‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ১৮)

0
92

শাহজাহান সরদার :
আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

(পর্ব- ১৮)

এই প্রেক্ষিতে পদত্যাগের প্রস্তুতি নিতে থাকি। আবার উপদেষ্টা হারুন সাহেবকে বলি আপনি ঠিক ঠাক এমডি, ডিএমডিকে জানিয়েছেন তো। তিনি বললেন, তাদের সবার সাথে কথা হয়েছে। পরদিন বিকালে আমি মেইলে পদত্যাগপত্র পাঠালাম আশিয়ান গ্র“পের হেড অফিসে। আমার সাথে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন ডিএমডি সাইফুল ইসলাম। তিনি মিডিয়ার এমডি। তার বরাবরই পদত্যাগপত্র। কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো অফিস জানাজানি হয়ে গেল। এমডি নজরুল সাহেব ফোন করলেন আপনি কেন পদত্যাগ করছেন? আমাকে জানালেন না কেন? আমি বললাম, উপদেষ্টা হারুন সাহেবকে বলেছি। তিনি বলেছেন আপনাদের সবাইকে বলেছেন। নজরুল সাহেব বললেন, আমাকে তো কিছু জানানো হয়নি। তার কথা শুনে আমি অবাকই হলাম। তাহলে হারুন সাহেব জানাননি? নজরুল সাহেব বললেন, আপনি অফিসে থাকেন। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি। আমি বললাম, আমার অন্য একটা কাজ আছে। পরে আপনার সাথে কথা বলব। তিনি বললেন, শাহজাহান ভাই, আমার সাথে কথা না বলে আপনি যাবেন না। আমি তার কথা শুনিনি। কেননা তিনি এবং তার ভাই আমাকে বারবার কথা দিয়ে কথা রাখেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। এভাবে আমার চলে আসা ঠিক হয়েছে কিনা এই প্রশ্ন আমার মনেও। কিন্তু সে-সময় যে পরিস্থিতি ছিল, এ ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না। ২০১৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মানবকণ্ঠ থেকে পদত্যাগ করি।

দু’দিন পর রফিক সাহেব বিদেশ থেকে এলেন। এর মধ্যে আমি একদিন আলোকিত বাংলাদেশ অফিসে গিয়েছিলাম। কয়েকজনের সাথে মাত্র কথা হয়। রফিক সাহেব আসার পর চুক্তিনামা তৈরি হলো। রফিক সাহেব স্বাক্ষর করেছেন। আমাকে স্বাক্ষর করতে হবে। চুক্তিপত্রের কতিপয় শর্ত এবং বেতন-ভাতার অংক দেখে আমার মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম। বেতন-ভাতা যা স্থির করা হয়েছিল তার চাইতে কম ধরা হয়েছে। আর এমন শর্ত যে নাকে খত দিয়ে চাকরি করার মত অবস্থা। আমি ক্ষিপ্ত হয়ে এটি গ্রহণ করলাম না। সোজা বাসায় চলে আসি। কাউকে কিছু বলছি না। মনটা ভীষণ খারাপ। বারবার প্রতারণার জালে আটকা পড়েছি। নিজেই নিজেকে ধিক্কার দেই। দিন দিন মানুষের অবস্থা কোথায় ভাল হয় আর আমার খারাপ হচ্ছে। ভাবছি যাহোক যোগদান করব না। অন্য চাকরি খুঁজব। রাতে আবার রফিক সাহেব ফোন করলেন। বললেন, শর্তগুলো তো আপনার জন্য প্রযোজ্য নয়। আগে একজনের জন্য করা হয়েছিল। এটা প্রশাসন বিভাগ সাথে দিয়ে দিয়েছে। আপনি যোগদান করেন। বেতন-ভাতা আমি কয়েক দিনের মধ্যে ঠিক করে দিব। আমি বললাম, আগে ঠিক করেন। পরে যোগ দিব। তিনি বললেন, এজন্য আমাদের বোর্ডের অনুমোদন লাগবে। বোর্ড সভা কয়েকদিন পর হবে। আমি বললাম, আগে অনুমোদন নিলেন না কেন? তিনি বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। এবারও তার কথা বিশ্বাস করলাম। জুড়ে দেয়া শর্ত বাদ গেল কিন্তু বেতন-ভাতা আগের মতই রইলো। ঠিক করা হবে আশ্বাসে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর যোগ দিলাম।
এরপরের ইতিহাস আরও তিক্ত। পদে পদে ভোগান্তি আর কথার খেলাপ। অসত্যের ছড়াছড়ি। বেতনভাতা আর বাড়লোই না। কাজ করতে গিয়েও পদে পদে বাধা। আলোকিত বাংলাদেশে যোগদান করে দু’দিনের মধ্যে পবিত্র হজ পালন করতে যাই। হজ পালনের সময় প্রায় প্রতিদিনই অফিসে খবরা খবর নিতাম। অফিস থেকেও আমাকে ফোন করতো। তখন রাজনীতির টাল মাটাল অবস্থা। পবিত্র মক্কা, মদিনায় বসে কতরকম যে গুজব শুনি। পবিত্র হজ পালন শেষে জেদ্দা থেকে কাতার হয়ে ঢাকায় পৌঁছি ভোরে। যেদিন দেশে ফিরি সেদিনও হরতাল ছিল। আহসানিয়া মিশনের একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে আমি, আমার স্ত্রী ও ছোট ছেলে বাসায় ফিরি। আমার ব্যক্তিগত ড্রাইভার ব্যাগ নিয়ে আসে। বাসায় ফিরে বিশ্রাম নিয়ে সেদিন বিকালেই অফিসে আসি। যোগদানের পর পরই হজে যাওয়ার কারণে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়নি। সেদিনও সবার সাথে দেখা হলো না। পরদিন আমি সকাল ৯টায় অফিসে পৌঁছে দেখি মানুষজনশূন্য। নিজ কক্ষে অবস্থানের ঘণ্টা দেড়েক পর অর্থাৎ সাড়ে ১০টার দিকে কিছু লোক এলো। শুনলাম প্রশাসন বিভাগের প্রধান আসেন দুপুরে। তাই এ বিভাগের অন্যরাও দেরি করে আসেন। বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন বিভাগের লোকজন ১০টায় আসেন। কিন্তু সেদিন কাউকে এ-সময়েও দেখলাম না। কম্পিউটার বিভাগের লোকজন সময়মতোই এসেছেন। আমার ভীষণ খটকা লাগল। সময়মতো প্রশাসন, বিজ্ঞাপন আর সার্কুলেশন বিভাগের লোকজন না এলে কাজ হবে কীভাবে? বিশেষ করে বিজ্ঞাপন বিভাগের লোকজনকে তো আসতেই হবে। সব পত্রিকায় অফিস সময় ৯টা থেকে আর এখানে সাড়ে ১০টায়ও আসছে না। বুঝলাম না। প্রশাসন বলে কিছু নেই। সাড়ে ১২টার দিকে এলেন প্রশাসন বিভাগের প্রধান। তার কাছ থেকে জানতে চাইলাম বিভিন্ন বিভাগের অফিসের সময়সূচি। তিনি জানালেন। আমি বললাম, কাল সব বিভাগীয় প্রধানদের একটি সভা ডাকুন। আমি সবার সাথে ভালভাবে পরিচিত হতে চাই। যেদিন যোগদান করেছিলাম সেদিন সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য বড় জমায়েত ছিল। তাই আমি চাইলাম বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে বসলে সব শুনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। সময়মতো পরদিন সভা। সবাই এলেন তাদের কথা শুনলাম। আমি বললাম সংবাদ বিভাগ ছাড়া অফিস শুরু হবে সকাল ৯টায়। বিজ্ঞাপন বিভাগের লোকজনকে আধাঘণ্টা মূল্যায়ন বৈঠক করে সাড়ে ৯টার মধ্যে নিজ নিজ কাজে যেতে হবে। অন্যান্য বিভাগকেও নির্দেশনা দিলাম। আমার নির্দেশনায় অনেকেই খুশি হতে পারলেন না। কেননা এতদিন ইচ্ছামতো চলেছেন। এখন নিয়মের মধ্যে আসতে হবে। কিছু কিছু কর্মকর্তা ছিলেন যারা ইচ্ছামতো আসতেন। তবে সন্ধ্যার দিকে সবাই এসে হাজির হতেন। সন্ধ্যার পর অফিসে আসতেন পত্রিকাটির মালিক। কেউ কেউ সারাদিন না এসেও সন্ধ্যায় এসে হাজিরা দিয়ে দিব্যি ছিলেন। বৈঠকের দিন রাতেই আমি মালিক কর্তৃপক্ষকে অফিস সময়ের বিষয়টি জানাই। তিনি বললেন, ভাল হয়েছে। আপনি সব দেখেন। এরপর আমি নিয়মিত ৯টার মধ্যে অফিসে আসছি। বেশিরভাগ কর্মকর্তা, কর্মচারীও আসছেন। তবে কেউ কেউ দেরি করেন। একথা ওকথা বলেন। মালিকের কথা বলেন। আমি বললাম এসব চলবে না। এ বিষয়ে মালিককে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমতা আমতা করলেন। আমি বললাম, আপনি ঠিক করেননি। অফিসের নিয়ম-শৃংখলা না থাকলে ভালভাবে চলতে পারে না। একবেলা প্রশাসনিক কাজ আরেক বেলা নিউজ এভাবেই চলতে থাকে আমার। সাংবাদিক কর্মচারীদের মধ্যে বেশ ভাল ক’জন রিপোর্টার ছিলেন। বার্তা বিভাগে উচ্চপর্যায়ে ছিলেন একজন ফাঁকিবাজ। বাকিদের অধিকাংশই ভালই ছিলেন। পত্রিকার নিউজ গেটআপে পরিবর্তন এলো। চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। বাজারে সুনামও হচ্ছে। পক্ষকাল পর আমি মালিকের কাছে জানতে চাইলাম বিজ্ঞাপনী আয়, পত্রিকা বিক্রি আয়, নিউজপ্রিন্ট ব্যয় অন্যান্য আয়-ব্যায়ের হিসাব আপডেট আছে কিনা। তিনি এসব চেক করেন কিনা। জানালেন আমি তা দেখি না। আমি বললাম, আমি এসব দেখতে পারি কিনা। আপনিতো আমাকে বলেছেন সব দেখতে। তিনি বললেন, আপনি অবশ্যই সব দেখবেন। তিনি সবাইকে ডেকে বলে দিলেন। আমি প্রথম হিসাব বিভাগের প্রধানের সঙ্গে বসলাম। কিন্তু তার কাছে পুরো হিসাব নেই। সার্কুলেশনের আয়ের টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে তাকে শুধু একটি রশিদ ধরিয়ে দেয়া হয়। কত পত্রিকা ছাপা হয়, কত বিক্রি, কত ফেরত, কে টাকা দিল, কার কাছে কত বাকি কিছু হিসাব-নিকাশ নেই। আমি সম্পাদক, প্রকাশককে জিজ্ঞেস করলাম আপনি এসব খবর নেন না কেন? তিনি বললেন, আমাকে দেয়া হয় না। কাকে দেয় জানতে চাইলে বলেন, তারা নিজেরাই হিসেব রাখেন। বিজ্ঞাপন বিভাগের প্রধানের সাথে বসে দেখি সেখানে একই অবস্থা। কোনদিন কোথা থেকে কোন বিজ্ঞাপন এলো, অর্ডার আছে কিনা, বিল এলে কোনো বিজ্ঞাপনের বিল-ভাউচার এসব হিসাব বিভাগে ঠিকমতো জমা দেয়া হয় না। তারা নিজেরা রাখে। দু’বিভাগের প্রধানই একই কথা জানান। দেখলাম এ এক মহাসমস্যা। কোনো অফিসে আমি এমন দেখিনি।এরপর থেকে যেখানে হাত দেই কিছু না কিছু সমস্যা। নিয়মনীতির মধ্যে হিসাব-নিকাশ হচ্ছে না। হিসাব বিভাগে সমন্বিত কোনো হিসাব নেই। কোন বিভাগ থেকেই হিসাব বিভাগে সম্পূর্ণ হিসাব বা কাগজপত্র দেয়া হয় না। আমাকে জানানো হয়, যেখান থেকে যা পাওয়া যায় তা শুধু ব্যাংকে জমা দেয়া হয়। কিন্তু কোন খাতের কত টাকা তার সমন্বিত হিসাব বাবদ কাগজে নেই। কয়েকদিন বৈঠকের পর বৈঠক করে মালিককে জানালাম পুরো পরিস্থিতি। আমি যোগদানের পরই তিনি জানিয়েছিলেন অনেক টাকা ব্যয় হয়ে গেছে। লোকসান দিন দিন বাড়ছে। তাই হিসাবনিকাশের ত্র“টিপূর্ণ অবস্থা আমি তাকে জানাই। আমি বলি, যেকোন ব্যবসায় লাভ-লোকসান আছে। কিন্তু হিসাব নিকাশ তো ঠিক থাকতে হবে। ঢাকার বাইরে পত্রিকার বিল আদৌ ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, টাকা আসবে কিনা আমি থাকা পর্যন্ত এমন পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাইনি। মালিক কর্তৃপক্ষকে বিষয়গুলো জানালে তিনি সার্কুলেশন আর হিসাব বিভাগের লোক ডেকে আনেন। আমার সামনেও কথা বলেছেন। কিন্তু দেখি কিছুতেই তার আদেশ বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যেভাবে ছিল, সেভাবেই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে আমি হিসেবের বিষয় নিয়ে কথা বলা একরকম বন্ধ করে দেই। মালিক কর্তৃপক্ষই লাভ-লোকসানের কথা তুললেই আমি সঠিক হিসাব নিকাশ না হওয়ার কথা তুলি।

আলোকিত বাংলাদেশ বাজারজাতের প্রায় ৯ মাস পর আমি যোগদান করি। এর আগ থেকেই ডামি প্রকাশ হতে থাকে। কিন্তু এতদিনেও পত্রিকাটি মিডিয়া তালিকাভুক্তি হয়নি। আমি যোগদানের পর থেকে শুনে আসছি চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু মিডিয়া হচ্ছে না। দীর্ঘদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে আছে। যোগদানের চার মাস পর্যন্ত একই অবস্থা। মিডিয়া তালিকাভুক্তি না হলে সরকারি বিজ্ঞাপন পাওয়া যায় না। বেসরকারি কোনো কোনো বিজ্ঞাপন পেতেও সমস্যা। আমি মালিক কর্তৃপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলে শুধু বলেন চেষ্টা করছি। একদিন আমি জানতে চাই আর কতদিন চেষ্টা করবেন? এতদিনে মিডিয়াভুক্তি না হওয়ার কারণ কী? আমার চাপাচাপির পর তিনি এই প্রথম আমাকে অনুরোধ করলেন, ভাই আপনি একটু দেখেন। আমি তার অনুরোধ রক্ষা করি। আলোকিত বাংলাদেশের তৎকালীন বিশেষ সংবাদদাতা শাহ নেওয়াজ সাহেব রীতিমতো সচিবালয়ে আসা-যাওয়া করেন। তার সাথে আমলা পর্যায়ে যোগাযোগ ভাল। তাকে বললাম আপনি বিষয়টি আগে জানেন কেন হচ্ছে না। দু’দিন পর তিনি খবর দিলেন সমস্যা আছে। মিশন নিয়ে সমস্যা। আমি বললাম আপনি চেষ্টা করেন। আমিও জট খোলার চেষ্টা করছি। শাহনেওয়াজ সাহেব চেষ্টা করে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পড়ে থাকা ফাইলটি চালু করতে সক্ষম হন। সে-সময় দেখা দেয় আরেক সমস্যা। মন্ত্রী বদল হয়ে যায়। নতুন প্রতিমন্ত্রী হয়ে আসেন বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। দায়িত্ব নেয়ার কয়েকদিন পর মন্ত্রীর কাছে ফাইল যায়। মন্ত্রী বেশ কিছু প্রশ্ন করেন। শাহনেওয়াজ সাহেব তাকে বুঝিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আসেন। এজন্য তাকে অনেক চেষ্টা-তদবির করতে হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল ডিএফপি (চলচ্চিত্র ও প্রকাশক বিভাগ)-তে আসে। এবারের প্রক্রিয়া ডিএফপি সরেজমিনে তদন্ত করে রিপোর্ট দিলে মিডিয়া তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে। একই সঙ্গে পত্রিকার প্রচারসংখ্যার একটি সার্টিফিকেট দেয়া হবে। যা সব সরকারি অফিস আদালত, কর্পোরেশনে যাবে। এ প্রচারসংখ্যার ভিত্তিতেই বিজ্ঞাপন আসে। ডিএফপি’র তৎকালীন মহাপরিচালক যিনি ছিলেন তিনি আমার বিশেষ পরিচিত। আমি নিজে গেলাম তার কাছে। আলোকিত বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা নেতিবাচক। দীর্ঘক্ষণ আলোচনা। তিনি বললেন, আপনি চেষ্টা করলে মিডিয়াভুক্তি হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সম্পর্কে নানা অভিযোগ আছে। আর আপনাকে আমি যেমন জানি তাতে বেশি দিন আপনিও তাদের সঙ্গে থাকতে পারবেন না। বললাম, ভাই যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করি তার জন্য তো কাজ করতে হবে। আপনি পরিদর্শনের জন্য স্টাফ পাঠান। তারা তদন্ত করে রিপোর্ট দিলে নিয়মানুযায়ী আপনি ব্যবস্থা নেন। কারণ মিশনের ভিতরে কার কি রাজনৈতিক আদর্শ আমি তা দেখতে চাইনি। আমি দেখেছি আলোকিত বাংলাদেশ। আমার কর্মস্থল। পত্রিকা তখন ভাল চলছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাংবাদিক কর্মচারীও আছেন। বেতন ভাতা যাহোক নিয়মিত। আমার অনুরোধে খুব স্বল্পসময়ের মধ্যেই ডিএফপি’র টিম এলো। তারা রিপোর্ট দিল। সাতদিনের মধ্যেই মিডিয়াভুক্তি এবং ডিএফপি থেকে প্রচারসংখ্যা সার্টিফিকেট পেয়ে গেলাম। মালিক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন মাধ্যমে দীর্ঘদিন চেষ্টা করেও যা পারেনি মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই তা হয়ে গেল। আর এজন্য কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এতটুকুও ধন্যবাদ পাইনি। বরং শুরু হয় নানা জটিলতা। মিডিয়া তালিকাভুক্তির পরপরই দেখি মালিকের আচরণগত পরিবর্তন। প্রথম দিনই আমাকে বললেন, বড় বড় পদসহ সাংবাদিক কর্মচারী ছাঁটাই করতে হবে। আমি বললাম, ছাঁটাই করা ঠিক হবে না। কাগজটি নতুন। এতে সুনাম ক্ষুণœ হবে। কিন্তু তারা মনে হয় তালিকা করেই রেখেছিলেন। তাদের কথা ব্যয় কমাতে হবে। আমি বললাম হিসাব নিকাশ ঠিক মতো করেন। বকেয়া বিল কী আছে হিসাব নেন। দেখবেন অনেক লোকসান কমে যাবে। কিন্তু এদিকে তারা গেলেন না। কেন নিজ প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিকাশে স্বচ্ছতার পদক্ষেপ নেয়া হলো না তা আজও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। এটি আহসানিয়া মিশনের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। এর জন্য একটি বোর্ড আছে। কয়েকবার বলেও কোন বোর্ড সভায় আমাকে নেয়া হয়নি। আমি চেয়েছিলাম বিষয়গুলো পরিষ্কার করতে। মালিক-সম্পাদক বলেও নিয়ে যাননি। তিনি বোর্ডের চেয়ারম্যান, আবার মিশনেরও প্রেসিডেন্ট।

কর্তৃপক্ষ কয়েকজনের নামের একটি তালিকা দিয়ে আমাকে বললো ছাঁটাইয়ের জন্য। আমি আবার বললাম, ঠিক হবে না। তিনি আমার কথা শুনলেন না। কেন ছাঁটাই? এর পেছনেও ইতিহাস আছে। এখানে বলে রাখি মিডিয়া তালিকাভুক্তির পর সরকারি বিজ্ঞাপন পেতে আরেকটি ধাপ অতিক্রম। সংবাদপত্রের সাংবাদিক কর্মচারীদের জন্য বেতন বোর্ড রোয়েদাদ কোন পত্রিকা বাস্তবায়ন করলেই কেবল সরকার নির্ধারিত হারে বিজ্ঞাপন পায়। এই রোয়েদাদ বাস্তবায়ন হলো কিনা তা দেখার জন্য মালিক সাংবাদিক কর্মচারী ও সরকারি প্রতিনিধি সমন্বয়ে একটি কমিটি আছে। কমিটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে অনুমোদনের পরই সরকারি বিজ্ঞাপনের একটি রেট পাওয়া যায় এবং আমদানি করা যায় বিদেশ থেকে শুল্কমুক্ত নিউজপ্রিন্ট। সে-সময়টি নতুন ওয়েজবোর্ড বাস্তবানের সময় ছিল। তাই মালিক চান সাংবাদিক, কর্মচারীর সংখ্যা হ্রাস করে যারা থাকবেন তাদের কোনোরকমে ওয়েজবোর্ডের অধীনে আনবেন। এতে বেতন-ভাতা বাড়বে না। এটা মালিকের কৌশল। আমি স্পষ্ট জানিয়ে দিলাম এ-ধরনের কোন পদক্ষেপের সঙ্গে আমি থাকব না। নিয়োগপত্র স্বাক্ষর করতেন স্বয়ং চেয়ারম্যান। কাউকে চাকরিচ্যুত করতে হলে তাকেই স্বাক্ষর করতে হবে। আর অন্যায়ভাবে কাউকে চাকরিচ্যুত করা হলে আমিও বিকল্প চিন্তাভাবনা করব। কিন্তু আমার বক্তব্যকে আমলে না নিয়েই ছাঁটাই শুরু হলো। একদিন আমি অফিস থেকে রাত ৯টায় বের হই। একঘণ্টা পর প্রশাসনের এক কর্মকর্তা চিফ রিপোর্টারকে ডেকে নিয়ে বললেন, কাল থেকে আপনি অফিসে আসবেন না। কোন কাগজপত্র নেই। মৌখিকভাবে জানিয়ে দেয়া হলো। খবরটা পেয়ে ফোন করলাম সম্পাদককে। তাকে পেলাম না। প্রশাসনের লোকের সাথে কথা বললাম। তারা জানালো, আমাদের কী করার আছে স্যার। পরদিন বিকালে আহসানিয়া মিশন প্রধান এবং আলোকিতের মালিক-সম্পাদকের কাছে জানতে চাইলাম। তিনি যা বললেন তা খুবই নিম্ন পর্যায়ের কথাবার্তা। আমি বললাম তাকে প্রাপ্য পাওনা দিয়ে বিদায় করেন। তাতেও রাজি হলেন না। বরং আরও কয়েকজনকে ছাঁটাই করার প্রক্রিয়া শুরু করেন। আমি বললাম, ভাই এ অবস্থায় আমার পক্ষে আপনার পত্রিকায় চাকরি করা সম্ভব নয়। দু’দিন পরই আমি নোটিশ দিলাম। ২০১৪ সালের ২০ আগস্ট আমি পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে তার সাথে আর কোনো কথাই বললাম না। এখানে বলে রাখি একদিকে ছাঁটাই শুরু করেছেন, অন্যদিকে বেশ ভাল বেতন-ভাতা দিয়ে বিতর্কিত এক আমলাকে আলোকিত মিডিয়ার এমডি করে আনা হয়। তিনি ছাড়াও কয়েকজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। এ নিয়ে পরে অফিসে ক্ষোভ ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়। এমডিসহ অন্য যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো তারাও কিন্তু বেশিদিন থাকতে পারেননি। একমাস পর আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলো। এর মধ্যে আর কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি। আমি আসার পরই আবার ছাঁটাই শুরু হয়। পত্রিকা ছাপা অনেক কমিয়ে দেয়া হয়। ভাড়া নেয়া অনেক স্পেস ছেড়ে দেয়া হয়। যুগান্তর থেকে আমি চাকরি ছেড়ে আসার সময় কোন চাকরি নিয়ে আসিনি। অনেকটা আলোকিত বাংলাদেশের মতো অবস্থায়ই চাকরি ছাড়ি। তখনও অনেকদিন বেকার ছিলাম। এখান থেকেও বের হই বেকার হয়ে। এই বেকারত্ব চলে দীর্ঘদিন। পৈত্রিক কৃষিজমি ছাড়া আর কোন আয় ছিল না। তাই দীর্ঘদিন পরিবার-পরিজন নিয়ে অভাব-অনটনেই দিনাতিপাত করতে হয়েছে।আমি থাকাকালে যে চিফ রিপোর্টারকে (হোসাইন জাকির) চাকরিচ্যুত করা হয় তিনি খুব ভাল একজন রিপোর্টার ছিলেন। যুগান্তরের দুঃসময়ে আজকের কাগজ থেকে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। আলোকিত বাংলাদেশও অনেকটা তার হাত দিয়ে গড়া। অনেক পরিশ্রম করেছেন। চাকরিচ্যুতির এক মাসের মধ্যে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। হোসাইন জাকিরের চিকিৎসা সহায়তায় অনেকেই এগিয়ে আসেন। কিন্তু এগিয়ে আসেনি আহসানিয়া মিশন ও আলোকিত বাংলাদেশ। পারিবারিক সূত্র ও সহকর্মীরা জানিয়েছেন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে হোসাইন জাকির আকুতি-মিনতি করলেও তার পুরো পাওনা পরিশোধ করা হয়নি। দেশি-বিদেশি বিত্তশালী ও সাধারণ মানুষের অনুদান ও দানের অর্থে গড়ে উঠেছে আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল। এই হাসপাতালেও হোসাইন জাকিরের চিকিৎসা হলো না। অথচ প্রতিষ্ঠান প্রধানের এক নিকটাত্মীয় এই ক্যান্সার হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকালীন অর্থনৈতিক অনিয়ম করেছেন এমন অভিযোগ সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। ঘাতক ক্যান্সারের হাত থেকে হোসেন জাকির রেহাই পাননি। চলে যেতে হয়েছে পরপারে। তিনি অনেক দুঃখ-বেদনা নিয়ে গেছেন। সহকর্মীরা অনুতাপ করলেও জনকল্যাণের জন্য নিবেদিত মিশন! কিন্তু কোনো মায়া-মমতা দেখায়নি। আমি আসার পর অনেক উত্থান-পতন ঘটেছে। যারা হিসাব-নিকাশ দিতেন না তাদের পদোন্নতিও হয়। কিন্তু শেষপর্যন্ত এদের কেউই থাকতে পারেননি। একটি উঠতি পত্রিকা গলাটিপে হত্যা করে যত ছোট করা যায় তত ছোট করে রাখা হয়েছে। এর পিছনেও মিশন প্রধানের কোন মিশন আছে কিনা আমি জানি না। কেননা আমি চাকরিকালে তার কথা ও কাজের মধ্যে অনেক তারতম্য লক্ষ করি। কিছু এরই মধ্যে আমি উল্লেখ করেছি। আমাকে কোন বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে অন্যদের ‘না’ বলার ঘটনাও ঘটেছে। এসব বিষয়ে আমি জানতে চাইলে বলতেন, আমাকে সবার কথা শুনতে হয়। কিন্তু আমার মনে হয়েছে তিনি নিজের স্বার্থে সবাইকে ব্যবহার করেছেন। আসলে কাজ করেছেন নিজের মতো করে। সাংবাদিক কর্মচারীদের স্বার্থ কমই দেখেছেন।

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here