করোনা সংক্রমণে সঠিক চিত্র নাগালের বাইরে

0
99

বাংলা খবর ডেস্ক:
দেশে করোনা সংক্রমণ ও শনাক্তের হার না কমলেও নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমছে। কিট স্বল্পতা ও জনবলের অভাবে সবক’টি ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সারাদেশে নমুনা পরীক্ষার জন্য মোট ৭৩টি ল্যাব (ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার) চালু হলেও ৫/৭টিতে প্রায়ই নমুনা পরীক্ষা বন্ধ থাকছে।

সর্বশেষ ৬ জুলাই সোমবার স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে জানানো হয়, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৬৮টি পরীক্ষাগার থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল গত ২ জুন ১৮ হাজার ৩৬২টি। দেশের স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দৈনিক ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে আসলেও ওই লক্ষে পৌছাতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংস্থাটি নমুনা পরীক্ষায় তার সক্ষমতার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এর ফলে পরীক্ষার সংখ্যা আপাতত বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ খুবই কম বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে করোনা সংক্রমণের সঠিক চিত্র নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

এ ব্যাপারে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বেনজির আহমেদ সোমবার সংবাদকে বলেছেন, ‘পিসিআর ল্যাবের সীমাবদ্ধতা ও টেস্ট কিটের অভাবে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কম হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে, দেশে করোনা সংক্রমণ কমে গেছে। সংক্রমণ কমে গেছে-এই সিদ্ধান্তে পৌঁছার সময় এখনও আসেনি। আমার ধারণা, টেস্ট ফি ২০০ টাকা ও বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহে ৫০০ টাকা নির্ধারণের কারণে অনেকেই এখন টেস্টের প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছে না; গ্রামাঞ্চলের অনেকের এই ফি দিয়ে নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতাও নেই। তাছাড়া অনেক হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় সেখানে পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসছে।’

দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণ সর্ম্পকে ড. বেনজির আহমেদ বলেন, ‘করোনা পরীক্ষায় সরকার তার সক্ষমতার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌছেছে। ২০ হাজারের বেশি পরীক্ষা করার সক্ষমতাই নেই। দেশে অনেক রোগী এখন অশনাক্ত হয়েছে। সঠিকভাবে শনাক্ত করতে না পারলে, রোগীকে চিকিৎসা দিতে না পারলে-এটা বলা কঠিন যে, করোনা কমছে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ২ জুন থেকে সোমবার ৬ জুন পর্যন্ত পাঁচ দিনে মোট ৭৫ হাজার ৯৭২টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। এসব পরীক্ষায় ১৬ হাজার ৩৬০ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। এই পাঁচ দিনে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ২১ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

আর ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে আট লাখ ৬৩ হাজার ৩০৭টি। এসব পরীক্ষায় মোট এক লাখ ৬৫ হাজার ৬১৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ, যা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বেশি।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন সংবাদকে বলেন, ‘কয়েকদিন সংক্রমণ কম দেখে সংক্রমণের হার কমেছে তা বলা যাবে না। পর্যাপ্ত সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা না হওয়া, জনবল স্বল্পতা, বন্যা ও বৃষ্টির কারণে উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে না আসা ইত্যাদি কারণে পরীক্ষা কম হতে পারে। এজন্য তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ না করে এখনই সংক্রমণের প্রকৃত হার বলা দুরূহ ব্যাপার।’

সামনে কোরবানির ঈদের কারণে সংক্রমণের হার আবার বৃদ্ধি পেতে পারে-মন্তব্য করে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘মানুষ গ্রামে ঈদ করতে গেলে এবং কোরবানির হাটে সমবেত হলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। ঈদ যাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে সংক্রমণের ধারা আবারও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।’

চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু ঘটে গত ১৮ মার্চ। বিশ্বের ২১৫টি দেশ ও অঞ্চল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

গত পাঁচ দিনে নমুনা পরীক্ষার চিত্র:

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত বুলেটিনে যুক্ত হয়ে ৬ জুলাই সংস্থার অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির তথ্য তুলে ধরে জানান, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের ৬৮টি ল্যাবে ১৪ হাজার ২৪৫টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন হাজার ২০১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

৫ জুনের বুলেটিনে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় ৬৮টি ল্যাবে ১৩ হাজার ৯৮৮টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ৭৩৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে।

৪ জুনের বুলেটিনে বলা হয়, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ৬৪টি ল্যাবে ১৪ হাজার ৭২৭টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন হাজার ২৮৮ জনের শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে।

৩ জুনের বুলেটিনে বলা হয়, ২৪ ঘন্টায় ১৪ হাজার ৬৫০টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন হাজার ১১৪ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছে। এর আগে ২ জুনের বুলেটিনে বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৩৬২টি নমুনা পরীক্ষা রেকর্ড চার হাজার ১৯ জনের করোনা শনাক্ত করা হয়।

শীর্ষ দেশগুলোর সংক্রমণের চিত্র :

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ডোমিটারের করোনা সংক্রান্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিল ছাড়া প্রায় সারাবিশে^ই নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ১৮ শতাংশ।

করোনা সংক্রমণের শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে ৬ জুলাই পর্যন্ত তিন কোটি ৭৬ লাখ দুই হাজার ৪৭১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব পরীক্ষায় দেশটিতে সর্বোচ্চ ২৯ লাখ ৮৪ হাজার ৭৬৪ জনের শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

রাশিয়ায় ৬ জুলাই পর্যন্ত দুই কোটি ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৩৯৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। রাশিয়ায় মোট ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৮৬২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় দেশটিতে শনাক্তের হার ৩ দশমিক ২২ শতাংশ।

ভারতে ৬ জুলাই পর্যন্ত ৯৯ লাখ ৬৯ হাজার ৬৬২ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব পরীক্ষায় দেশটিতে সাত লাখ ৭২৪ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। দেশটিতে পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্ত হয়েছে ৭ দশমিক ০২ শতাংশ মানুষের করোনা।

পাকিস্তানে ১৪ লাখ ২০ হাজার ৬২৩টি নমুনা পরীক্ষা করে মোট দুই লাখ ৩১ হাজার ৮১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় পাকিস্তানে শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এদিকে এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার তুলনায় জ্ঞান-বিজ্ঞান, চিকিৎসা, আধুনিক শিক্ষা ও তথ্য-প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় বেশি করোনা শনাক্ত হচ্ছে। লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে ৬ জুলাই পর্যন্ত মোট ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ৫৬২টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব পরীক্ষায় দেশটিতে মোট ১৬ লাখ চার হাজার ৫৮৫ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ৪৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। যদিও দেশটিতে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরও তা ঠেকাতে কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি দেশটির প্রেসিডেন্ট। তিনি উল্টো করোনা সংক্রমণ নিয়ে নানা সময় বিরূপ মন্তব্য করেন।

লাতিন আমেরিকার অপর দেশ পেরুতে ৬ জুলাই পর্যন্ত ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৮৪৬টি নমুনা পরীক্ষা করে তিন লাখ দুই হাজার ৭১৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পেরুতে পরীক্ষা বিবেচনায় করোনা শনাক্তের হার ১৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
সূত্র: সংবাদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here