ভবিষ্যত গেল কই?

0
77

 নাসরীন গীতি , সাংবাদিক

দীর্ঘ পাঁচ/ছয় বছর পর, আমার এক ছোট ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। একই শহরে থাকি, অথচ যোগাযোগ নাই অনেকের সাথেই। দারুণ ক্রিয়েটিভ ছেলে বলে বরাবরই আমি ওকে খুব পছন্দ করি। পড়ার গণ্ডি পেরিয়ে এখন ব্যক্তি উদ্যোগে শুরু করেছে আইটি বিষয়ক বিজনেস। কথা প্রসঙ্গে বললো, আপু, আগামী পাঁচ বছর পর আমি আর এ দেশে থাকতে চাই না। আমি চাই না, আমার পরবর্তী প্রজন্ম এখানে বেড়ে উঠুক। অবাক হয়ে বললাম, তোর মতন প্রগতিশীল এবং সৃজনশীল মানুষ যদি দেশ ছেড়ে দেয় তাহলে এই দেশটা কোথায় দাঁড়াবে বলতো?

একটু হেসে বললো, আপু আপনার কি মনে হয়, এখানে আমাদের কাঙ্খিত ভবিষ্যত আছে? আমাদের আগের প্রজন্ম হিসেবে আপনারা কি যথাযথ জায়গাটা পেয়েছেন? বাংলাদেশে যথাস্থানে যথা লোকটা কি আসীন, দু’ একটি পদ ছাড়া? আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। কারণ আমার কাছে কোন উত্তর নেই। আমার অন্তত (সিনিয়র, সমবয়সী এবং জুনিয়র) দশজন সহকর্মী গত পাঁচ বছরে আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্থায়ী বসতি গেড়েছেন। অনেক বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনকেও দেখেছি একই রূপে। তাদের প্রত্যেকেরই এক কথা- দেশে কোন ভবিষ্যত নেই। স্বভাবতই একটি সহজ প্রশ্ন মনে জাগে- ভবিষ্যত গেল কই?

তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে এখন প্রায়শই হতাশার সুর শুনতে পাই। বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী-পুরুষদের বেশিরভাগই এখন দেশ ছাড়তে পারলেই যেন বাঁচে। তরুণ প্রজন্ম বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা উন্নত ভবিষ্যতের আশায়। কারণ বাংলাদেশে তারা কোন সুন্দর আগামী দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষ্যমতে, ক্রমাগত ফিকে হয়ে আসছে সোনার বাংলার সোনালী আভা।

আমার ছোটবেলায় (৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে) শুনতাম, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক কিংবা ইঞ্জিনিয়াররা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ গেলে বিত্ত-বৈভবের রঙিন স্বপ্নে আটকে যেতেন। ছুটির পর ছুটি বাড়িয়ে থেকে যেতেন বিভিন্ন ডিগ্রি নেয়ার নামে। অনেকে আবার চাকরি ছেড়ে দিয়ে সেসব স্বপ্নের দেশে থেকে যেতেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। তখন প্রবীণদের কাছে শুনতাম, বাংলাদেশের মেধা কিনে নিচ্ছে বিদেশিরা। দেশকে মেধাশূন্য করার পাঁয়তারায় ব্যস্ত দেশিয় গুটি কয়েক দালাল। তবে তখনও দেশ আগলে রাখার জন্য অনেক দেশপ্রেমিক ছিলেন, যার মন-প্রাণ দিয়ে চাইতেন দেশেই থাকতে। দিন-রাত সততা আর নীতির মধ্যে থেকে কাজ করে যেতেন স্বাধীন এই বাংলাদেশে মাথা উঁচু করে, বুক ফুলিয়ে চলতে। অনেক মেধাবীরা বিভিন্ন দেশের স্কলারশিপ পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন এমন নজিরও আছে বহু।

এর মধ্যে প্রায় তিন দশক শেষ করতে চলেছি। নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি প্রতিটি খাতে, অনেক উন্নয়ন আর সমৃদ্ধিতে বাংলাদেশের অর্জনও নেহায়েত কম নয়। তারপরও স্বস্তি নেই জনমনে। শান্তি নেই জীবনধারায়। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে লড়তে হচ্ছে, অন্নের সন্ধানে রাত-দিন এক করে খেটে-খুটেও অনেকেই পাচ্ছেন না সচ্ছ্বলতা। গণ জমায়েতস্থল যেমন গণপরিবহন, বাজার, দোকানপাটের সামনে দাঁড়ালে শোনা যায়, অনেকেই খেদোক্তি করেন, এখন একটা শ্রেণির হাতে টাকা চলে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ ক্রমেই নি:স্ব থেকে নি:স্ব হচ্ছে। যা গত আট/দশ বছর আগেও তেমন প্রকট ছিল না।

গত এক দশকে নিত্যপণ্যের দর লাগামহীন ঘোড়ার মতো রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে তো ছুটছেই। এই দৌড়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সম্প্রতি বাঙালির রন্ধন উপকরণের অন্যতম উপাদান পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্যে প্রায় বাকরুদ্ধ সাধারণ জনতা। যেন তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনেকের মতেই গণমাধ্যম, শিক্ষা খাতকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে জাতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নেয়ার যা যা পদক্ষেপ দরকার, তার সবটাই করছে একটা মহল। যার ফলে সুন্দর, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত এখন অদৃশ্য কালো পর্দার অন্তরালে।

সব মিলিয়ে তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠে এখন প্রায়শই হতাশার সুর শুনতে পাই। বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী নারী-পুরুষদের বেশিরভাগই এখন দেশ ছাড়তে পারলেই যেন বাঁচে। তরুণ প্রজন্ম বিদেশমুখী হওয়ার প্রবণতা উন্নত ভবিষ্যতের আশায়। কারণ বাংলাদেশে তারা কোন সুন্দর আগামী দেখতে পাচ্ছে না। তাদের ভাষ্যমতে, ক্রমাগত ফিকে হয়ে আসছে সোনার বাংলার সোনালী আভা।

এসব শুনে আমি বা আমার মতো অনেকেই হতাশ হই, কেন এরকম হচ্ছে আমাদের এই সোনার বাংলায়! উত্তর খুঁজতে গেলে কোন কূল-কিনারা পাই না। তবে হতাশার মাঝেও আবার খুঁজতে চাই আশা জাগানিয়া বন্দর, যেখানে ভিড়বে সুন্দর ভবিষ্যতের নোঙ্গর। বইবে আনন্দের সুবাতাস।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here