‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১৬)

0
92

শাহজাহান সরদার:
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ১৬)

বড় চাকরি ছেড়ে নতুন কাগজ বের করতে এসে এখন কাগজই হচ্ছে না। তাই বড় হতাশা গ্রাস করে। শামীম সাহেবের মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। তবু আসার আগে তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসেছি। এই ঘটনার পর কয়েকদিন হোটেল সোনারগাঁয়ে দেখা হয় আমার সেই স্নেহাস্পদ বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্ণধারের সঙ্গে। তিনি প্রথম বললেন, দেখেছেন তো। আমি তো আগেই বলেছিলাম, শামীম সাহেব কাগজ বের করবেন না। শুনলাম আরো অনেক কথা। প্রায় প্রতিদিন শামীম সাহেব কোন না কোন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতেন। সংবাদপত্র সম্পর্কে ধ্যান-ধারণা নিতেন। যা শুরু করেছিলেন দীর্ঘকাল আগে। আমার কাছ থেকে নিয়েছেন প্রায় সাত-আট বছর। এমন আরও অনেকের কাছ থেকে নিয়েছেন। আর আমাকে এনে পত্রিকা করবেন সব ঠিকঠাক করার পর তিনি আমার সাথে আলোচনা না করে বুদ্ধি নিতেন তার মতো করে তথাকথিত তরুণ সাংবাদিকদের সঙ্গে। তার কথামতো দু’একজন তরুণ সম্পাদক এবং ঊর্ধ্বতন পদধারীদের সঙ্গে তিনি একাধিকবার বৈঠক করেছেন। পত্রিকা প্রকাশ করলে কি সুবিধা-অসুবিধা, লাভ-লোকসান ইত্যাদি নিয়ে তাদের কথা হতো। এর মধ্যে একজন বুদ্ধি দিয়েছেন পত্রিকা করে লাভ কী? বিপদে-আপদে তো তারাই আছেন। আর কেউ কেউ বলেছেন, পত্রিকায় এখন বেশি বিনিয়োগ। এত বিনিয়োগ না করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করা ভাল। কেউ কেউ বসুন্ধরার ভয়ও দেখিয়েছেন। আমাকে নিয়ে কাগজ বের করলে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ অসন্তুষ্ট হতে পারে। এতে তিনি বিপদগ্রস্ত হতে পারেন। শামীম সাহেব তাদের কথায় হোক, নিজের বুদ্ধিতে হোক অথবা অর্থের অভাবে হোক দৈনিক পত্রিকা আর প্রকাশ করেননি। আমি বিদায় নিয়ে এসেছি। পরে শুনেছি যারা শামীম সাহেবকে বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন তার অর্থে বিদেশভ্রমণ করেছেন। আকারে ইঙ্গিতে শামীম সাহেবও একবার আমাকে কথাটা বলেছিলেন। তখন বুঝিনি, পরে বুঝেছি। তিনি বলেছিলেন, ভাই ডাকাত! ডাকাত! কিছু কিছু সাংবাদিক সম্পর্কে এমন বলেন। হোটেল ওয়েস্টিনে একটি ভোজের কথাও তিনি বলেছিলেন। তখন আমি ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলাম আপনি এরকম বলবেন না। সব পেশায়ই ভাল-খারাপ থাকে। তবে খারাপের সংখ্যা কম। আর আপনাদের মতো কিছু লোক তাদের দিয়ে সুবিধা আদায় করেন। আবার বদনাম করেন। আবার সময়মতো ঠিকই মেলামেশা করেন। সেদিনের তথ্যে আমি বুঝতে পারি ঘটনার পেছনে কোথাও কোন না কোন কিছু কাজ করেছে। সেটা কী তা আজও আমার কাছে রহস্যই রয়ে গেছে। তবে এরপর শামীম সাহেবের সঙ্গে দু’একবার দেখা হয়েছে। আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি কেন কাগজ বের করলেন না? তিনি জবাব দেননি। বারবার এড়িয়ে যান। কেন আমার এত বড় ক্ষতি করলেন? তার জবাবও দেননি। তবে এটা সত্য, আমাকে দেখলে তার মধ্যে একধরনের অপরাধবোধ কাজ করে। এ অবস্থায় ল্যাবএইড গ্র“পের নামে ডিক্লারেশন নেয়া দৈনিক পত্রিকা ‘বাংলা দৈনিক’ এর সম্পাদকের পদ থেকে ২০১২ সালের ১১ জুলাই আমি পদত্যাগ করি।

ল্যাবএইডে থাকার সময়ই আশিয়ানগ্র“পের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রস্তাব আসে। তারা একটি কাগজ করছে। অফিস নিয়েছে। লোকবল নিয়োগ করে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণও দেয়া হচ্ছে। যখন এমন প্রস্তাব এসেছিল তখনও শামীম সাহেব পত্রিকা করবেন না এমনটি জানা যায়নি। তাই আশিয়ান গ্র“পের পক্ষ থেকে আসা প্রস্তাবে আমি সায় দিইনি। আর বসুন্ধরা ও আশিয়ান গ্র“পের মধ্যে একধরনের দ্বন্দ্ব আছে। আশিয়ান গ্র“পের পত্রিকায় যোগ দিলে বসুন্ধরা কর্তৃপক্ষ হয়তো সহজভাবে নেবে না। মনে করতে পারে আমি মনে হয় এ জন্যই বাংলাদেশ প্রতিদিন ছেড়েছি। আমিও আর চাই না গ্র“পে গ্র“পে দ্বন্দ্ব এমন কোন গ্র“পের কাগজে আবার কাজ করি। আগে বিভিন্ন গ্র“পের কাগজে কাজ করে তো এমন দেখেছি। এ-ধরনের কাগজে কাজ করা মানসিকভাবে একধরনের যন্ত্রণা। কিন্তু মানুষের সব চাওয়া তো পূরণ হবার নয়। সব ইচ্ছাই বাস্তবায়ন হয় না। আমার বেলাও তাই হয়েছে। শামীম সাহেব যেদিন ব্যক্তিগত চিঠি দিয়ে জানালেন, পত্রিকা প্রকাশ করবেন না, সেদিনই কাকতালীয়ভাবে আবার আশিয়ান গ্র“পের পক্ষ থেকে তৃতীয় এক ব্যক্তি যোগাযোগ করেন। আমি তাকে জানাই ঠিক আছে মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসতে হবে। আমার কিছু বক্তব্য আছে। যদি রাজি হন তাহলে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। তবে কয়েকদিন পর। তখনও ল্যাবএইড থেকে আমি বিদায় নেইনি। একই দিন আমি নিজেই যোগাযোগ করি বসুন্ধরা গ্র“পের এম ডি সায়েম সোবহানের (আনভীর) সঙ্গে। কেননা আমি প্রতিদিন থেকে আসার সময় তিনি বলেছিলেন, কোনোদিন কোনো সমস্যা হলে যোগাযোগ করবেন। সে কথা মনে করেই ফোনে জানালাম, দেখা করতে চাই। পরদিনই সময় দিলেন। গেলাম। দেখা হলো। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কথাবার্তা। তাকে জানালাম শামীম সাহেব কাগজ বের করছেন না। তিনি বললেন, কেন? আমি বললাম বিষয়টি ঠিক আমারও বোধগম্য নয়। আর কিছু আলাপ-আলোচনার মধ্যে তিনি বসুন্ধরা গ্র“পের নিয়ন্ত্রণাধীন আরেকটি কাগজে আমাকে সম্পাদক হিসাবে যোগদানের জন্য বললেন। আমি বললাম, না তা ঠিক হবে না। সঠিকভাবে এ কাগজ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে। ফিরে আসার সময় তিনি আগের মতই বললেন। যেখানেই থাকেন যোগাযোগ রাখবেন।আমি তার কাছে বলতে গিয়েছিলাম যে, আশিয়ান গ্র“পের কাগজ থেকে প্রস্তাব এসেছে। যেহেতু চাকরিতেই সংসার চলে তাই চাকরি করতেই হবে। তারা যেন ভুল না বুঝেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে আমার আর সে কথা বলা হয়ে ওঠেনি। তার কাছ থেকে ফিরে এসে ল্যাবএইড থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। একদিন পর আশিয়ান গ্র“পের ডিএমডি’র সঙ্গে বৈঠক। গুলশানের ওয়েস্টিনে। নিয়ে গেলেন আমারই সাথে আগে এক পত্রিকায় কাজ করা এক কর্মকর্তা। তিনিই যোগাযোগ করছিলেন। ডিএমডি সাইফুল ইসলাম। বয়স অল্প, আমার ছেলের সমান। আশিয়ান গ্র“পের তখন রমরমা ব্যবসা। পত্রিকায় বড় বড় বিজ্ঞাপন দেয়। জমির ব্যবসা। আশিয়ান হাউজিং। সাইফুলের সঙ্গে কথা হলো। আমি যা বলার তিনিই তা বললেন। জানালেন কাগজটি আপনি চালাবেন আপনার মত করে। আমরা হস্তক্ষেপ করব না। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে আমরা কারো বিরুদ্ধে অযথা কোন নিউজ দিতে বলবো না। দু’একটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করে বললেন, তাদের মতো খোঁচাখুঁচি আমরা করব না। আমি তো একথাগুলোই বলতে চেয়েছিলাম। তিনি যা বলেছেন এতে আমার আর কিছু বলার রইলো না। বেতন-ভাতা ইত্যাদি নিয়ে কথা হলো। সেদিনই মোটামুটি স্থির হলো আমি যোগ দিচ্ছি। পত্রিকার নাম মানবকণ্ঠ। গুলশানে অফিস। আমার সাথে যে আলোচনা হয়েছে তিনি তৎক্ষণাৎ তার বড় ভাইকে টেলিফোনে জানালেন। যিনি প্রতিষ্ঠানের এম ডি। বিদেশ সফরে রয়েছেন। তাদের মধ্যে কথা হওয়ার পর জানান, কালই চুক্তি হবে। তিনি বললেন, হয় আশিয়ান গ্র“পের অফিসে নাহয় মানবকণ্ঠ অফিসে যেতে। আমি বললাম, না বাইরে কোথাও বসি। ফিরে আসার আগে সিদ্ধান্ত হলো আমার সাথে যিনি গিয়েছিলেন তাকে জানাবেন কোথায় আমরা বসব। পরদিন বিকালে খবর পেলাম রাতে গুলশানের এক রেস্তোরাঁয় আমরা বসবো। গেলাম সেই রেস্তোরাঁয়। কথামতো তিনি একটি চুক্তিনামা নিয়ে আসেন। এর কিছু শর্ত আমার পছন্দ হলো না। এগুলো কর্পোরেটমার্কা শর্ত। বললাম পরিবর্তন করতে হবে। সংশোধনের পর দু’পক্ষই আমরা স্বাক্ষর করি। এই মানবকণ্ঠ পত্রিকাটির মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলির সাবেক সদস্য ড. মোহাম্মদ সেলিম। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের বড়ভাই। তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছে আশিয়ান গ্র“প। আমি যোগদানের আগে সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন জাকারিয়া খান চৌধুরী। হবিগঞ্জের লোক। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। তার বড়ভাই জাকির খান চৌধুরীও এরশাদ সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা সংসদেরও সভাপতি ছিলেন। জাকারিয়া সাহেব খুবই ভদ্র, নম্র মানুষ। বয়স হয়েছে বেশ। তিনি এককালে ইসলাম গ্র“পের উপদেষ্টাও ছিলেন। পরে আমিন মোহাম্মদ গ্র“পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এ গ্র“পের সঙ্গে ছিলেন আশিয়ানের এম ডি নজরুল ইসলাম খানও। সেই থেকে তাদের পরিচয়। এখন আশিয়ানের সঙ্গে আছেন। সেই সুবাদে তার নামেই ডিক্লারেশন নেয়া হয়। আমি সম্পাদক হওয়ার পর তিনি প্রকাশক রইলেন। আমার সাথে যখন চুক্তিনামা স্বাক্ষর হয় তখন আশিয়ানের এমডি দেশের বাইরে ছিলেন। দু’দিন পর দেশে ফিরে এলে ২০১২ সালের ১৬ জুলাই আমি যোগদান করি। সন্ধ্যায় যোগদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সাংবাদিক, কর্মচারী-কর্মকর্তা উপস্থিত। তখন মানবকণ্ঠের পরামর্শক হিসাবে কাজ করতেন আমারই স্নেহভাজন নাজমুল আশরাফ। আমি যখন ইত্তেফাকে তখন তিনি নিউনেশনে ছিলেন। পরে ছিলেন ডেইলি স্টারে রিপোর্টার। সেখান থেকে চ্যানেল ওয়ানের বার্তাপ্রধান। তখন থেকেই টিভি সাংবাদিকতা। মাঝে কিছুদিন মানবকণ্ঠের পরামর্শক। যোগদান অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ছিলেন তিনি। প্রথমে আমার সম্পর্কে মোটামুটি একটি ভূমিকা দিলেন। কয়েকজন স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য দেয়ার পর আমিও বক্তব্য রাখি। মালিক নজরুল সাহেবের লেখাপড়া কম কিন্তু বুদ্ধিবিবেচনা ভাল। তিনিও বেশকিছু কথা বলেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক কথা। আমার এ যোগদান সভার সবচাইতে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দেশের পত্রিকা বিক্রয়কারীদের সংগঠন বাংলাদেশ নিউজপেপার এজেন্টস্ এসোসিয়েশনের এক প্রতিনিধির উপস্থিতি। তিনি সভায় বক্তৃতায় বলেন, আমাদের সভাপতি, সম্পাদক ঢাকার বাইরে। তারা আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি মনে করি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে আজ এক ইতিহাস সৃষ্টি হলো। কেননা এই সম্পাদকের সাফল্যের ইতিহাস আছে। ব্যর্থতার ইতিহাস নেই। আমরা তাকে নিয়ে আশাবাদী। তাই কারও আমন্ত্রণ ছাড়াই সম্পাদককে শুভেচ্ছা জানাতে আমরা এখানে এসেছি। সংবর্ধনা সভা শেষে অনেক রাতে বাসায় ফিরি। স্ত্রী ও ছোট ছেলে অপেক্ষায় ছিল। একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে খেতেই তাদের যোগদানের বিষয় জানাই। পরদিন থেকে মানবকণ্ঠ অফিস শুরু। সকাল-সকালই পৌঁছালাম। তখনও অনেকে আসেননি। পত্রিকার বিজ্ঞাপন, প্রশাসন, সার্কুলেশন বিভাগে কর্মকর্তারা সকাল-সকালই অফিসে আসেন। নিউজের পালা ডিউটি। আর রিপোর্টাররা অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে শেষ করে আসেন। পত্রিকাটিতে আগেই সকল বিভাগের লোকবল নিয়োগ করা হয়। সুন্দর ডেকোরেশনও আছে। ডামি হচ্ছে। শুধু বাজারজাতের অপেক্ষা। দীর্ঘদিন ডামি হলেও বাজারজাত করতে পারছে না। বেশ কয়েকবার তারিখ পরিবর্তন করা হয়। এ অবস্থায় আমার যোগদান। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এলে আমি তাদের সাথে প্রথমে বসি। কোন বিভাগের কত কর্মকর্তা, কর্মচারী, সাংবাদিক রয়েছে চোখ বুলিয়ে দেখি। প্রথম দিনই পর্যায়ক্রমে সব বিভাগের সাথে আলাদা বৈঠক করে পরিচিত হয়ে নিই। দ্বিতীয় দিন সব বিভাগের যৌথ সভা। এ সভা থেকে বোঝার চেষ্টা করি কেন পত্রিকাটি বাজারজাত করা সম্ভব হচ্ছে না। মোটামুটি ধারণা হয়। সেদিনই চিন্তা-ভাবনা করি কিছু রদবদল প্রয়োজন আছে। এত সাংবাদিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী থাকলেও পত্রিকা বাজারজাত করতে যা যা প্রয়োজন এসবের ঘাটতি ছিল। সন্ধ্যায় ডিএমডি সাইফুল সাহেব আসেন। আমি বললাম একমাসের মধ্যে পত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। কেননা ইতোমধ্যেই অনেক অপ্রয়োজনীয় অর্থ-ব্যয় হয়ে গেছে। কিন্তু পত্রিকা প্রকাশ করতে হলে কয়েকটি বিভাগে দক্ষ কিছু লোকের প্রয়োজন। তিনি বললেন, যা করতে হবে আপনি করেন। তবে এত তাড়াতাড়ি কি সম্ভব? আমি বললাম সম্ভব। আমি দু’তিন জন দক্ষ লোক নিব। পত্রিকা প্রকাশের প্রক্রিয়ায় পরে দেখা যাবে কী অবস্থা। তখন বুঝে-শুনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। তিনি বললেন ঠিক আছে। অফিস থেকে বের হয়ে রাতেই আমি ফোন করলাম আবু বকর চৌধুরীকে। তিনি তখন সমকালের বার্তা সম্পাদক। আগে আজকের কাগজে ছিলেন। কিছুদিন সকালের খবরেও ছিলেন। বললাম, তোমার সঙ্গে কথা আছে। কাল সকালে সোনারগাঁ হোটেলে আসতে পার। বকর রাজি হলেন। মানবকণ্ঠে আমার যোগদানের খবর তড়িৎ ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়াপাড়ায়। বিভিন্ন সংবাদপত্রে অনলাইন পত্রিকায় নিউজও ছাপা হয়। আমার এ যোগদানকে অনেকে সাধুবাদ জানান। আবার অনেকে বলেন ঠিক হয়নি। এমন নানা আলোচনা-সমালোচনা। অনেকে চাকরির জন্য যোগাযোগ করেন। বকর চৌধুরীও মনে হয় জানতেন তার সঙ্গে মানবকণ্ঠ নিয়ে কথা বলব। পরদিন সাড়ে ১১টার দিকে বকর চৌধুরীর সঙ্গে কথা হয়। আমি সরাসরি তাকে প্রস্তাব দেই। নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব। রাজি হলে তাড়াতাড়ি যোগদান করতে হবে। নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে নিয়োগদানের জন্য আমার বিকল্প চিন্তাও ছিল। বকর রাজি না হলে অন্য ব্যবস্থা নিব। আমি তাকে প্রাধান্য দেই এ কারণে যে, তিনি ধীরস্থির। পত্রিকার সব বিষয় সম্পর্কে অবগত না থাকলেও নিউজ সম্পর্কে ধারণা আছে। এবং নিজের কাজটি করার চেষ্টা করেন। আমার প্রস্তাবে বকর বললেন, তিনি যোগদান করবেন। তবে সাতদিন সময় দিতে হবে। বললাম, ঠিক আছে। বেতন-ভাতা ঠিক হলো। আমার মেইলে তার একটি ছোট বায়োডাটা পাঠানোর কথা বলে আমি অফিসে পৌঁছি। সেদিনই বায়োডাটা পাই এবং নিয়োগপত্র তৈরি করে মেইলে পাঠাই। পরদিন হাতে তুলে দেই। একই দিন আমি কম্পিউটার বিভাগের জন্য আগে যুগান্তরে চিফ ছিলেন তাকে আনার জন্য কথা বলি। তিনিও রাজি হলেন নির্ধারিত সময়ে দু’জনই যোগ দিলেন। পত্রিকা বাজারজাতকরনের তারিখ উল্লেখ করে বিজ্ঞাপনদাতাদের চিঠি দেয়া হয়েছে। সারাদেশে এজেন্টদের সাথেও যোগাযোগ শুরু হয়। ঢাকার হকার্স সমিতির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দু’দফা বৈঠক হয়। সমিতির নেতৃবৃন্দ ও এজেন্টদের সঙ্গে আমার একটা সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের। তারা সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন। ডেডলাইনের মাত্র সাতদিন বাকি। কিন্তু ছাপার জন্য প্রেস ঠিক হয়নি। যে প্রেসে ডামি ছাপা হতো সে প্রেসে কথায় বনাবনি হচ্ছে না। ডিএমডি সাইফুল সাহেব দায়িত্ব নেন। প্রেস আনার জন্য বলছি। তার দায়িত্বও তিনি নেন। দেখছি শুধু বৈঠকের পর বৈঠক হচ্ছে। কোন কিছু ঠিক হচ্ছে না। কিছু ঠিক না করেই সাইফুল সাহেব জানান, তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই বিদেশে যাবেন। আমার মাথায় বাড়ি। বোকা বনে গেলাম। এই বুঝি আমার উদ্যোগ ব্যর্থ হতে চলেছে। কোন চক্রান্ত নয় তো? আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক তারিখ মতো পত্রিকা বের করতেই হবে। এর আগে আমরা একবার ইত্তেফাকের প্রেসে ছাপার জন্য কথা বলেছিলাম। কিন্তু এই প্রেস দূরে হয়ে যাওয়ায় আমরা পিছিয়ে আসি। ইত্তেফাকের মালিক আনোয়ার হসেন মঞ্জুর সঙ্গে আলোচনাও করেছিলাম। তিনি রাজি হন। তার লোক পাঠিয়ে কোটেশনও দেন। সাইফুল সাহেব প্রেস ঠিক না করে চলে যাওয়ায় আমি চিন্তা করলাম, যতদূরই হোক ইত্তেফাকেই ছাপাব। সেদিন আবার মঞ্জু সাহেবের সাথে কথা বলামাত্র সম্মতি পাওয়া গেল। প্রেসের চিন্তা আপাতত দূর হলো।গুলশান মানবকণ্ঠ অফিস আর যাত্রাবাড়ীর কাজলার পাড় ইত্তেফাকের প্রেসের মধ্যে প্রিন্টিং কমিউনিকেশন ঠিকঠাক করা হলো। পত্রিকা প্রকাশের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। পরদিন বাজারজাত শুরু। সকাল থেকে ব্যস্ততা। আগে আগে সব কাজ শেষ করতে হবে। ছোট সাপ্লিমেন্টও আছে। তাই প্রথম দিন ২০ পৃষ্ঠা। মূলকাগজ ১২ পৃষ্ঠা। রাত আটটার দিকেই আমরা পত্রিকার প্রথম সংস্করণের সব কিছু পাঠিয়ে দেই। আগেই বলেছি ইত্তেফাকে প্রেস অনেক দূর। ছাপা হয়ে আসতে আসতে ১১টা বেজে যায়। ঢাকার বাইরে প্রায় সব স্থানে সময়মতো পত্রিকা চলে যায়। আমি সাইফুল সাহেব ও অন্যরা অফিসে আমার রুমে বসে খবরা খবর নিচ্ছিলাম। অফিসে বসেই রাত ১২টায় চ্যানেল আই-এর সংবাদপত্র অনুষ্ঠান দেখছিলাম। এদিন অতিথি ছিলেন সমকাল সম্পাদক আমার শ্রদ্ধেয় গোলাম সারওয়ার। তিনি পত্রিকা দেখে প্রশংসা করলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার সফলতাও কামনা করেন। বসে টিভি’র এ অনুষ্ঠান দেখার সময়ই খবর এলো ইত্তেফাক প্রেসে মানবকণ্ঠ ছাপা বন্ধ। নির্ধারিত মেশিনটি কাজ করছে না। একথা শোনার পরপরই আমি সাইফুল সাহেব তার কয়েক সঙ্গী ও মানবকণ্ঠের উপদেষ্টা হারুন সাহেব রওনা দেই প্রেসের দিকে। প্রায় ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে দেখি আসলেই ছাপা হচ্ছে না। মেশিনের মেরামত কাজ চলছে। কিন্তু সময় কম। অন্য মেশিনে ইত্তেফাক ছাপা হচ্ছে। আমি যোগাযোগ করলাম মঞ্জু সাহেবের সঙ্গে। ফোন ধরেই তিনি বললেন, ফার্স্টক্লাস! দেখছো ঝকঝকে সুন্দর ছাপা। পত্রিকা ভাল হয়েছে। আমি বললাম ধন্যবাদ। কিন্তু এখন তো পত্রিকা ছাপা হচ্ছে না। শহরের পত্রিকা তো দেয়া যাবে না, যদি এখান থেকে ছাপা না হয়। তিনি জানতে চাইলেন কেন? বলার পর তিনি প্রেস ম্যানেজারকে ফোন করলেন। নিজের ভাগ্নে ইত্তেফাকের পরিচালক মহিবুল হাসান শাওন সাহেবকে প্রেসে পাঠালেন। আমি যেহেতু আগে ইত্তেফাকে কাজ করেছি প্রেসের সিনিয়র স্টাফরা আমার চেনাজানা। ততক্ষণে রাত ২টা। মেশিন ঠিক হচ্ছে না। আসল সমস্যা ছিল মেশিন অনেক দিন সচল ছিল না। মানবকণ্ঠ ছাপা হবে বলে তাড়াতাড়ি ঠিক করা হয়। ঢাকা শহর ও আশপাশের পত্রিকা এখনই ছাপা শুরু না হলে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। শাওন সাহেবকে বলা হলো। কিন্তু মেশিন ঠিক না হলে তার কী করার আছে? আমরা অনুরোধ করলাম, যে মেশিনে ইত্তেফাক ছাপা হয় তা দিয়ে আমাদের কাগজ ছাপাতে। আমাদের কাগজ আজ নতুন বেরুচ্ছে তাই সব জায়গায় দিতে না পারলে প্রথম দিনেই বদনাম। এজেন্ট-হকারদের বিশ্বাস হারাব। আর ইত্তেফাক একদিন দেরিতে গেলেও সমস্যা হবে না। কিন্তু ইত্তেফাকের স্টাফরা তা মানছেন না। আমি আবার মঞ্জু সাহেবকে ফোন করে ঘটনা জানালাম। তিনি বললেন, আমি ব্যবস্থা করছি। কিন্তু এর আগেই ঘটে গেল এক কেলেঙ্কারি। সাইফুল সাহেবের এক সঙ্গী প্রেসের এক স্টাফের সাথে দুর্ব্যবহার করেন। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় প্রেসের সকল কর্মচারী। উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন বলতে থাকেন ‘ওই দরজা-জানালা বন্ধ কর। আগে বিচার পরে ছাপা।’ আমি দেখলাম পরিস্থিতি খারাপ। সামনে এসে দেখি সাইফুল সাহেব ও তার সঙ্গীরা নেই। বের হয়ে এসেছেন। আমিও বের হয়ে আসি। পরে খবর পাই তিনি ও তার সঙ্গীরা দৌড়ে যাত্রাবাড়ি মোড়ে চলে গেছেন। আমি গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাদের আবার প্রেসের সামনে নিয়ে আসি। ঘটনা শুনে মঞ্জু সাহেবও ক্ষিপ্ত হন। তবুও তিনি প্রেসে বলে দেন যেভাবেই হোক আমাদের কাগজ যেন সময়মত ছাপার ব্যবস্থা করেন।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here