তদন্ত ভাগাড়ে, ১৫ মণ স্বর্ণ ফেরত পেতে মরিয়া আপন জুয়েলার্স

0
56

পর্দার আড়ালে থেকে সহযোগিতা করছে প্রভাবশালী মহল

চোরাচালানের অভিযোগে আটক ১৫ মণ স্বর্ণ ফেরত চায় আপন জুয়েলার্স। এ জন্য তারা অভিনব কারসাজির পথ বেছে নিয়েছে। সদ্য পাস হওয়া স্বর্ণ নীতিমালার ফাঁকফোকর দিয়ে আটক স্বর্ণ ছাড়িয়ে নিতে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি এগিয়েছে অনেকদূর। শুধু আটক স্বর্ণ ফেরত নয়, এ সংক্রান্ত চোরাচালান ও কর ফাঁকির মামলা থেকেও অব্যাহতি পেতে চায় তারা। এজন্য আপন জুয়েলার্সের পক্ষে প্রভাবশালী মহলের জোর তদ্বিরও জোরেশোরে এগোচ্ছে।

বিদ্যমান স্বর্ণ নীতিমালা অনুযায়ী অবৈধভাবে আমদানি করা স্বর্ণ বৈধ করার সুযোগ রয়েছে। প্রথমবারের মতো নীতিমালাটি গত বছর অক্টোবরে জারি করা হয়। স্বর্ণ ব্যবসা খাতে দীর্ঘদিনের নৈরাজ্য বন্ধে এ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সেখানে প্রতি ভরিতে এক হাজার টাকা আয়কর দিয়ে অপ্রদর্শিত স্বর্ণ বৈধ করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এ বছর কয়েক হাজার ব্যবসায়ী তাদের বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণ বৈধ করেছেন। বিষয়টি অনেকটা কালো টাকা সাদা করার মতো।

এদিকে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, নীতিমালার এ সুযোগ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা সরকারি কোনো সংস্থার হাতে জব্দকৃত স্বর্ণ বৈধ করার সুযোগ নেই। এছাড়া আপন জুয়েলার্সের যে ১৫ মণ স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে সেটি নিয়ে রীতিমতো অর্থ পাচারের মামলাও চলমান। অপরদিকে নীতিমালা কার্যকর হওয়ার আগেই আপন জুয়েলার্সের বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ জব্দ করে শুল্ক গোয়েন্দা। তাই আইন ও নীতিগতভাবে এটি আদৌ সম্ভব নয়। কেউ আইনি চ্যালেঞ্জ করলে বিষয়টি যতদূর এগিয়েছে, ততদূর পিছিয়ে যাবে।

জানা যায়, ৪ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে স্বর্ণ ফেরত চেয়ে চিঠি দেয় আপন জুয়েলার্সের মালিক পক্ষ। যেখানে মালিক হিসেবে পৃথকভাবে চিঠি দিয়েছেন তিন সহোদর দিলদার আহমেদ সেলিম, গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদ। চিঠির কপি সম্প্রতি যুগান্তরের হাতে আসে। এতে আটককৃত স্বর্ণালঙ্কার ও ডায়মন্ড অলঙ্কারের বিপরীতে দায়েরকৃত মামলা হতেও অব্যাহতি চাওয়া হয়।

চিঠিতে বলা হয়, ‘আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে অবৈধ ব্যবসার আড়ালে ডার্টি মানি অর্জন ও চোরাচালানের অভিযোগ কাল্পনিক ও মনগড়া। বেআইনিভাবে শুল্ক গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম থেকে ১৫ দশমিক ১৩ মণ স্বর্ণ জব্দ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে জমা দেয়। স্বর্ণ ব্যবসার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে গত বছর ২৯ অক্টোবর স্বর্ণ নীতিমালা প্রণীত হয়। উক্ত নীতিমালার আলোকে স্বর্ণালঙ্কারের বিপরীতে ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা ও ডায়মন্ড অলংকারের ক্যারেট প্রতি ছয় হাজার টাকা হিসাবে প্রযোজ্য সমুদয় অর্থ আয়কর চালানের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আটককৃত স্বর্ণ ও ডায়মন্ড অলংকার ফেরত এবং শুল্ক করের দায় ও মানি লন্ডারিং মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হোক।’

স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের একটি সূত্র বলছে, স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় নির্ধারিত হারে কর পরিশোধ করে অপ্রদর্শিত স্বর্ণ বৈধ করার সুযোগ দেয়া হয়। এ সুযোগে আপন জুয়েলার্স প্রায় ১৪ কোটি টাকা জমা দিয়ে জব্দকৃত সাড়ে ১৫ মণ স্বর্ণ ও হীরার অলঙ্কার ফেরত চেয়ে বসে। অথচ সরেজমিন আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি শোরুমেই বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও ডায়মন্ডের অলঙ্কার প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৫ মণ স্বর্ণ জব্দ থাকার পরও এসব স্বর্ণালঙ্কার কোথা থেকে এলো তার কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি।

আমদানিসংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে না পারলে সেটি অবশ্যই অবৈধ স্বর্ণ। এমনকি আইন অনুযায়ী এখানেও অর্থ পাচারের প্রসঙ্গ চলে আসবে। অথচ শোরুমের স্বর্ণ বৈধ করার প্রয়োজন মনে করছে না প্রতিষ্ঠানটি। সূত্রটি মনে করে, নীতিমালা হলেও এটি কার্যকর করার ব্যাপারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কোনো পদক্ষেপ নেই। কেননা, নীতিমালা হওয়ার পর এখন আর কোনো স্বর্ণের দোকানে আমদানিবহির্ভূত স্বর্ণ থাকার সুযোগ নেই। হয় জরিমানা দিয়ে বৈধ করতে হবে, না হয় আমদানির কাগজ দেখাতে হবে।

এদিকে রহস্যজনক কারণে আপন জুয়েলার্সের মালিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কর ফাঁকি ও অর্থ পাচারের ৫টি মামলার কোনোটিতেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। ২০১৭ সালের আগস্টে মামলার পর দেড় বছরের বেশি সময়ে তদন্তের ফলাফল অনেকটাই শূন্য। শুধু কয়েকটি সংস্থার কাছে আপন জুয়েলার্সের তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়ে দায় সেরেছেন সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তারা। অথচ মামলাগুলোতে অর্থ পাচার, চোরাচালান, শুল্ক ও আয়কর ফাঁকির মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এমনকি জব্দকৃত আলামতের মধ্যে অভিযোগের অকাট্য প্রমাণও রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপন জুয়েলার্সের শোরুম থেকে জব্দ অলঙ্কারগুলোর গায়েই লেখা রয়েছে সেগুলো সিঙ্গাপুর ও দুবাইতে তৈরি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মালিকরা এসব অলঙ্কার বৈধভাবে আমদানির কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। ফলে এটা স্পষ্ট যে, এসব অলঙ্কার বিদেশ থেকে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি মুদ্রা হুন্ডির মাধ্যমে বা অন্য কোনোভাবে পাচার করা হয়েছে। অর্থাৎ আপন জুয়েলার্সের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ প্রমাণিত। শুল্ক ও আয়কর ফাঁকি দিয়ে এসব স্বর্ণ মজুদ ও বিক্রির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিল আপন জুয়েলার্স। ফলে তাদের বিরুদ্ধে শুল্ক ও আয়কর ফাঁকির অভিযোগ প্রমাণ করা একেবারেই সহজ।

ফিরে দেখা : ২০১৭ সালের জুনে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের সেই বহুল আলোচিত ঘটনায় আপন জুয়েলার্সের নামটি সামনে চলে আসে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের একমাত্র ছেলে সাফাত আহমেদ এ ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি হিসেবে গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। ধর্ষণের এ মামলাটি টক অব কান্ট্রি হিসেবে অন্তত ৬ মাস ছিল সবার মুখে মুখে।

এ সংক্রান্ত অনেক ভিডিও তখন ভাইরাল হয়। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন হয়। টিভি টকশো ছিল অনেকদিন সরব। এরফলে বিষয়টি নিয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মকর্তারা এক ধরনের চাপের মুখে পড়ে। যে কারণে তখন কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে আসে। শুল্ক গোয়েন্দার একের পর এক অভিযানে আপন জুয়েলার্সের ৫টি শোরুম থেকে প্রায় সাড়ে ১৫ মণ স্বর্ণালঙ্কার জব্দ করা হয়।

মামলার আলামত হিসেবে জব্দ থাকা বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ফেরতের বিষয়ে জানতে চাইলে আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘আগে স্বর্ণ ব্যবসায় কোনো নীতিমালা ছিল না। সবাই যেভাবে ব্যবসা করেছে, আমরাও সেভাবে ব্যবসা করেছি। অন্যায়ভাবে আমাদের শোরুম থেকে স্বর্ণালঙ্কারগুলো জব্দ করা হয়। আমরা এখন এনবিআরের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বর্ণ নীতিমালার আলোকে জব্দ স্বর্ণালঙ্কারের বিপরীতে আয়কর জমা দিয়েছি। তাই সেগুলো ফেরত পেতে আর কোনো আইনগত বাধা নেই।’

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘দেখেন, আমরা ব্যবসায়ী। আমাদের প্রতিষ্ঠান ঘিরে অনেকগুলো পরিবার জীবিকা নির্বাহ করে। তাই মানবিক দিক বিবেচনা করে হলেও আমরা সরকারের কাছে স্বর্ণালঙ্কারগুলো ফেরত চাই। যাতে করে আমরা ব্যবসাটা অন্তত চালু রাখতে পারি।’

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই আইনের মধ্য দিয়ে এর গ্রহণযোগ্য সমাধান চাই।’

এদিকে চাঞ্চল্যকর এ মামলার এমন পরিণতি নিয়ে যুগান্তরের কাছে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন পুলিশের একজন পদস্থ কর্মকর্তা। তিনি বলেন, বনানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের শিকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ছাত্রী দায়েরকৃত এজাহারে যেসব আশঙ্কার কথা উল্লেখ করেছিলেন সেটিই এখন বাস্তবে ঘটতে যাচ্ছে। যেমন- ‘ধর্ষণের আগে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ভিকটিমদ্বয়কে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমাদের হাত অনেক লম্বা। সমাজের অনেক উপর মহলের সঙ্গে আমাদের চেনাজানা আছে। তাই আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও কোনো লাভ হবে না। কেউ আমাদের কিছুই করতে পারবে না।’ – যুগান্তর

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here