তবু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের রক্ত খলবলিয়ে উঠছিল। শেষ ম্যাচটা পাকিস্তানের বিপক্ষে। এটা আবার প্রিয় ক্যাপ্টেন মাশরাফী বিন মোর্ত্তজার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। ক্রিকেটের তীর্থভূমি লর্ডসে ওয়ানডে অভিষেকও রাঙিয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল। ’৯৯ বিশ্বকাপ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির প্রেরণা ছিল। কিন্তু কোনোটাই হলো না। পাকিস্তানকে হারিয়ে মাশরাফীকে স্মরণীয় বিদায় দেওয়ার আবেগ মুখ থুবড়ে পড়ল ব্যাটিং ব্যর্থতায়। বাংলাদেশের অসাধারণ বিশ্বকাপ মিশন হোম অব ক্রিকেটে শেষ হলো ৯৪ রানের হারে।
মোস্তাফিজুর রহমান ৫ উইকেটে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লর্ডসের ওয়ানডে অনার্স বোর্ডে নাম উঠিয়ে নায়ক। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন ইয়র্কার মাস্টার হয়ে উঠে আবার ৩ উইকেট নিলেন। সাকিব আল হাসান আর মেহেদী হাসান মিরাজের স্পিন রানের স্রোত আটকাচ্ছিল। তারপরও অসম্ভব এক লক্ষ্য নিয়ে খেলতে নেমে পাকিস্তানের ৯ উইকেটে ৩১৫। ৩২২-এর লক্ষ্যপূরণ করে এই বিশ্বকাপে জেতার রেকর্ড বাংলাদেশকে সাহস জোগাচ্ছিল। কিন্তু অবিশ্বাস্য ধারাবাহিক সাকিবের ব্যাটের সঙ্গে এই শেষ ম্যাচেও সঙ্গত করার কেউ মিলল না। ৬০৬ রান নিয়ে এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি রানের তালিকায় তৃতীয় সাকিব। শচীন টেন্ডুলকার (৬৭৩), ম্যাথু হেইডেনরা অবশ্য (৬৫৯) ১১টি করে ম্যাচ খেলেছিলেন। এই আসরে সাকিবেরই সর্বোচ্চ। এদিন ৭৭ বলে ৬ চারে ৬৪ রান তার। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সাকিবের (১২টি) চেয়ে বেশি পঞ্চাশ পেরুনো ইনিংস আছে কেবল টেন্ডুলকারেরই। সাকিবের ২০১৯ বিশ্বকাপ শেষ ৮ ম্যাচে (বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়াটি বাদে) ২ সেঞ্চুরি ও ৫ ফিফটিতে।
সেমিতে খেলতে বাংলাদেশকে অন্তত ৭ রানের মধ্যে অল আউট করা দরকার ছিল পাকিস্তানের। তা সম্ভব না বলে তারা আউট। কিন্তু এই ম্যাচে অসম্ভব সতর্ক পাকিস্তান বোলিংয়ে দারুণ শুরু পেল। মোহাম্মদ আমিরের বলে সৌম্য সরকারকে শুরুতে জীবন দিলেন হারিস সোহেল ক্যাচ ফেলে। কিন্তু সৌম্য তা কাজে লাগাতে না পেরে ব্যক্তিগত ২২ রানে আমিরের বলেই ক্যাচ দিয়ে ফেরেন। তামিম ইকবাল (৮) শাহীন শাহ আফিদির স্লোয়ারে বোল্ড। ৪৮ রানে ২ উইকেট হারানোর পর মিস্টার ধারাবাহিক মুশফিকুর রহিমও (১৬) বেশিক্ষণ টেকেন না।
সাকিবের সঙ্গে লিটন দাসের (৩২) একটা জুটি হবে মনে হয়। এমন সময় আফ্রিদির চাতুর্যে কমিয়ে দেওয়া গতির বলকে শেষে খেলব কি খেলব না করে ড্রাইভে তুলে দিয়ে বিদায় লিটনের। ৫৮ রানের জুটিটা অঙ্কুরে মরল। সাকিব বল না তুলে মাটিতে খেলে নিরাপদে এগিয়ে ৬০০ পেরিয়ে গেলেন। চোখ তার আরও বড় কিছুতে।
কিন্তু ১৯ বছরের আফ্রিদি দুর্দমনীয় হয়ে ওঠেন। সাকিব কাট করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন। মাহমুদউল্লাহ-মোসাদ্দেক জুটি জমতে জমতে ভাঙে। তখন ১ রানের মধ্যে ৩ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। এক ওভারে মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন (০) ও মাহমুদউল্লাহকে (২৯) তুলে নিয়ে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড গড়ে লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখান আফ্রিদি। ১৯৮ রানে ৮ উইকেট হারানো বাংলাদেশের তখন শেষ ৯ ওভার কাটানো দায়! মাশরাফীর (১৫) দুই ছক্কা কেবল সমর্থকদের উষ্ণতা বাড়ায়। ফিজকে (১) শিকার করে বাংলাদেশকে গুটিয়ে দিয়ে আফ্রিদি হয়ে যান বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সেরা বোলিং ফিগারের (৯.১-০-৩৫-৬) মালিক।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ভবিষ্যতে নিশ্চিতভাবে অনেক গৌরবের অর্জন যোগ হবে। কিন্তু কাটার মাস্টার মোস্তাফিজুর রহমানের নাম ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর লর্ডসে সবার ওপরে জ্বলজ্বল করবে। অবশ্যই ওয়ানডেতে। ১০-০-৭৫-৫। লর্ডসে ৫ উইকেটের কীর্তিতে বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে খেলোয়াড় হিসেবে ফিজের নাম উঠল অনার্স বোর্ডে। ২৩ বছরের বাঁহাতি বিস্ময় বিশ্বকাপে টানা দুই ম্যাচে ৫ উইকেট নেওয়ার কীর্তি গড়লেন।
বিপজ্জনকভাবে রান বাড়তে থাকা পাকিস্তানের ইনিংসকে শেষে মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন ‘ফিজ’। ডেথ ওভার মাস্টার শেষ দুই ওভারে নিয়েছেন ৩ উইকেট। ম্যাচের ৪৪তম ওভারে আরেকটি। প্রথমটি ৪২তম ওভারে। সেটাও সেঞ্চুরিতে অনার্স বোর্ডে নাম ওঠানো ওপেনার ইমাম-উল-হকের (১০০) উইকেট। শেষ ১০ ওভারে ৮৫ রান তুলতে যে ৭ উইকেট হারিয়েছে পাকিস্তান তার ৫টি ফিজের।
এর মধ্যে শাদাব খানকে (১) নিজের বলে যেভাবে তালুবন্দি করেছেন তা টুর্নামেন্টের সেরা ক্যাচের একটি। শাদাবের ডিফেন্সে ফিরে আসা বল নিজের বাঁ-পাশে আড়াআড়িভাবে ঝাঁপিয়ে পিচের ঠিক ওপর থেকে হাতে জমিয়েছেন ফিজ।
বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ পাঁচবার ম্যাচে ৫ উইকেট শিকারের রেকর্ড এখন ফিজের। চলমান বিশ্বকাপ শেষ করলেন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি (২০টি) হিসেবে। ৫৪ ম্যাচে ১০০ উইকেটের মাইলফলক পেরিয়ে এখন তার শিকার ১০৩। সবচেয়ে কম ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে ১০০ উইকেটের রেকর্ড তার। ইতিহাসে এই রেকর্ডে চতুর্থ স্থানে নাম। এক বিশ্বকাপ খেলেই ফিজ বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ উইকেটশিকারি। এক আসরে দেশের সর্বোচ্চ শিকারের রেকর্ড গড়েছেন আগেই। কাল চার টুর্নামেন্ট খেলে বিশ্বকাপ ক্যারিয়ারের ইতি টানা মাশরাফীকে এক টুর্নামেন্ট খেলেই ছাড়িয়ে গেলেন ফিজ, বিশ্বকাপে দেশের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ডে।
মাশরাফী এদিন সাত ওভারে ৪৬ রান দিয়েছেন। উইকেট পাননি। ক্যারিয়ারে এই প্রথম টানা পাঁচ ম্যাচ থাকলেন উইকেটশূন্য। এদিন নিয়তি একটা লাইফলাইন দিয়ে পাকিস্তানকে টস জিতিয়েছে। কিন্তু বিশ্বরেকর্ড গড়া ব্যবধানে জিতে সেমিতে যেতে যে সমীকরণ পাকিস্তান সেই লড়াইয়ে নামতে পারেনি কখনো। মেহেদী হাসান মিরাজকে (১০-০-৩০-০) দিয়ে শুরু করে ক্যাপ্টেন মাশরাফী সফল। নিজের নতুন বলটা সাইফউদ্দিনের (৯-০-৭৭-৩) হাতে তুলে দিয়েও ভালো হলো। মাঝে সাকিব আল হাসান (১০-০-৫৭-০) ও মিরাজ রানের চাকায় বাঁধ দিয়েছেন।
অষ্টম ওভারে সাইফউদ্দিনের অফ স্টাম্পের বাইরের বল খেলে পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ফখর জামান (১৩)। ইনফর্ম বাবর আজম এক বিশ্বকাপে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডে জাভেদ মিয়াঁদাদকে (১৯৯২-এর বিশ্বকাপে ৪৩৭ রান) ছাড়িয়ে গেলেন। তারপরই মোস্তাফিজের বলে ৫৭ রানে দাঁড়িয়ে ক্যাচ তুললেন। মোসাদ্দেক হোসেন সহজ ক্যাচ ছাড়েন। তাতে ইমামের সঙ্গে ১৫৭ রানের জুটি গড়ে সেঞ্চুরির কাছে বাবর। সাইফউদ্দিন তা হতে দেননি। এলবিডব্লিউর শিকার বাবর ৯৮ বলে ৯৬ নিয়ে ফিরেছেন।