এবার মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ, মূর্তি অপসারণের দাবি

0
96
ছবির কপিরাইটGEOGRAPH Image caption ভারতে স্বর্ণমন্দির হামলার বার্ষিকীতে ২০১৪ সালে ভাস্কর্যটি একবার বিকৃত করা হয়। বিবিসি

বাংলা খবর ডেস্ক:
এবার ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের পক্ষ থেকে মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে বর্ণবাদের অভিযোগ তুলে তাঁর মূর্তি অপসারণের দাবি তোলা হয়েছে। ইংল্যান্ডের লিচেস্টার শহরে থাকা গান্ধীর মূর্তি অপসারণের দাবিতে করা একটি আবেদনে এরই মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার লোক সই করেছেন। অনলাইন ওই পিটিশনে মহাত্মা গান্ধীর বিরুদ্ধে ‘বর্ণবাদের’ অভিযোগ তোলা হয়েছে।

বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিস্টলে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীরা সপ্তদশ শতকের দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টনের মূর্তি নামিয়ে ফেলার পরপরই গান্ধীর মূর্তি অপসারণে পিটিশন দাখিলের বিষয়টি প্রথম সামনে আসে। এর আগে গত বছর ম্যানচেস্টারের কিছু শিক্ষার্থী একই দাবি তুলেছিলেন। সেখানেও গান্ধীর বিরুদ্ধে ‘কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বর্ণবাদী মনোভাবের’ অভিযোগ তোলা হয়। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এই একই অভিযোগ তুলে হওয়া আন্দোলনের মুখে ঘানার ঘানা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে থাকা গান্ধীর মূর্তি অপসারণ করা হয়। এবার লিচেস্টারের মূর্তিটি অপসারণেরও আন্দোলন হচ্ছে।

লিচেস্টার ইস্টের এমপি ক্লডিয়া উইবি সাম্প্রতিক এই পিটিশনকে ‘ভয়াবহ বিভ্রান্তি’ আখ্যা দিয়ে বলেন, এটি ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকে পথচ্যুত করবে। তিনি বলেন, ‘মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো করেই একটি আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিলেন গান্ধী। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার যেমন, তেমনি তাঁর অহিংস আন্দোলনের পথ পরিবর্তনের এক অনন্য শক্তি।’

এ বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ফয়সাল দেবজি বিবিসিকে বলেন, ‘গান্ধীর মূর্তি অপসারণ নিয়ে এই বিতর্ক অবান্তর। অন্য সবার মতোই তাঁর ভুল থাকতে পারে। কিন্তু তাঁকে অন্য দাস ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলাটা বাড়াবাড়ি।’

লিচেস্টারে গান্ধী মূর্তিটি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন ফয়সাল দেবজি। তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে থাকা গুজরাটিদের প্রতিনিধিত্ব করছে এই মূর্তি। গান্ধী নিজে ছিলেন গুজরাটের মানুষ। এখানকার গুজরাটি জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ স্বৈরশাসক ইদি আমিনের সময় উগান্ডা থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে এখানে এসেছিলেন।’

ঊনবিংশ শতকের শেষপাদে দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসকালে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন। আর এ বিষয় নিয়েই গান্ধীর বিরুদ্ধে এই বর্ণবাদের অভিযোগ উঠেছে। এমন নয় যে, এমন অভিযোগ এই প্রথম উঠল। ২০১৭ সালে প্রথম বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক হইচই হয়। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর জীবনীকার ও পৌত্র রাজমোহন গান্ধী এর আগে এ সম্পর্কে বলেছিলেন, এটা সত্য যে তিনি কখনো কখনো দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের বিষয়ে সংস্কারগ্রস্ত ছিলেন।

অভিযোগের মূলে রয়েছে গান্ধীর কিছু মন্তব্য। উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন, ধর্মীয় চিন্তক ও অগ্রসর মানুষ হিসেবে সর্বজনশ্রদ্ধেয় মহাত্মা গান্ধী সারা জীবন অহিংস নীতিতে আস্থা রেখেছেন। তাঁর জীবনে ছিল নানা চড়াই-উতরাই। এই চড়াই-উতরাইয়ের একটি অংশ কেটেছে তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটিতে গান্ধী ১৮৯৩ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি ভারতীয়দের অধিকার নিয়ে প্রচার চালান ও এর আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কয়েক বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার দুই গবেষক অশ্বিন দেশাই ও গোলাম বাহেদের একটি বই প্রকাশিত হয়। তাঁরা সাত বছর ধরে গান্ধীর দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালের সময়টুকু নিয়ে গবেষণা করেন। বইটিতে বেশ কিছু তথ্য নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়। তাঁদের বইয়ে বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় অবস্থানকালে গান্ধী ভারতীয়দের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করলেও একে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে পৃথক রাখেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের ওই পর্যায়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি শ্বেতাঙ্গদের অনুরূপ ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাষ্ট্রক্ষমতা শ্বেতাঙ্গদের হাতেই থাকা উচিত। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের বোঝাতে তিনি ‘কাফির’ শব্দটিও প্রয়োগ করেছেন এক জায়গায়।

১৮৯৩ সালে ন্যাটাল পার্লামেন্ট বরাবর লেখা এক নোটে গান্ধী লেখেন, ‘বিদ্যমান বিশ্বাসটিই উপনিবেশে টিকে গেল দেখা যাচ্ছে, যেখানে মনে করা হয় আফ্রিকার স্থানীয় বা অসভ্যদের চেয়ে ভারতীয়রা কিছু হলেও উন্নত।’

১৯০৪ সালে জোহানেসবার্গের এক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার কাছে লেখা এক চিঠিতে গান্ধী কুলিদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত এক এলাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সেখানেই তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের বোঝাতে ‘কাফির’ শব্দটি প্রয়োগ করেন। একই সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয়দের একসঙ্গে এক স্থানে থাকা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

কিন্তু গান্ধী তো মহাত্মা গান্ধী হয়ে ওঠার পথটি শুরু করেন ভারতে ফেরার পর। সেই রেলের কামরাই তাঁর জীবনের গতিপথটি বদলে দিয়েছিল, যেখানে তিনি শুধু ‘নেটিভ’ হওয়ার কারণেই শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের অপমানের শিকার হয়েছিলেন। আর নানা দেশে ছড়িয়ে থাকা আজকের যে গান্ধী মূর্তি, তা তো ওই দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধীর নয়।

এই মূর্তিগুলো মহাত্মা গান্ধীর, যিনি ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অহিংস নীতির ওপর আস্থা রেখেছিলেন। একজন তরুণ আইনজীবী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় যে গান্ধী গিয়েছিলেন, তিন দশক পর সারা বিশ্বে পরিচিতি পাওয়া এবং বিশ্ববাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করা গান্ধী—দুজন আলাদা মানুষ। এমনকি ভারতে ফেরার পর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোভাগে আসতে আসতেই তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here