সংকটে ডুবছে গণফোরাম

0
563

বাংলা খবর ডেস্ক: অভ্যন্তরীণ সংকট ও কোন্দলে ডুবতে বসেছে গণফোরাম। সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন দলটিতে কার্যত কোনো ‘চেইন অব কমান্ড’ নেই। দলে চলছে বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার। নতুন নেতাদের সঙ্গে পুরনোদের দ্বন্দ্ব। দলের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানে স্বচ্ছতার অভাব।

কর্মীদের মধ্যে তীব্র হতাশা। শীর্ষ নেতাদের মধ্যে নেই ঐক্য। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না, কারও কথাও শোনেন না। অনেক সিনিয়র নেতা নিষ্ক্রিয় না হয় নিশ্চুপ। আরামবাগের ইডেন কমপ্লেক্সের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি নিয়ম রক্ষার্থে রোজ খোলা হলেও সেখানে মাঝারি গোছের কয়েকজন নেতাকর্মী আর অফিস স্টাফদের উপস্থিতি ছাড়া কোনো কর্মকাণ্ড নেই।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণে অবশ্য পথ খুঁজছেন দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন। জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। আশা করি আমরা সবাই বসে একটা সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারব।’

গণফেরামের একাধিক শীর্ষ নেতার মতে, ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের আগে মূলত বিএনপিকে নিয়ে নতুন জোট ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ গঠন, জামায়াতকে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণসহ নানা ইস্যুতে গণফোরামের শীর্ষ নেতারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।

নির্বাচনের পর শপথ নেয়া না নেয়া নিয়েও টানাপোড়েন তৈরি হয় দলটিতে। এর পরপরই অনুষ্ঠিত হয় গণফোরামের কেন্দ্রীয় সম্মেলন। এ সম্মেলনে দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা মহসিন মন্টুকে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে গণফোরামে যোগ দেয়া ড. রেজা কিবরিয়াকে দলের সাধারণ সম্পাদক করা হয়।

এ ক্ষোভে মোস্তফা মহসিন মন্টু দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। তার পথ ধরেন আরও একাধিক শীর্ষ নেতা। নির্বাচনের পর দলের নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থান এখনও স্পষ্ট করা হয়নি বলে অনেক নেতা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, গণফোরাম কি বিএনপির রাজনীতি করবে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে না বিপক্ষে, বিএনপি সঙ্গে থাকলে জামায়াতও কি তাদের সঙ্গে থাকবে এসব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন সাবেক সংসদ সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল। দুঃসময়ে যে ক’জন রাজনীতিবিদ ড. কামাল হোসেনের পাশে ছিলেন, তিনি তাদের একজন। প্রবীণ এ রাজনীতিবিদ দলের সম্মেলনের পর থেকেই নিষ্ক্রিয়-নীরব। জানতে চাইলে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমাদের পার্টির ভেতরে কোনো গণতন্ত্র নেই। আলাপ-আলোচনা নেই। বৈঠক নেই। নির্বাচনের সময় একজন দলে যোগ দিলেন, কয়েকদিন পর তাকেই সাধারণ সম্পাদক করা হল। আমরা কিছু জানলামই না। এভাবে একটি দল চলতে পারে না। তাই নিজে থেকেই দূরে থাকি।’

তিনি বলেন, ‘স্যারকে (ড. কামাল হোসেন) ভুল বুঝিয়ে একটি পক্ষ গণফোরামের ভেতরে সংকট তৈরি করে রেখেছে।’ ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা হিসেবেই অধিক পরিচিত। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন সব সময়ই সোচ্চার। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। এরপর ১৯৮৬ এবং ১৯৯১ সালে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করে পরাজিত হন। ’৯১ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে টানাপোড়েন তৈরি হয় তার।

এর রেশ ধরে ১৯৯৩ সালের ৪ নভেম্বর গণফোরাম নামে আলাদা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন ড. কামাল হোসেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) থেকে আসা সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ মানিক হন দলটির সাধারণ সম্পাদক। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে সাইফ উদ্দিন আহম্মেদ মানিক মারা গেলে দলটির সাধারণ সম্পাদক হন মোস্তফা মহসিন মন্টু। আওয়ামী যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গে গণফোরামে যোগ দেন। নির্বাচনে ভরাডুবি এবং সম্মেলনে পদ হারানোর পর মোস্তফা মহসিন মন্টুও এখন দলের প্রায় সব ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে আড়ালে চলে গেছেন।

জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে দলটির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম একজন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বৃহস্পতিবার বলেন, ‘দল প্রতিষ্ঠার ২৭ বছরের মাথায় এসে ড. কামাল হোসেনকে কেন কেন্দ্রীয় কমিটি ভেঙে দিতে হল- এ প্রশ্ন আমারও।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার বিশ্বাস- এ সংকট থাকবে না।’

দলের ভেতরে পাল্টাপাল্টি অবস্থান, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার, অভ্যন্তরীণ সংকট, নেতৃত্বের কোন্দলসহ চলমান সংকটের মধ্যেই বুধবার গণফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটি বাতিলের ঘোষণা দেয়া হয়। দলটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ ঘোষণা দেন। পরে কাউন্সিল না হওয়া পর্যন্ত ড. কামাল হোসেন সভাপতি ও ড. রেজা কিবরিয়া সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব পালন করবেন।

ড. কামাল হোসেনের স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘গত বছরের ২৯ এপ্রিল গণফোরামের কাউন্সিলের পরে তিন থেকে চারজন কেন্দ্রীয় নেতা নিজেদের পছন্দমতো কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে সভাপতির অনুমোদন গ্রহণ করেন। কিন্তু ওই কমিটির নেতৃত্বে দলে গতি সৃষ্টির পরিবর্তে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে বিশেষ কাউন্সিল ২০১৯ কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতাবলে কামাল হোসেন ২০১৯ সালের ৫ মে ঘোষিত কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এছাড়া পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কামাল হোসেনকে সভাপতি ও রেজা কিবরিয়াকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। তারা দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করবেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২৯ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনকে নিজের ভুল ‘শোধরাতে’ গণফোরামের ছয় শীর্ষ নেতা প্রথম চিঠি দেন। দল পরিচালনায় তারা স্বেচ্ছাচারী কায়দায় সংগঠন পরিচালনার অভিযোগ আনেন গণফোরাম সভাপতির বিরুদ্ধে। এ ছয় জ্যেষ্ঠ নেতা হলেন- গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল, জামাল উদ্দিন আহমেদ, অ্যাডভোকেট এসএম আলতাফ হোসেন, ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল হক এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এএ মাহমুদ। ছয় শীর্ষ নেতাই গণফোরামের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য এবং প্রথম থেকেই ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক সঙ্গী।

ড. কামাল হোসেনের উদ্দেশে ১২ অক্টোবর দুই পৃষ্ঠার চিঠি দেন এ ছয় নেতা। এতে ডিসেম্বরের মধ্যে বৃহত্তর কর্মিসভা (কনভেনশন) আহ্বান করে গণফোরামে গঠনতন্ত্রের ধারা এবং আদর্শ সমুন্নত রাখার দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তারা ২৬ এপ্রিল মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল শেষে গঠিত কমিটিকে ‘অগণতান্ত্রিক এবং অনৈতিকভাবে গঠিত’ দাবি করেন। তারা দ্রুত এ কমিটি ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। এছাড়া দলের নীতি, আদর্শ, লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে বিএনপি-জামায়াতসহ স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে ঐক্য করার অভিযোগও আনা হয়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে গণফোরামের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মফিজুল ইসলাম খান কামাল বলেন, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আমরা গণফোরাম প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। এ দল আমাদের হাতে গড়া। দলটির ক্ষতি হোক আমরা তা চাই না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য- যে লক্ষ্য, নীতি, আদর্শ এবং উদ্দেশ্য নিয়ে গণফোরামের জন্ম হয়েছিল, দলটি এখন সে জায়গায় নেই। তিনি আরও বলেন, ড. কামাল হোসেনকে ভুল বুঝিয়ে কয়েকজন সুবিধাভোগী নেতা গণফোরামকে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গী বানিয়ে ফেলেছেন।

আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছি। দলের সভাপতিকে লিখিতভাবে আমরা আমাদের কথা জানিয়েছি। যদি তারা না শুধরান, আমরা আমাদের মতো করে পথ চলব।

সংশ্লিষ্টদের মতে, বিষয়টি তখন আমলে না নেয়ায় সংকট আরও তীব্র হতে থাকে। সম্প্রতি তা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। সোমবার গণফোরামের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোশতাক আহমেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক হেলাল উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক লতিফুল বারী হামিম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক খান সিদ্দিকুর রহমান এবং প্রবাসীকল্যাণ সম্পাদক আবদুল হাছিব চৌধুরীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর মঙ্গলবার বহিষ্কৃত এ চার নেতা দলটির সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া, সহ-সভাপতি মহসীন রশীদ, সহ-সভাপতি শফিকউল্লাহ ও যুগ্ম সাধারণ মোস্তাক আহমেদকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।

বহিষ্কৃত চার নেতা স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সাংবাদিকদের মাধ্যমে জানতে পারি গণফোরামে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ও অবাঞ্ছিত জনৈক মোস্তাক আহমেদ স্বাক্ষরিত একটি পত্রের মাধ্যমে দলীয় শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্রের ৪৩ (কর্মকর্তা অপসারণ) ধারা অমান্য ও অবজ্ঞা করে রাজনৈতিক চরিত্র হননের উদ্দেশ্যে ও দলীয় ঐক্য বিনষ্ট করার হীনস্বার্থে চারজন কেন্দ্রীয় নেতার নামে অবৈধ, বানোয়াট ও উদ্দেশ্যমূলক প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। যা সভাপতি পরিষদ, সম্পাদকমণ্ডলী, স্থায়ী কমিটি, কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় আলোচনা হয়নি কিংবা সিদ্ধান্ত হয়নি।

বিবৃতিতে বলা হয়, প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে- গণফোরামের বিশেষ কাউন্সিল পরবর্তীতে দীর্ঘ সাত মাস দলের কোনো সভা হয়নি। এমতাবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহবান করার জন্য ৫৯ জন কেন্দ্রীয় নেতার স্বাক্ষরে দলের সভাপতি, দুই নির্বাহী সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর ২১ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে তিন দফা দাবিতে একটি চিঠি পাঠানো হয়।

দাবিগুলো ছিল- দল গঠনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হবে, বিশেষ কাউন্সিল পরবর্তী ঘোষিত কমিটির বাইরে নতুন কোনো ব্যক্তিকে নিয়োগ ও পদায়ন করা যাবে না, দ্রুত কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান করতে হবে। তবে দলের সাধারণ সম্পাদককে মৌখিক ও একাধিকবার লিখিতভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আহ্বান করার অনুরোধ করলেও তিনি দলের অফিসে হাজির না হয়ে মাসের পর মাস বিদেশে অবস্থান করে অফিসের বাইরে উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ২৮ জানুয়ারি (২০২০) তারিখে সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ও যুগ্ম সম্পাদক মোস্তাক আহমেদকে উপদলীয় কোন্দল, দায়িত্বে অবহেলা ও দলের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত না থাকার কারণে অব্যাহতি দেয়া হয়। এ অব্যাহতির পর ১৮ জন সম্পাদককে অব্যাহতিপ্রাপ্ত ও দলে অবাঞ্ছিত জনৈক মোস্তাক আহমেদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে শোকজ নোটিশ প্রদান করা হয়, যা গঠনতন্ত্রের ৪৩ ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।

কারণ দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একমাত্র কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আত্মপক্ষ সমর্থনের পর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতিক্রমে কোনো কর্মকর্তাকে অব্যাহতি কিংবা বহিষ্কার করতে পারে। আর আমাদের জানামতে, গত ১০ মাসের মধ্যে কোনো পূর্ণাঙ্গ সভাপতি পরিষদ সভা, স্থায়ী কমিটির সভা কিংবা কেন্দ্রীয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here