‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ৩)

0
118

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ৩)

এর পরের পর্বে এলো পত্রিকার নাম আর কবে নাগাদ প্রকাশ করা সম্ভব এবং অফিস ইত্যাদি। বাবুল সাহেব বললেন, আপনারা বসে এসব ঠিক করেন। আমার কী করতে হবে শুধু জানাবেন। নৈশভোজ শেষে ওঠার আগে সারওয়ার সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন, শাহজাহান (আমি) কবে যোগদান করবে? আমি বাবুল সাহেবের নতুন পত্রিকায় যোগদান করব কিনা এই বিষয়ে সারওয়ার সাহেবের সাথে আগে আমার কোনো আলোচনা হয়নি। অকস্মাৎই সারওয়ার সাহেব কথাটি তোলেন। আমি অনেকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কেননা আমার ইত্তেফাক ছাড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। বাবুল সাহেব বললেন, শাহজাহান ভাই আমার পরিবারের সদস্যদের একজন। আমাদের সাথে আছেন এবং থাকবেন। তাকে তো আসতেই হবে। আমি বললাম, সারওয়ার ভাই আগে যোগদান করুক। আমি পরে আসব। আমি তো প্রতি কাজেই আছি। এখানে বলে রাখি, প্রথম যখন পত্রিকা বের করার জন্য বাবুল সাহেব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন আমাকে বড় পদই অফার করেছিলেন। আমি বিনয়ের সাথে তাকে বলেছি এখনও আমি সে পর্যায়ে যাইনি। যাহোক সেদিন কথায় কথায় অনেক রাতই হয়েছিল। সারওয়ার সাহেবের যোগদানের তারিখ ঠিক করে আলোচনা শেষ করেন। আমরা সবাই ফিরে আসি।

পরদিন শনিবার। সাপ্তাহিক রিপোর্টার্স মিটিং। এখন প্রতি সংবাদপত্রেই হয়। ইত্তেফাকে মিটিং করেন মঞ্জু সাহেব। অর্থাৎ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। বার্তা সম্পাদক সারওয়ার সাহেবসহ দুইজন যুগ্ম বার্তা সম্পাদকও থাকেন। সেদিনও ছিলেন। মিটিং শেষে সারওয়ার সাহেব তার কক্ষে যান। আমি নিজ চেয়ারে। কিছুক্ষণ থেকে আমি বাসায় চলে আসি। সন্ধ্যায় আবার অফিসে। সারওয়ার সাহেবও প্রেসক্লাব থেকে লাঞ্চ সেরে অফিসে যান। আমি নিজেই তার কাছে গিয়ে কথা বলি। জানতে চাই কীভাবে অগ্রসর হবেন। ইত্তেফাক থেকে পদত্যাগ করতে নোটিশও দিতে হবে। দীর্ঘদিনের চাকরি। তাছাড়া বার্তা সম্পাদক পদত্যাগ করলে একটা প্রতিক্রিয়া আছে। কেননা সারওয়ার সাহেব এমন এক বার্তা সম্পাদক যার হাতে জাদুকরী কিছু আছে। হাত দিলেই যেন পত্রিকার গেটআপ, মেকাপ, রিপোর্ট অন্যরকম হয়ে যায়। সারওয়ার সাহেব কোনোদিন অফিসে না এলে তখনকার ইত্তেফাকের চেহারাই অন্যরকম হয়ে যেত। সন্ধ্যায় পত্রিকা অফিসে কাজের পিকটাইম।

সারওয়ার সাহেব বললেন, কাল সকালে প্রেসক্লাবে আসো, কথা হবে। আমি কাজ শেষে বাসায় ফিরি। এর মধ্যে বাবুল সাহেব ফোন করে জানতে চান সব ঠিকঠাক আছে কিনা। রোববার সকালে আমি ঠিক ৯টার মধ্যে প্রেসক্লাবে পৌঁছি। কয়েক মিনিটের মধ্যে সারওয়ার সাহেবও উত্তরা থেকে এসে পৌঁছেন। আমরা দু’জন তৎকালীন টিভি রুমে (বর্তমানে ডাইনিং রুম) বসে কথা শুরু করি। কাকে কাকে নেয়া যায়। আমার যোগদানের বিষয়, ইত্তেফাকের পদত্যাগ ইত্যাদি। আমি সারওয়ার সাহেবকে বললাম, আপনি আগে বসা শুরু করেন। আর সাইফুলকে (সাইফুল আলম, বর্তমানে যুগান্তরের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক) সঙ্গে নেন। সাইফুল তখন ইনকিলাবের সিনিয়র রিপোর্টার। আমার সাথে খুবই ঘনিষ্ঠতা। একসাথে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট কভার করি। চলাফেরাও একসাথে। বাবুল সাহেবের সাথে জানশোনা ছিল সাইফুলেরও। আমিই তকে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। পত্রিকা নিয়ে বাবুল সাহেব সাইফুলের সঙ্গেও আগে-পরে আলোচনা করেছেন বলে শুনেছি। কেননা সাইফুলই একদিন আমাকে বলেছিলেন বাবুল সাহেব পত্রিকা বের করলে তাকে যেন সেখানে যাবার ব্যবস্থা করে দেই। কেননা তার মতাদর্শের সঙ্গে ইনকিলাবের মিলছে না। থাকতেও চাচ্ছেন না। বাবুল সাহেবের সঙ্গে পত্রিকা নিয়ে আগে-পরে কথা হলেও সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে কয়েকদফা সভা ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না। বিষয়টি সঙ্গত কারণেই আমরা গোপন রেখেছিলাম। বাবুল সাহেবও গোপন রেখেছিলেন, সাইফুলের নাম শুনে সারওয়ার সাহেব অমত করলেন না। বললেন ঠিক আছে, কথা বল। আসলে আমি সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে আমার বিশ্বস্ত কাউকে দিয়ে অন্যান্য প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে থাকতে চেয়েছি। সেদিক থেকে সাইফুলকেই আমার সবচাইতে বিশ্বস্ত ও দক্ষ মনে হয়েছে। আর ইউনিয়ন ও প্রেসক্লাবের নির্বাচনে একই মতাদর্শের হওয়ায় সারওয়ার সাহেবের সঙ্গেও তার এক ধরনের যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল।

সেদিন অন্যান্য কিছু বিষয় নিয়ে টুকটাক কথা শেষে পরদিন সকালে আবার প্রেসক্লাবে বসার সময় ঠিক করি। সারওয়ার সাহেব অফিসে চলে যান। আর আমি থেকে গেলাম প্রেসক্লাবেই। সে সময় আমি সকাল সকাল প্রেসক্লাবে যেতাম। নাস্তাও সারতাম প্রেসক্লাবে। সাইফুলও আসতেন। আমি আবার অ্যাসাইনমেন্ট না থাকলে দুপুরে বাসায় চলে যেতাম। বাসা থেকে বিকালে আবার অফিস। সারওয়ার ভাইকে বিদায় দিয়ে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি সাইফুল এসে গেছেন। চা পানের পর বাবুল সাহেবের পত্রিকায় সারওয়ার সাহেবের যোগদান প্রক্রিয়াসহ তার বিষয়ে সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে আলোচনার বিষয় জানাই। তিনি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। আমি তাকে বলি, কাল সকালে প্রেসক্লাবে আসেন। সারওয়ার সাহেবও আসবেন। চূড়ান্ত আলোচনা হবে। পরদিন সকালে আবার প্রেসক্লাবের টিভি রুমে ঢুকে দেখি কে একজন সোফায় শুয়ে আছেন। আমাদের দেখে উঠে চলে গেলেন। আমরা কথা শুরু করলাম। কীভাবে অগ্রসর হওয়া যায় ইত্যাদি। সারওয়ার সাহেব আর আমার সাথে বৈঠকে এ প্রথম যুক্ত হলো সাইফুল আলম। এখানে বলে রাখি, এরই মধ্যে বাবুল সাহেবের সঙ্গে আমার কথা হয়। তিনি জানতে চান আমি কবে যোগদান করব? আমি তাকে বুঝিয়ে বলি, বাবুল সাহেব এখন আমার পক্ষে এমন একটি সময় যাতে পত্রিকা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। একদিকে ইত্তেফাক সর্বাধিক প্রচারিত পত্রিকা। অন্যদিকে বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা সব সংবাদপত্রের চাইতে বেশি। আমার সন্তানেরা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করে। নতুন কোনো পত্রিকায় গিয়ে রিক্স নেয়া আমার জন্য কঠিন। পেছনে থেকে আমার সাধ্যমত সব কাজ করে দিব। বাবুল সাহেব একটু মনঃক্ষুণ হলেও বাস্তবতা বুঝলেন। তবে বললেন, আমার পত্রিকা একদিন ইত্তেফাকের চাইতেও ভাল হবে, সার্কুলেশনও বেশি হবে। আমি তাকে বললাম, আমি যে আসব না সারওয়ার সাহেবকে এখনই জানাবেন না তাহলে তিনি হয়তো ভুল বুঝতে পারেন। কেননা আমি জানি সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে বসলেই আমার যোগদানের প্রশ্ন তুলবেন তিনি। সেদিনও তাই হলো। তবে আমার ধারণা ছিল সাইফুলকে সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে দিতে পারলে ভাল হবে। আমিও সরে যেতে পারব। পত্রিকা বের করারও সমস্যা হবে না। তাই সারওয়ার সাহেব যখন সেদিনের বৈঠকে আমার যোগদানের প্রসঙ্গ আনলেন, আমি বললাম সাইফুলকে নিয়ে কাজ শুরু করেন। আমি পেছনে থেকে আছি। নাম ঠিক করা, ডিক্লারেশন নেয়া, কি জনবল নিয়োগ ইত্যাদিতে অনেক দিন চলে যাবে। এত আগে অযথা বেশি লোকের প্রয়োজন কী? সে বৈঠকেই সাইফুলকে চিফ রিপোর্টার নিয়োগের জন্য আমি প্রস্তাব দেই। সারওয়ার সাহেব রাজি হন। আমি এলে কী পদ হবে তাও আমি নিজেই বলি। তখনও অবশ্য সারওয়ার সাহেব যোগদান করেননি। আমার চিন্তা তখন একটি অস্থায়ী অফিসের যেখানে সারওয়ার সাহেব বসবেন। আর স্থায়ী অফিস দেখে পরেও ঠিক করা যাবে। সম্পাদক যোগদান করলে আর অফিস হলে আমার দায়িত্ব লাঘব হয়। এসব বিষয়ে বাবুল সাহেবের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ চলতে থাকে। একদিন সাইফুল আর আমি একসঙ্গে গিয়ে কথা বলি। অফিসে গিয়েই কথা হয়। নাম কী হবে তাও আলোচনায় আসে। এরই মধ্যে নাম চেয়ে সংবাদপত্রেও বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। বাইরে থেকে আমরাও চিন্তা করি।

এসময় বাবুল সাহেবের একমাত্র ছেলে শামীম ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। আমরা আলোচনা করে ঠিক করলাম শামীম সাহেব, আমি আর সাইফুল পরদিন অফিস দেখতে বের হবো। কথামতো পরদিন আমরা ধানমন্ডি তিন নম্বরে ডেইলি স্টারের আগের অফিস এবং মতিঝিল একটি অফিস দেখে দুপুরে বাবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে প্রস্তাব দেই বাইরে অফিস না করে নিজের জায়গায় করলেই ভাল হয়। তিনি বললেন, ভবন করতে অনেক সময় প্রয়োজন হবে। আমি বললাম, না, সময় তত লাগবে না। প্রেস আসার আগেই ভবন হয়ে যাবে। কীভাবে জানতে চাইলেন। বললাম, কমলাপুরে অর্থাৎ ইডেন হোটেলের সাথে আপনার যে জমি আছে সেখানে প্রি-ফেব্রিকেটেড ভবন করেন। আমি এসময় তৎকালীন ইনডিপেনডেন্ট পত্রিকার ভবনের কথা বললাম। তিনি রাজি হলেন। সেনাকল্যাণ ভবন থেকে তার কমলাপুরের জমি পুরোপুরি দেখা যায়। এ জমি ক্রয়ের জন্য যেদিন মালিককে বায়না দেন সেদিনও আমি উপস্থিত ছিলাম। আমার মতামত চাইলে বলেছিলাম ভাল জায়গা। বায়না দেবার দিন সেনাকল্যাণের ১২ তলা থেকে জানালা দিয়ে জমিটি আমাকে দেখিয়েছিলেন। আজও আবার গিয়ে জানালা দিয়ে দেখলাম। বাবুল সাহেব জমি দেখে এসে জামান সাহেবকে ডাকলেন। জামান সাহেব যমুনা গ্র“পের কমাশির্য়াল ডাইরেক্টর ছিলেন। এবং বাবুল সাহেবের ঘনিষ্ঠ। ব্যবসার শুরু থেকে আছেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন। জামান সাহেবকে ডেকে বললেন, কমলাপুরের জমিতে প্রি-ফেব্রিকেটেড ভবন করতে হবে। কীভাবে কোথা থেকে সামগ্রী আনা যাবে, কত সময় লাগবে খবর নেন। একসঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সেরে আমি আর সাইফুল ফিরে আসি। বিকেলে বাবুল সাহেব ফোন করে জানালেন, তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই প্রি-ফেব্রিকেটেড ভবন করা সম্ভব। তিনি কালই সবকিছু চূড়ান্ত করবেন। (চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here