‘আম্মা অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী’

0
249


আবু মুসা হাসান:

আজ পহেলা আষাঢ়, আম্মার ১০৩ তম জন্মদিন। ২০০৪ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর ৮৭ বছর বয়সে আমাদের মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

আম্মা অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। নানার শিক্ষকতার সুবাদে আমার আম্মার শৈশব কেটেছে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায়। বিয়ের পর আমার আব্বার সাথে বেলুনিয়া, কোলকাতা এবং ঢাকায় অবস্থানকালে প্রত্যক্ষ করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ আর দাঙ্গার বিভীষিকা। পাকিস্তান আমলে ছিলেন ঢাকায়।

ছোটবেলা থেকেই আমি আন্দোলনে সংগ্রামে মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি উৎসাহ। আম্মার উপস্থিত বুদ্ধি এবং সাহস দেখে সব সময় মুগ্ধ হতাম।

আমাদের বাসা ছিল ই পিআর পীলখানার (বর্তমান বি ডি আর) লাগোয়া নতুন পল্টন লাইনে। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত বাঙালির ওপর অতর্কিত হামলা চালিয়েছিল। পাকিস্তানী তস্করদের হামলা পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে হাজার হাজার মুক্তিকামী বাঙালি ঢাকার রাজপথে নেমে আসে প্রতিরোধ করার জন্য। আমি পাড়ার বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়ি। ইপিআর এ অবস্খান নেয়া পাকিস্তানী সৈন্যরা যাতে বের হতে না পারে সেজন্য শত শত মানুষ ইপিআর গেট খেকে নিউ মার্কেট পর্যন্ত রাস্তার দুপাশের গাছ কেটে ব্যারিকেড তৈরী করছিল। আমরাও লেগে পড়লাম ব্যারিকেড তৈরীর কাজে। তবে নিউ মার্কেটের মোড়ে বিউটি রেস্টুরেন্টের কাছে পৌছার পর বুঝতে পারলাম পাকিস্তানী বাহিনী কত ভয়ংকর। মর্টারের গোলা আর মেশিন গানের গুলিতে সমগ্র ঢাকা শহর কেঁপে উঠলো। সবাই দিকবিদ্বিক ছুটে গেল। তবে আমরা চার বন্ধু দেয়াল টপকে আজিমপুর কলোনীতে গিয়ে মসজিদে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। পরে আজিমপুর কবরস্থানের ভেতর দিয়ে নতুন পল্টনে গিয়ে দেয়াল টপকে মানিক ভাইদের (রেজাউল করিম আজাদ) রাসায় গেলাম।
মানিক ভাই এর বন্ধু সোহরাব ভাইও ( পরিবেশবিদ ড. আতিক রহমান) ঐ বাসায় ছিলেন। রাতভর নিরবচ্ছিন্নভারে চললো গোলাগুলির তান্ডব। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে মানিক ভাই শহীদ হয়েছেন।

আমার দুশ্চিন্তায় আম্মা অস্খির হয়ে থাকবে ভেবে আমি আমাদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য সারারাত ছটফট করেছি। ফজরের নামাজের আজানের সময় ভেবেছিলাম গোলগুলি বন্ধ হবে। না, কোন লক্ষণ ছিলনা। অগত্যা ডানে-বামে তাকিয়ে আমাদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য সতর্কতার সাথে বেড়িয়ে পড়ি । দেয়াল টপকে বাসায় গেলাম।
আমাকে দেখে আম্মা আঁতকে উঠেলেন। কিভাবে আসলি বলে বারান্দা থেকে ইপিআর এর লোঙ্গরখানার দিকে তাকাতে বললো। দেখি লোঙ্গরখানার ছাদে দুজন সৈন্য আমাদের বাড়ীর সমনের রাস্তা বরাবর মেশিনগান তাক করে বসে আছে। ঘরে গিয়ে দেখি, ইপিআর এর দুই জোয়ান, আমি ঘরে যাওয়ার পর ওরা আঁতকে উঠলো ।আম্মা ওদের অভয় দিয়ে বললেন, ভয় নাই, আমার ছেলে।
ব্যারাকের বাঙালি জোয়ানদের ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে ওরা খুব ভীত সন্ত্রস্ত ছিল। ওরা সহ পালিয়ে আসা অন্যান্য জোয়ানদের খুঁজে বের করার জন্য বাড়ী বাড়ী তল্লাশী চালানোরও আশংকা ছিল। কিন্তু আম্মা ওদের আশ্রয় দিয়েছিলেন নিজ সন্তানের মতো। বুদ্ধি করে ওদের কম্বল দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। পাশে রেখেছিল কয়েকটি ডাব যাতে করে পাকিস্তানী সৈন্যরা তল্লাশী করতে আসলে বলতে পারতো, ওরা আমার ছেলে। জ্বরে কাতর হয়ে পড়েছে।

বিপদে-আপদে আম্মা কখনও বিচলিত হতেন না। ৭১ এর ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে বের হয়ে জিনজিরা থেকে আমরা নৌকা করে মুন্সিগন্জ যাচ্ছিলাম। খালের পাশে দাঁড়ানো লোকজন আমাদের সতর্ক করে দিচ্ছিল যে সন্ধ্যার পর ধলেশ্বরী নদীতে ডাকাতের কবলে পড়তে পারি। আম্মা তখন মাঝিকে ব্জিগ্যেস করলো, তোমার কাছে গুণ আছে নাকি? মাঝি বললো, গুণ ত আছে, টানবে কে? তখন আম্মা বল্লো, আমার ছেলে টানবে। ঐদিনই ছিল আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ গুণ টানার অভিজ্ঞতা।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য কসবার গ্রামের বাড়ী রাইতলা থেকে আগরতলার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়ার সময়ও আম্মা আমাকে আশীর্বাদ করে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিলেন।

আবু মুসা হাসান: সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক প্রেস মিনিস্টার,বাংলাদেশ দূতাবাস, যুক্তরাজ্য

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here