বাবা আমার, এ লেখা যখন লিখছি তখন তুমি অনেক অনেক দূরে,মেঘের রাজত্বকেও ছাড়িয়ে। ৪৫ হাজার ফুট অথবা তারও ওপরে,অসীম শূণ্যে ভেসে যাচ্ছো। তোমার উড়োবাহনের জানালা দিয়ে গভীর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছেনা।
যেখানে প্রোথিত নাড়ি সেই জন্মভূমির বন্ধন ছিঁড়ে তুমি চলেছো ১২ হাজারেরও বেশি কিলোমিটার দূরে,শীতলতম এক রাজ্যে। সেখানে এখন তুষার আর হাওয়ার খেলা। হিমেল ছোঁয়া বিস্তীর্ণ পথজুড়ে। বাড়ির দেয়ালে,জানালার স্বচ্ছ কাঁচে শুভ্রতার প্রলেপ।
আদরের বাবা, তোমার কি পেছন ফিরে তাকাতে ইচ্ছে করে? এই যে ছেড়ে যাওয়ায় কতোটা রক্তক্ষরণ তা হয়তো তুমি এখন বুঝতে পারছোনা। কারণ ভালোবাসা স্রোতস্বিনী নদীর মতো শুধু নিচের দিকেই গড়ায়। ওপরের দিকে নয়।
বিচিত্র এই পৃথিবী। সব বাঁধন একে একে ছুটে যায়। এক সময় আমার বাবার হাতের আঙুল ছেড়ে আমি চলে এসেছি। এখন আমার সান্নিধ্য থেকে তুমি। চোখে তোমার নতুন দিনের হাতছানি। স্বপ্নের সোপান পেরোনোর তাগিদ। তাই আকাংখার তীব্রতা শিরা থেকে উপশিরায়, রক্তকনিকায় বইছে।
স্বর্ণালী স্মৃতির পাখিরা ডানা মেলছে আজ। যখন তুমি মায়ের গর্ভে তখন কতোনা কৌতুহল আমার;তুমি দেখতে কেমন, চোখ দুটি কার মতোন, গায়ের রং কি?
যখন ৩.৮ কেজি ওজনে ৪৮ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য নিয়ে তুমি পৃথিবীর আলো দেখলে তখন একটু হাসি দেখার জন্য আমাদের কতো অপেক্ষা। তারপর হামাগুড়ি, উঠে দাঁড়ানো ও হাঁটি হাঁটি পায়ে চলা। অফুরন্ত খুশির আবেগ-অনুভুতি।
তোমার যখন গল্প শোনার বয়স হলো। বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতাম। ‘একটা ছিল বাবা হাতি,একটা মা হাতি আর একটা ছোট বাবু হাতি। খাবারের খোঁজে বের হয়ে এক সময় বাবা হাতিটা হারিয়ে যায়। মা এবং ছোট হাতিটা বাবাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত,বিমর্ষ’। এই হারিয়ে যাওয়ার পর্বটা আমি টেনে টেনে দীর্ঘ করতাম। আর তুমি উদ্বিগ্ন হয়ে বারবার প্রশ্ন করতে;তারপর কি খুঁজে পেলো?
না পায়নি।
আবার প্রশ্ন, কখন পাবে?
বিচ্ছেদ তোমার ভালো লাগতোনা তখন। সময়ের ব্যাবধানে সব ওলোটপালট হয়ে যায়? এখন ছেড়ে যাওয়া তোমাকে শংকিত করেনা? কারণ তুমি সেই ছোট্টটি আর নেই। এখনতো দূরে থাকারই বয়স। এক সময় আমিও বাবার কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়ার সময় তার কষ্ট বুঝিনি। ছুটিতে বাবার কাছে গেলে তিনি বারবার কাছে পেতে চাইতেন, গল্প করতে চাইতেন। আর তখন আমার সময় থাকতো কম। এখনও তেমনটাই হবে হয়তো। পৃথিবীতো বৃত্তাকার,সব ঘুরে ফিরে আসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম।
ইতি
তোমার বাপিস
লেখক: রাশেদ আহমেদ, সিনিয়র সাংবাদিক