এক রাজা তার এক বিজ্ঞ মন্ত্রীর সব পরামর্শ মেনে চলতেন। সুদিনে অথবা দুর্দিনে তাকেই সবার আগে স্মরণ করতেন, রাতের ঘুম বাদে সারাক্ষণ তাকে পাশে রাখতেন।
একদিন ভোর বেলা বিছানা থেকে অসতর্কভাবে নামতে গিয়ে রাজার হাত ভেঙে গেল। এটা কীভাবে সম্ভব? স্তম্ভিত হয়ে রাজা মন্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন।
মন্ত্রী এসে পরিস্থিতি দেখে শুনে বললেন, ‘ব্যাপারটা মন্দ হয়নি।’
মন্ত্রীর কথা শুনে রাজা রেগে লাল হয়ে গেলেন। এই লোকের মুখের বিভিন্ন অপ্রচলিত কথাবার্তাকে সবসময় জ্ঞানের পরিচায়ক বলেই ভেবেছেন তিনি কিন্তু তাই বলে তার হাত ভাঙ্গাকেও সে ভালো বলবে?
সেপাই ডেকে মন্ত্রীকে পাতালের গভীরতম কামরায় বন্দি করে রাখার হুকুম দিলেন রাজা।
মন্ত্রী নিরুদ্বেগ কণ্ঠে বললেন, ‘এটাও মন্দ হচ্ছে না।’
হাত ভাঙ্গার কষ্টের উপর প্রিয় মন্ত্রীকে পাতালবন্দি করার ব্যথা ভুলতে রাজা সভাসদকে নিয়ে শিকারে গেলেন। এক পর্যায়ে পথ হারিয়ে রাজা সভাসদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন। ঘুরতে ঘুরতে গভীর বনে একদল মানুষখেকো আদিবাসীর খপ্পরে পড়লেন তিনি। এমন নাদুসনুদুস একটা শিকার পেয়ে খুশিতে নাচতে শুরু করলো আদিবাসীরা।
রাজাকে উলঙ্গ করে আগুনে পোড়াতে গিয়ে তারা লক্ষ করলো রাজার একটা হাত ভাঙ্গা। এই বিশেষ আদিবাসী গোষ্ঠীর কৃষ্টির একটা অংশ ছিল শিকারকে অক্ষত অবস্থায় ধরা এবং খাওয়া। রাজার গায়ে জখম থাকায় তিনি তাদের খাদ্য হিসেবে অযোগ্য বলে বিবেচিত হলেন। কাজেই তারা রাজাকে ছেড়ে দিল।
ঘরে ফিরতে ফিরতে রাজা তার প্রিয় মন্ত্রীর কথার পেছনের প্রজ্ঞা বুঝতে পারলেন। যে কোনো আপাতদৃষ্টিতে অশুভ মনে হওয়া ঘটনায়ও ভালো কিছু নিহিত থাকতে পারে। ফিরেই তিনি মন্ত্রীকে মুক্তি দিয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইলেন,
‘আপনি ঠিকই বলেছিলেন। ভাঙ্গা হাতের কারণে আজ আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। আপনাকে শাস্তি দিয়ে আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।’
মন্ত্রী বিনিত কণ্ঠে বললেন,
‘শাস্তি দিয়ে আপনি আমার উপকারই করেছেন। যদি আপনি আমাকে বন্দি না করতেন, তাহলে আমি নিশ্চিতভাবে আপনার সাথে শিকারে যেতাম এবং কিছুতেই আপনাকে এক মুহুর্তের জন্যও একা হতে দিতাম না। আমরা দুজনেই আদিবাসীদের হাতে ধরা পড়তাম। ওরা আপনাকে ছেড়ে দিলেও আমাকে জ্যান্ত পুড়িয়ে খেয়ে ফেলত কারণ আমার দেহ সম্পূর্ণরূপে অক্ষত।’
গল্পটা আমার মেয়ের মুখে শুনেছি। সম্ভবত কোনো একটা দেশের জনপ্রিয় লোকগাঁথা। সে বেশ কিছুদিন ধরে দার্শনিক বইপত্র পড়ছে। এই সময়ে এই গল্পের অন্তর্নিহিত দর্শন হয়তো বা কারো কাজে লেগে যেতে পারে।