‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১০)

0
70

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(পর্ব- ১০)

এমনি অবস্থায় আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরব যাই। আসা-যাওয়া মাত্র দশদিন। যুগান্তর সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ব্যক্তিগত কাজে যান যুক্তরাষ্ট্র। এই সময়ে বাবুল সাহেবকে একদিন আদালতে হাজির করা হয়। সেদিন যুগান্তরের উচ্চপদস্থ সাংবাদিক, কর্মচারীরা অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ছিলাম না সারওয়ার সাহেব আর আমি। আমি তার জামাতার মাধ্যমে ওমরাও পালন করতে যাবার খবর জানিয়ে গিয়েছিলাম। সারওয়ার সাহেবও নিশ্চয়ই জানিয়েছিলেন। কিন্তু জেলে থাকায় বাবুল সাহেব হয়তো ভুলে যেতে পারেন। আদালতে আমাদের দু’জনকে না দেখে জানতে চান, আমরা গেলাম না কেন? যা আমি অনেক পরে শুনেছি। সেখানে উপস্থিত একজন রিপোর্টর জানিয়েছেন। কিন্তু কেউই সঠিকভাবে আমাদের না-আসার কারণ বলেননি। আমরা যে দেশে নেই তাও বলেননি। আদালতে আসামির সঙ্গে কথা বলার খুব বেশি সময় পাওয়া যায় না। আর সে-সময় ছিল আরো কড়াকড়ি। আমি শুনেছি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সারওয়ার সাহেব ও আমার উপস্থিত না থাকার কারণে বাবুল সাহেব বেশ মনঃক্ষুণ হন। তার কথা হলো দুঃসময়ে আমরা নেই। উপস্থিত দায়িত্বশীল কেউ কেউ তার বক্তব্য সমর্থন করেন। আসলে মানুষ যখন বিপদগ্রস্ত হয় তখন সামনে যারা থাকে তাদেরই মূল্যায়ন করেন। আগে কে কী করেছে সেটি খুব কম মানুষই মনে রাখেন। আর যদি মালিক কর্তৃপক্ষ হয় তখন কর্মচারীদের সারাক্ষণই পাশে চান। কর্মচারীদের যেন নিজস্ব কোনো প্রয়োজন থাকতে নেই। এটাই মানুষের সহজাত অভ্যাস। আগেই বলেছি এ কথা আমি অনেক পরে শুনেছি। যুগান্তর থেকে পদত্যাগেরও কয়েকবছর পর। আমি ওমরাহ পালন শেষে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বাবুল সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের প্রিজন সেলে। একই সেলে প্রথম বেডে ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তৃতীয় বেডে ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। বাবুল সাহেব ছিলেন সেলের শেষ অর্থাৎ পশ্চিম প্রান্তের বেডে। তার বেডটি পর্দা দিয়ে ঘেরা ছিল। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা হলো। তিনি দেশের অবস্থা জানতে চান। আমার যতটুকু জানা ছিল বলি। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে ফিরে আসি। আসার সময় নাসিম সাহেবের সাথে কয়েক মিনিট কথা বলি। তার খবরাখবর জানতে চাই। বিএসএমএমইউ থেকে ফিরে সোজা আমি অফিসে। সারওয়ার সাহেব তখনো দেশে ফিরেননি। আমি অফিসের খবরাখবর নিলাম।

এভাবেই চলতে থাকে। কিছু দিনের মধ্যে বাবুল সাহেবকে চিকিৎসার্থে বারডেমে ভর্তি করা হয়। আইনি প্রক্রিয়াও চলতে থাকে। মাঝে মাঝে আমরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বারডেমে তাকে দেখতে যাই। অফিস, দেশ নিয়ে কথা হয়। পত্রিকার ব্যবসা কমে যাওয়ায় তিনি সন্তুষ্ট নন। এর মধ্যে ফিরে আসেন সারওয়ার সাহেব। কাজে যোগদান করেন। আইনি প্রক্রিয়ায় বাবুল সাহেবও বেরিয়ে আসেন। জেলে থাকার সময় তার ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তদুপরি সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হয়েছে বিরাট অংকের টাকা। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তিনি চেষ্টা করতে থাকেন। যুগান্তরের ব্যবসা বাড়ানোরও তাগিদ দেন। সারওয়ার সাহেব, আমি ও সাইফুল সাহেবের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন। মাঝে মধ্যে আমার ও সাইফুল সাহেবের সঙ্গে আলাদাভাবে বসেন। তার এসব বৈঠকে টের পাই, তিনি সারওয়ার সাহেবের প্রতি কেন জানি অসন্তুষ্ট। এরই মধ্যে পত্রিকার সার্কুলেশন না বাড়িয়ে ব্যবসা বাড়ানোর আলাদা উদ্যোগ নেয়া হয়। কারণ সার্কুলেশন বেশি থাকলে নিউজপ্রিন্টের খরচ বেশি হয়। আর কম সার্কুলেশনে বেশি বিজ্ঞাপন না হলেও বর্তমান হার বজায় থাকলেও বেশ লাভ। কিছু কিছু বিষয়ে স্পষ্ট বৈপরীত্য লক্ষ করি। এই টানাপড়েনের মধ্যে চলে যায় কিছু দিন। এরপর এক দুপুরে সারওয়ার সাহেব অফিসে এসে বললেন, তিনি আর যুগান্তরে থাকবেন না। আজই চলে যাবেন। আবার পদত্যাগ। সেদিনই তিনি বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। না, এবার কোথাও চাকরি নিয়ে গেলেন না। নতুন পত্রিকা ছাড়া কোথাও যাওয়ার সুযোগও ছিল না। কেননা তার প্রতিষ্ঠিত দ্বিতীয় পত্রিকা সমকালে তখন আবেদ খান সম্পাদক। চোখের পানিতে সারওয়ার সাহেবকে আমরা বিদায় দিলাম। বিদায়ের সময় আমি তাকে বলেছিলাম ‘আপনি যান, আমিও আসছি’ আমি বুঝতে পেরেছিলাম এত ঘন ঘন সম্পাদক বদলের কাগজে বেশিদিন স্থায়ী হওয়া মানে ‘পুতুলের’ মতো হয়ে থাকা। আর পরিস্থিতিও সহনশীল ছিল না। দিন দিন অবনতি হচ্ছিল। সারওয়ার সাহেবের পর যুগান্তরের অভিভাবক বাবুল সাহেবের স্ত্রী ও প্রকাশক সালমা ইসলাম। প্রথমে তিনি ভারপ্রাপ্ত পরে পূর্ণ সম্পাদক হলেন। বাবুল ভাইয়ের সাথে পত্রিকা নিয়ে যেদিন প্রথম আমার আলোচনা হয়েছিল সেদিন তিনি বলেছিলেন, তিনি একটি পত্রিকা করবেন এবং তার স্ত্রী সালমা ইসলাম সম্পাদক হবেন। আমাকে উপদেষ্টা সম্পাদক হিসেবে আসার প্রস্তাব দেন। জনকণ্ঠ পত্রিকা দেখিয়ে তিনি সেদিন এ কথা বলছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম পত্রিকা কিন্তু খুব লাভজনক ব্যবসা নয়। আপনি আরো চিন্তা করেন। আর পত্রিকার জন্য নামকরা সাংবাদিককে সম্পাদক করে আনতে হবে। আর আমি এখনো সম্পাদক হওয়ার মতো উপযুক্ত অবস্থায় যাইনি। যাহোক সে আরেক কাহিনী।সালমা ইসলাম সম্পাদক হওয়ার পর যুগান্তরের সাংবাদিক কর্মচারীরা আশা করেছিলেন পরিস্থিতির উন্নতি হবে, বেতন-বৈষম্য দূর হবে। তখন এলো আরেকটি নতুন ওয়েজ বোর্ড। সেটা বাস্তবায়নে বড় বাধায় পড়তে হলো। কোনো কোনো বিভাগ ওয়েজ বোর্ড পাবে, কোনো কোনো বিভাগ পাবে না এমন একটি সিদ্ধান্ত এলো কর্তৃপক্ষের। আমি বললাম, সবাইকে দিতে হবে। নইলে অফিসে শৃঙ্খলা থাকবে না। কাজের গতি নষ্ট হবে। আর যুগান্তর কোনো ছোট সংবাদপত্র নয়। বড় পত্রিকা। এ বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দেই যে, যুগান্তরের দুর্দিনের এখানকার বিভিন্ন বিভাগের লোকজন আনা হয়েছে ওয়েজবোর্ড দিয়ে। এখন কেউ পাবে, কেউ পাবে না তা হয় না। আমার এ অটল অবস্থানের পক্ষে উচ্চপদস্থ কেউ কেউ পাশে থাকেননি। বরং কর্তৃপক্ষকেই মৌন সমর্থন দিয়েছেন। যুগান্তরের সাংবাদিক কর্মচারীরা আশা করেছিলেন নতুন সম্পাদকের (মালিক-সম্পাদক) মাধ্যমে নতুন ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নসহ বিদ্যমান নানা সমস্যা সমাধান হবে। কিন্তু তিনি অর্থাৎ বাবুল সাহেবের সহধর্মিণী এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেননি বা নিতে পারেননি। এ অবস্থায় ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নে জটিলতা দেখা দিল। আমি যখন যুগান্তরে আসি তখন বোনাস পাওয়ার যারা যোগ্য ছিলেন না তারাও পেয়েছিলেন। বেতন-ভাতার অনেক বৈষম্য দূর হয়। কিন্তু এখন দেখছি পরিস্থিতি ভিন্ন। এ অবস্থায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমিও যুগান্তর ছাড়লাম। দিনটি ছিল ২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট। চাকরি ছাড়ার আগের দিন ছিল পবিত্র শবেবরাত। আমার ছোট ছেলে ও মেজো ছেলেসহ বাসার সামনের তাকওয়া মসজিদে ইবাদত বন্দেগি করে রাতটি কাটাই। এ রাতেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিই। পরদিন ভোরে অফিসে গিয়ে নিজ হাতে পদত্যাগপত্র লিখে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে দিয়ে উপস্থিত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসি। আমি কিন্তু অন্য কোনো চাকরি ঠিক করে পদত্যাগ করিনি। তাই এবার আমি বেকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন থেকেই সংবাদপত্রে কাজ করি। লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিই। কোনো সময়ে বেকারত্ব বরণ করতে হয়নি। সবসময় ভালভাবে চলেছি। ছেলেদের লেখাপড়া, সংসার ভালভাবে চলছে। চাকরি ছাড়া আমার অন্য কোনো আয় ছিল না। চাকরি ছাড়ার পর আয় বন্ধ। সামনে অন্ধকার। আর সংবাদপত্রে চাকরি করে একধরনের জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলাম। সারাদিন কাজ আর কাজ। কিন্তু এখন কাজ নেই। সময় কাটানোর জন্য সকাল বিকাল সোনারগাঁও হোটেল লবিতে আড্ডা আর গালগল্প। বাসায় এসে হতাশা। বড় ছেলে তখন আমেরিকাতে বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করছে। মেজো ছেলে গ্র্যাজুয়েশন করে বৃত্তি নিয়ে পিএইচডি করতে আমেরিকা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আর ছোট ছেলে সবেমাত্র নটরডেম কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে। এক কঠিন সময়। যে সময়ের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। যুগান্তর প্রকাশের সময় আমি যোগদান করিনি শুধু চাকরির অনিশ্চয়তার জন্য। সারওয়ার সাহেবের পদত্যাগের পর যুগান্তরের দুঃসময়ে আমি বাবুল সাহেবের বিশেষ অনুরোধে এগিয়ে আসি। মূসা সাহেবসহ সবাইকে নিয়ে যুগান্তরের অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম। কিন্তু এখন আমি নিজেই অনিশ্চয়তায়। আর আমি নিজেই এই পথ বেছে নিই। নব্বই দশকের শেষ দিকে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) দু’বার নির্বাচিত যুগ্ম মহাসচিব ছিলাম। দু’বার সভাপতি ছিলাম ঢাকা রিপোর্টাস ইউনিটির। সাংবাদিক কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। সবসময় আত্মসম্মান নিয়ে চলার চেষ্টা করেছি। সেই অধিকার আদায়ের দাবি থেকে পিছিয়ে এলে এবং আত্মসম্মান না থাকলে এত বছরের সেই আমি আর আমি রইলাম কই? এই সান্ত্বনা নিয়ে ধৈর্য ধরে কষ্টে দিন কাটাতে থাকি। এভাবে চলে প্রায় নয় মাস।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here