অপরিণত তামাশা সর্বত্র, নীতিবাক্য কেবলই গোলটেবিলে!

0
154

মুসবা আলিম তিন্নি:
আজকাল প্রতিটি বিষয়কেই হাস্যরসে পরিণত করতে দেখা যায়। খাদ্য সংকট থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দূর্যোগ পর্যন্ত এযুগে ট্রল ও হাসির বিষয়বস্তু হয়ে গেছে, এর মূল কারণ হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অবক্ষয়। বিষয়টি আজ সবচেয়ে বেশি আলোচিত। কারণ নৈতিকতার বিপর্যয় আজ সর্বত্রই। নৈতিকতার অবক্ষয়ে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত ক্ষত-বিক্ষত।অপরদিকে সামাজিক অবক্ষয়ে উন্নয়ন ও সভ্যতার বিপরীতে অসামাজিকতা, অসভ্যতা, অনৈতিকতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে সর্বত্রই।
মাঝে মাঝে মনে হয় এই ট্রলের যুগে যদি মুক্তিযুদ্ধ হতো তা নিয়েও হয়তো একশ্রেণীর মানুষ হাস্যরস করে সেটিকে ভাইরাল করতো অার সেসব নিয়ে সবাই হাসতো।
আমাদের নৈতিক শিক্ষার জন্য পরিবার, লক্ষ লক্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সেই সাথে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনও আছে। এরপরও আমাদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় কেন? আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র নৈতিকতার বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত কেন? এই নৈতিক অবক্ষয়ের জন্য দায়ী কারা? বলা হয়ে থাকে-যারা ধর্মকর্মে লিপ্ত থাকেন তারা সাধারণত নীতিবান হয়ে থাকেন। এটা চিরসত্য কথা। যারা ধার্মিক তারাই নীতিবান। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে যারা ধর্মকর্মের কথা বলেন তাদের অনেকেই নীতিহীন কাজে লিপ্ত, ধার্মিকের লেবাস পরে তারা করে থাকেন অনৈতিক কর্মকান্ড। হ্যাঁ, ধর্মের দোষ কখনও হতে পারেনা। কারণ ধর্ম মানুষকে কখনও নীতিহীন হওয়ার কথা বলেনা। কিন্তু এক্ষেত্রে ধার্মিককেই দায়ী করতে হবে। ধর্মকে কখনও দায়ী করা যাবে না। প্রশ্ন হল-একজন ধার্মিক যখন নীতিহীন, একজন পিতা যখন নীতিহীন, একজন মাতা যখন নীতিহীন, একজন নেতা যখন নীতিহীন, একজন শিক্ষক যখন নীতিহীন সেই নৈতিক শিক্ষার জন্য আমরা যাব কোথায়?
মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য এই অপূর্ব অমিয়বাণী ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেই গঠিত হয় সমাজ ব্যবস্থা। যাতে করে সমাজের মানুষ আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মানবতাবাদী ও আলোকিত মানুষ হতে পারে। নম্রতা, ভদ্রতা, বিনয়ী, উদারতা, সহমর্মিতা, সৌজন্যবোধ, মমত্ববোধ, শিষ্টাচার, সত্যবাদী, কর্তব্যপরায়ণতা, সাম্যবাদী, ধর্মবাদী, মৌলবাদী, দর্শনবাদী, সৎ ও কর্মজীবী আদর্শ মানুষ হতে পারে।
তবে আজকের বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থার, বাস্তবতা ভিন্ন প্রকৃতির। সমগ্র বিশ্ব আজ ধর্মকে রাজনীতি থেকে কৌশলে নির্বাসিত করে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপি অমৌলবাদী নামধারী ধার্মিকরাই রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কর্তৃত্ব নেতৃত্ব দিচ্ছে। অপরদিকে উপরোক্ত মানবীয় গুণাবলী সম্পন্ন ধর্মপ্রেমী মৌলবাদীরা পণবন্দি হয়ে পড়েছে তাদের গভীর ষড়যন্ত্র আর কুটকৌশলী কুটনীতিতে।
ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবিক মূল্যবোধের আজ দারুন সংকট। সমাজের সর্বস্তরে নৈতিক আধ্যাত্মিক, দার্শনিক ও ধার্মিক চিন্তা চেতনার পরিবর্তে আস্থাহীনতা, অমানবিকতা, অসভ্যতার মাত্রা দিন দিন বেড়ে চলেছে। কৃত্রিমতা, চাতুরতা, স্বার্থপরতা, তিক্ততা, হীনমন্যতা, ইর্ষা, ক্রোধ, অহমিকা, দাম্ভিকতা, অনাচার অবিচার, অকৃতজ্ঞতা, অশ্লীলতা, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনা, যৌনাচার,অবিচার, অমিতাচার, নৃশংসতা, বারবনিতা, বহুগামিতা, যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই,সাম্প্রদায়িক, উগ্রবাদী, বিশেষ করে নৃশংসতা, ও বিকৃতিকর যৌনাচার ,প্রবণতা বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। আত্মহত্যা, এসিড নিক্ষেপের মতো নাশকতা, বিদেশী অপসংস্কৃতি ও বিকৃতি যৌনাচারের ছবি প্রদর্শনী, মাদক দ্রব্যের সয়লাব, যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধির নানাবিধ ক্যামিক্যাল মিশ্রিত ওষুধ সেবন ও ব্যবহারের সুযোগ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধির ফলে বিশ^ব্যাপি দৃশ্যত সুখ বাড়লেও স্বস্তি, শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।
এর একটি কারণ হতে পারে মোবাইল, মোবাইল ফোনের অপব্যবহার আমাদের ছোট-বড় সকলকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অাজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এলেই দেখা যায় হঠাৎ করে কেউ একজন অদ্ভুত কথা বলে,গান গেয়ে, অশ্লীল বাক্য প্রয়োগ করে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে তাকে অধিকতর ফেমাস বানিয়ে দিচ্ছি অথচ সত্যিকার প্রতিভাগুলোর দিকে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, তা ধুলোতেই লুটছে। ঠিক এসব কারণেই বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় এখন চরম পর্যায়ে। হঠাৎ করেই লোক সমাজে সামাজিক অপরাধের পরিমাণ পূর্বের তুলনায় বহু গুনে বেড়ে গেছে। কোনো পেশার লোকই তাদের দ্বায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করছে না। শিক্ষক, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার,উকিল, ব্যরিস্টার থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা পর্যন্ত নিজ নিজ জায়গায় বসে পেশার মূল্যবোধ ও উদ্দেশ্য নষ্ট করে কেবলই অর্থের পেছনে ছুটে চলেছে।
অাসলে পারিবারিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের অভাবে ঘরে ঘরে তৈরী হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়ের ক্ষেত্র। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রে দ্রুত বাড়ছে অপরাধ ও অস্থিরতা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই,রাহাজানি, অত্যাচার, ষড়যন্ত্র, খুন, গুম, অপহরণ, পণ আদায়, ঠকবাজী, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, যৌতুক, মাদক, বাল্যবিবাহ, চোরাচালানী, মজুদখোরী, ব্লু-ফ্লিম,পর্ণসাহিত্য, বিজাতীয়, আকাশ সংস্কৃতির অবাধচর্চা, ফেসবুক, অমিতাচার, পরকীয়া প্রেম, ঝগড়া, কলহ,বিরোধ, গোপনে অবৈধ মেলামেশা, ইভটিজিং, এসিড নিক্ষেপ, নারী ও শিশু ধর্ষণ, শিশু খাদ্যে বিষক্রিয়া, চাঁদাবাজী, বোমাবাজী, বিদুৎতের লোডসেডিং, কোচিং ব্যবসা, সাইবার ক্রাইম, সাইবার, মসজিদ, মন্দির,উপাসনালয়ে হামলা, হত্যা, দান বাক্স ও জুতা চুরি ইত্যাদি অনৈতিক কর্মকান্ড সামাজিক নিরাপদ পরিবেশকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

সামাজিক অবক্ষয়ের মাত্রা কমিয়ে এদেশকে মহাদুর্যোগ থেকে বাঁচানো সম্ভব তা হলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে সৎ হতে হবে। নিজের দ্বায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। যার যা কাজ তাকে সেটাই করে হবে যে যেটার যোগ্য নয় সে সেটা পেয়ে গেলে দেশের ভবিষ্যৎ পরিনতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ সুশাসন হবে বিলুপ্ত।

লেখক: সাংবাদিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here