জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতীয় শোক দিবস পালন: বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্ব বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা

0
932

নিউইয়র্ক, ১৫ আগস্ট ২০১৯:
আজ প্রথমবারের মতো জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের আয়োজনে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে যথাযোগ্য মর্যাদায় ও অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাৎ বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। স্থানীয় সময় সন্ধ্যে সোয়া ছয়টায় জাতিসংঘে কনফারেন্স রুম-৪ (চার) এ আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন জাতিসংঘের সদস্যদেশসমূহের স্থায়ী প্রতিনিধি, কূটনীতিক, জাতিসংঘের কর্মকর্তা, নিউইয়র্কস্থ যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার মানবাধিকার কর্মী, লেখক, চলচিত্র শিল্পী, টিভি উপস্থাপক, ফটোগ্রাফার এবং প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনেরা।
এর আগে সকাল ৯ টায় স্থায়ী মিশনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার মাধ্যমে জাতির পিতার ৪৪তম শাহাদাৎ বার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস পালনের কর্মসূচি শুরু করা হয়। এসময় ১৫ আগস্টের শহীদদের উদ্দেশ্যে মিশনের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারি একমিনিট নিরবতা পালন করেন। জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মাননীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রদত্ত বাণী পাঠ এবং ১৫ আগস্টের শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করার মাধ্যমে সকালের সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি শেষ হয়।
বিকেলে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে আয়োজিত শোক দিবসের মূল অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন। এসময় দেশী-বিদেশী অতিথিগণ জাতির পিতার স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে একমিনিট নিরবতা পালন করেন। এরপর জাতির পিতার জীবন ও কর্ম এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা তুলে ধরে একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। আলোচনা অনুষ্ঠানটিতে ‘বঙ্গবন্ধু ও বহুপাক্ষিকতাবাদ’ বিষয়ে কী-নোট স্পীচ প্রদান করেন জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন ভারত, সার্বিয়া ও কিউবার স্থায়ী প্রতিনিধি এবং প্যালেস্টাইনের স্থায়ী পর্যবেক্ষক। প্রবাসী বাঙালি সম্প্রদায়ের পক্ষে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান। সাংস্কৃতিক পর্বে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা ও গান পরিবেশন করা হয়। সবশেষে জাতির পিতা, বঙ্গমাতা এবং ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রিতে স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তির হাতে নৃশংসভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য এবং জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
রাষ্ট্রদূত মাসুদ তাঁর স্বাগত ভাষণে জাতির পিতা জনগণের ক্ষমতায়ন, মানবাধিকারের সুরক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি, গণতন্ত্র, শান্তি ও সহবস্থানের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা তুলে ধরেন।
জাতিসংঘ সদরদপ্তরে প্রথমবারের মতো জাতির পিতার শাহাদাৎ বার্ষিকীর এই অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, “আমরা আগামী বছর বিশ্বব্যাপী জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। সে উপলক্ষে জাতিসংঘ সদরদপ্তরে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হবে। পাশাপাশি ২০২১ সালে উদযাপন করা হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী”। এসকল অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে স্বত:স্ফুর্ত অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানান স্থায়ী প্রতিনিধি।
তিনি জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত বাণীর অংশ বিশেষ উদ্বৃত করে বলেন, “ঘাতকচক্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তাঁর স্বপ্ন ও আদর্শের মৃত্যু ঘটাতে পারেনি। আসুন, আমরা জাতির পিতা হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করি”।
জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ও জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে ‘ফ্রেন্ড অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ বা ‘বিশ্ব বন্ধু’ হিসেবে আখ্যা দেন। তিনি জাতির পিতার সাথে তাঁর কর্মজীবনের নানা ব্যক্তিগত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে তুলে ধরা, বহুপাক্ষিকতাবাদকে এগিয়ে নেওয়াসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু যে সকল অবদান রাখেন তার উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত আনোয়ারুল করিম চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু প্রদর্শিত পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’ ধারণ করেই বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতাবাদের অন্যতম প্রবক্তা হিসেবে বিশ্বসভায় ভূমিকা রেখে চলেছে”।



\

ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সৈয়দ আকবরউদ্দিন বাংলাদেশের সাথে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের উল্লেখ করে বলেন, “১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যখন ভারতবাসী তাদের অকৃত্রিম বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা জানতে পারে তখন ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ মুহূর্তেই বিষাদে রূপ নেয়”। বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শই আজ জাতিসংঘের বিভিন্ন কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হচ্ছে মর্মে উল্লেখ করেন তিনি। ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি বাংলাদেশকে উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “এটি সম্ভব হয়েছে কারণ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন”।
সার্বিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি মিলান মিলানোভিচ্ দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভিকা দাচিচ এর বাণী পড়ে শোনান। এই বাণীতে সার্বিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সাথে সাবেক যুগোশ্লোভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ ব্রোজো টিটোর যে বন্ধুত্ব ও গভীর সম্পর্ক তা তুলে ধরেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত উক্তি “বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি, আর আমার সবচেয়ে বড় দূর্বলতাও এটা যে আমি তাদেরকে অনেক বেশি ভালোবাসি” উল্লেখ করেন।
কিউবার রাষ্ট্রদূত আনা সিলভিয়া রদ্রিগেজ আবাসকাল তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে কিউবার দেওয়া অকুন্ঠ কূটনৈতিক সমর্থনের কথা তুলে ধরেন। নির্যাতিতের পক্ষে ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর অনন্য সাধারণ নেতৃত্ব, প্রচেষ্টা ও সাহসের কথা বলতে গিয়ে তিনি ১৯৭৩ সালে কিউবার মহান নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সেই বিখ্যাত উদ্বৃতি “আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি, তাই হিমালয় দেখার সাধ আর আমার নেই” উল্লেখ করেন।
প্যালেস্টাইনের স্থায়ী প্রতিনিধি রিয়াদ এইচ মনসুর ফিলিস্তিনী নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলেন, আজ ৪৪ বছর পর এই জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বার্ষিকী পালন করা হচ্ছে যা এই বিশ্বনেতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি অনন্য উদ্যোগ”।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সভাপতি ড. সিদ্দিকুর রহমান মুজিব শতবর্ষ উদযাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়সহ সকলকে একযোগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
বক্তাগণ বঙ্গবন্ধুকে সেই সময়ের বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা এবং বিশ্ব মানবতার মুক্তির প্রতিভূ ও বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। বক্তাগণ আরও বলেন বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ে জাতির পিতার সংগ্রাম ও ত্যাগ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে।
এদিকে গতকাল ১৪ আগস্ট স্থানীয় এলম্হার্স্ট হাসপাতালে পচাঁত্তরের ১৫ আগস্ট স্মরণে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচিতে স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন, নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মিজ্ সাদিয়া ফয়জুনেচ্ছা ও স্থায়ী মিশনের কর্মকর্তাগণ অংশগ্রহণ করেন।
এছাড়া আজ জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল আয়োজিত অনুষ্ঠানসহ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের অনুষ্ঠানে যোগ দেন স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
জাতিসংঘে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নিউইয়র্কস্থ বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেলের কনসাল জেনারেল মিজ্ সাদিয়া ফয়জুনেচ্ছা এবং স্থায়ী মিশন, কনস্যুলেট ও জাতিসংঘ সদরদপ্তরে কর্মরত বাংলাদেশের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যবৃন্দ। অন্যান্যদের মাঝে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ যুক্তরাষ্ট্র এর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা মুকিত চৌধুরী, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সামাদ আজাদসহ যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রবাসী বাংলাদেশীগণ।
***

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here