কবর আর কঙ্কালে ঘিরে থাকা আমার বিষন্ন জানালা…

0
161


সৈয়দ মনসুর উদ্দীন শিকন:

কবর আর কঙ্কালে ঘিরে থাকা আমার বিষন্ন জানালা…

আমার ঘরের সামনে আর কোনো বসতি নেই। আছে একটি অপূর্ব সুন্দর সবুজ মাঠ। সিটিং রুমের বিশাল জানালা আর এই মাঠের সাথে আমার মিতালী গত ১৩ বছর ধরে। এই মিতালী আমার কোন ব্যক্তিগত অর্জন নয়, কাকতালীয়!

সুযোগ পেলেই এর সামনে দাঁড়িয়ে থাকি।

ভোরের রাঙা সূর্য, আলোয় ভরা নরম সকাল, শিশির ভেজা ঘাস, মন উদাস করা তীব্র দুপুর, কড়কড়ে নীল আকাশ, নিস্তেজ সোনালী বিকাল, বিষন্ন গোধুলি, নির্দয় হীম শীতল রাত, মমতাময়ী জোসনা, নীরব তুষারপাত, ঝড়ের গর্জন, সময়ে অসময়ের বৃষ্টির ঝাপটা; বছর জুড়ে কতো কিছুই না এখানে আছড়ে পড়ে।

নির্জনে এখানে দাঁড়িয়েই ফিরে যাই…খুঁজে ফিরি দূরন্ত শৈশব, ফেলে আসা জীবন… চলে নিজের সঙ্গে নিজেরই খুনসুটি, কাটাকুটি। জীবনের হালখাতা…কত ভাবনা… ।

আজ আমাকে আরেকবার থমকে দিলো প্রিয় জানালা করোনা আক্রান্ত পৃথিবীর করুণ কান্নায়।

নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাইলাম। আজই প্রথমবার অসীম ক্ষমতাবান মানুষের বিশাল অসহায়ত্বটা কেন জানি বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠলো।

মাত্র আড়াই ঘন্টায় লন্ডন টু নিউইয়র্ক অথবা চন্দ্র বিজয়ের অসংখ্য গল্পের মানেটা কী তাহলে?

প্রথমবারের মতো ভাবতে লাগলাম মানুষকে নিয়ে … আমাকে নিয়ে …এইটাই কী আমি… আমি এখানে কেন… আমার কোথায় থাকার কথা ছিলো… এই কোথায়টাইবা কোথায়… কী চাই আমি…কার জন্য এই পথ চলা… কেন এই অবিরাম ছুটে চলা…।

বন্ধু শান্তনুর সৌজন্যে এই জানালায়ই গত কত কছর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। সীমার মাঝে অসীম যার সৃষ্টি। তার কাছে সময় সময় জানতে চাই কত কিছু।

অন্যান্য বারের মতো আজও তিনি কোন উত্তর দিলেন না। অদৃশ্য আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কালো কালো হরফে লেখা তার অক্ষরগুলো। খুঁজতে গিয়ে দেখি অসহায় রহস্যভরা জগত নিয়ে তারও কত প্রশ্ন, কত সমর্পন, কত কান্না।

সকলের কান্নাকে ধারণ করেই তিনি গেয়েছেন ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে… !

তারপরও তিনি জীবনের পেয়ালাকে চেটেপুটে পান করতে চেয়েছেন। সকলকে হাসতে বলেছেন। গেয়েছেন ‘প্রতিদিন যদি কাঁদিবে কেবল একদিন নয় হাসিবি তোরা, একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া সকলে মিলিয়া গাহিব মোরা। আমার মতন সুখি কে আছে…….‘!

মূলত প্রকৃতিই তাকে সুখি রেখেছে, বারবার তার কাছে ফিরে গেছেন। প্রকৃতি তাকে বিস্মিত করেছে, সকল বেদনা ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে, আবেগাপ্লুত করেছে। অলৌকিক ক্ষমতাবলে বর্ণনা করেছেন এর প্রতিটি কণা অনুকণা।

যৌবনেই তিনি লিখেছেন ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভূবনে‘। পরিণত হয়ে লিখেছেন ‘এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি‘ !

প্রাণভরে গেয়েছেন ‘আকাশভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে, জাগে আমার গান…

জীবনে এই প্রথমবারের মতো আজ আর তার মতো করে বিস্মিত হতে পারলাম না।
বরং বিস্মিত হলাম উল্টোভাবে।

মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে একটি অপূর্ব সুন্দর স্নিগ্ধ সকালও কতো বিষন্ন মনে হয়! আসলে মানুষ থাকলেইতো সব সুন্দর!

আজ এই সুন্দরের পুজারীরাইতো কাঁদছে! অদৃশ্য এক দাবানলে পুড়ছে!

খুব জানতে ইচ্ছে করছে বেঁচে থাকলে কবর আর কঙ্কালে ঘিরে থাকা এই পৃথিবীর অসহায় মানুষদেরকে নিয়ে আজ তিনি কী লিখতেন?

আবারো তার কথা ধার করেই বলতে হয়-

‘আপনার মনে বসিয়া একেলা
অনলশিখায় কী করিনু খেলা
দিনশেষে দেখি ছাই হলো সব হুতাশে, হুতাশে
আমি কেবলই স্বপন করেছি বপন বাতাসে ….!’

কেউ কি বলবেন গলদটা কোথায়? সেনাবাহিনী যখন বুলেট ছেড়ে প্যারাসিটামল বানায় তখন গলদটা জানা আরো জরুরীই হয়ে উঠে!

লন্ডন, ২৬ মার্চ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here