‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ – (পর্ব- ২৪)

0
105

শাহজাহান সরদার

আমার লেখা ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি এই ‘করোনাকালের’ অবসরে ধারাবাহিকভাবে একদিন পর পর পোস্ট করা হবে। আশা করি আপনারা বইটি পড়ে দেশের সংবাদপত্র ও রাজনীতির ভেতরের অনেক খবর জানতে পারবেন।

(বইটি ২০১৮ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়)

টানা তিন দশক রিপোর্টার হিসাবে কাজ করেছি। এ সময় রাজনীতির অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। অনেক ঘটনার নীরব সাক্ষীও আছি। আবার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। রিপোর্ট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছে। অনেক স্মৃতি আছে। দুঃখ-বেদনা-আনন্দ আছে। সেগুলো এক বইয়ে লিখে শেষ করার মতো নয়। রিপোর্টার হিসেবে নেয়া আমার এমন কয়েকটি সাক্ষাৎকার এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করলাম।

সংসদ অধিবেশন ও তত্ত্বাধায়ক সরকারের বিল পাস
১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারির এক দলীয় একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের প্রথম এবং শেষ অধিবেশন শুরু হয় ১৯ মার্চ। এ সময় দেশব্যাপী অসহযোগ চলছে। তার উপর বিরোধীদের সংসদ অবরোধের কর্মসূচি। আমার অ্যাসাইনমেন্ট সংসদে। বাসা থেকে বের হলাম সংসদে যাওয়ার জন্য। রাজপথে হাজার হাজার লোক। মিছিল, বিক্ষোভ, সমাবেশ চলছে। কোনমতে হেঁটে সংসদে গিয়ে হাজির হলাম। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে প্রেসিডেন্ট আব্দুর রহমান বিশ্বাস সংসদে এলেন। সদস্যদের অধিকাংশই আগে থেকেই সংসদে অবস্থান করেছেন। উদ্বোধনী দিনে প্রেসিডেন্ট ভাষণ দিলেন। এদিকে আওয়ামী লীগ ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ার ও ২৭ নম্বর রোড এলাকায় সমাবেশের আয়োজন করে। সংসদ যখন চলছে তখন ধানমন্ডির আওয়ামী লীগের সমাবেশ থেকে বিরাট মিছিল সংসদ ভবনের দিকে এগুতে থাকলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেঁধে যায়। পুলিশ বেপরোয়া গুলি, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। মিছিলকারীরাও পাল্টা বোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। পুরা ধানমন্ডি এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। দোকানপাট ও পেট্রোল পাম্পে অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। এদিকে রাতে শেখ হাসিনার ৫ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনের বেডরুম লক্ষ্য করে লেকের ওপার থেকে কে বা কারা গুলি ছোঁড়ে। ঘটনার পরদিন রাজধানীতে ব্যাপক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়।

২৪ মার্চ ’৯৬ জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসে বিকাল ৪টায়। ইতোমধ্যেই সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পেশ করা হয়। বিএনপি নেতৃবৃন্দ এবং প্রধানমন্ত্রী আগে বার বার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা তথা বিরোধীদের মূল দাবি নাকচ করে দেন। সংবিধানে নেই বলে এ নিয়ে কথাও বলতে চাননি। আর বিরোধীরা বারবার বলেছে সংবিধানে নেই বলেই আমরা দাবি উত্থাপন করছি। সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সংসদে বিল আনতে বলছি। কিন্তু বিএনপি এতে রাজি হয়নি। এমনকি প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শব্দটি মুখেও আনতে চায়নি। সেই বিএনপি নিজেরাই সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল উত্থাপন করলো। এদিনই এ বিল পাস হবে। বাইরের অবস্থা নাজুক। সারাদেশ অগ্নিগর্ভা। তাই আর দেরি নয়। যদিও বিরোধীরা বলছে অবৈধ সংসদে পাস করা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল তারা মেনে নেবে না। তবুও পর্দার অন্তরালে কিছু একটা সমঝোতার আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। বিএনপি সংসদে বিল পাস করে ক্ষমতাত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নতুন নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব দিলে আওয়ামী লীগসহ বিরোধীরা তা মেনে নেবেন। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করে এ ধরনের একটি আপোষ-সমঝোতা করেছে বলে জানা যায়। যে-কারণে বিএনপি’র সেদিনই বিল পাস করা ছাড়া উপায় ছিল না।

মাগরিবের নামাজের পর সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বিলটি তাড়াহুড়ো করে আনায় অনেক ত্র“টি ছিল, তাই একের পর এক সংশোধনী আসে। এমনিতেই সংবিধান সংশোধনী বিল পাসের প্রক্রিয়া খুবই জটিল। ভোটাভুটি হতে হয়, তাও কয়েক দফা ভোট। রাত ১২ টা পর্যন্ত খুঁটিনাটি আলোচনায়ই কেটে যায়। বিল পাস হবে জানি কিন্তু পাস না হওয়া পর্যন্ত রিপোর্টও পাঠানো যাবে না। আর বিলম্বে রিপোর্ট পাঠালে ছাপাও সম্ভব নয়। আমি বার্তা সম্পাদক সারওয়ার সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বললেন, তাড়াতাড়ি তুমি এ পর্যন্ত যা হয়েছে পাঠাও। প্রয়োজনে দ্বিতীয় সংস্করণ বের করবো। এরমধ্যেই পত্রিকার ডামি হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ছাপা শুরু হবে।

সংসদে সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার আমীর খসরু। বর্তমান ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকা প্রতিনিধি। তিনি একজন পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান রিপোর্টার। তাকে প্রেস গ্যালারিতে রেখে আমি তাড়াহুড়া করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল নিয়ে সংসদে আলোচনার তাৎক্ষণিক পর্যায়ে একটি রিপোর্ট ফ্যাক্সে পাঠিয়ে দেই। এ রিপোর্ট দিয়েই প্রথম সংস্করণ ছাপা শুরু হয়। সারওয়ার সাহেব আগেই বলেছিলেন তিনি অফিসে থাকবেন। সঙ্গে থাকবেন হাসান শাহরিয়ার। নির্দেশ ছিলো তাদের যেন আপটুডেট খবর পাঠাই। রাত দু’টায়ও সংশোধনী আলোচনা চলছিলো। আমি তাদের খবর দিলাম বিল পাস হতে ভোর হয়ে যাবে। এ খবর শুনে তারা দু’জনেই কাকরাইলে হোটেলে চলে যান। সংসদে আমি আর খসরু সাহেব প্রেস গ্যালারিতে। আরও সাংবাদিক আছেন। সবাই চিন্তা করছেন কি করবেন। খসরুর সঙ্গে আমিও পরামর্শ করি কী করা যায়। যদি অন্য কাগজে বিল পাসের খবর ছাপা হয় আর ইত্তেফাকে ছাপা না হয় তাহলে বেইজ্জতির শেষ থাকবে না। তবে ইত্তেফাকের মতো সমস্যা অন্য সব কাগজের নেই। ইত্তেফাক ছাপা হয় অনেক বেশি সংখ্যায়। তাই আগে ভাগে কাজ শেষ করতে হয়। অন্য কাগজে ভোররাতে ছাপা শুরু করলেও কোন অসুবিধাও হয় না। আবার অফিসে টেলিফোন করলাম। সারওয়ার সাহেব আর শাহরিয়ার সাহেব হোটেলে চলে গেছেন। শিফট ইনচার্জ আছেন। বলে গেছেন প্রয়োজন হলে যেন হোটেলে যোগাযোগ করি। আমি হোটেলে টেলিফোন করে সারওয়ার সাহেবকে পেলাম রাত ৩টায়। তাকে জানালাম বেশির ভাগ কাগজের সাংবাদিক সংসদে আছেন। অনেকে হয়তো নগর সংস্করণ বের করে হলেও নিউজ দিবে সঙ্গে সঙ্গে। তিনি বললেন, আমি অফিসে যাচ্ছি তোমরা সংসদে থাকো। যে করেই হোক সময়মতো খবর পাঠাতে হবে।

রাত সাড়ে ৩টা। দুপুরে যা খেয়েছি, এরপর চা ছাড়া আর কিছু পেটে পড়েনি। এতক্ষণ টেনশনে খাবারের কথা খেয়াল ছিল না। কিন্তু এখন বেশ ক্ষুধা অনুভব কররাম। খসরু সাহেবকে বললাম কী করা যায়। কেন্টিনের খাবার আগেই শেষ। চাও নেই। তাই ট্যাপের পানি খাওয়াই সার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিলের উপর আলোচনা চলছে তো চলছেই। ভোররাতে কোন দফায় কী আলোচনা হচ্ছে তা বোঝা যাচ্ছিলো না। সদস্যরাও অনেকে ছিলেন বিভ্রান্তির মধ্যে, কোন শব্দের বদল কোন শব্দ বসবে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিলো। অবশেষে আলোচনা শেষ হলে এবার বিভক্তি ভোটের পালা। তখন রাত সোয়া ৪টা। বিভক্তি ভোট জটিল প্রক্রিয়া। সদস্যদের বাইরে যেতে হলো। সেখানে খাতায় স্বাক্ষর করে আবার অধিবেশন কক্ষে ফিরে এলেন। পরে সংসদ কর্মচারীরা খুঁটিনাটি পরীক্ষার পর স্পিকারকে অবহিত করলে স্পিকারের ঘোষণা আসবে। বিভক্তি ভোটের সামগ্রিক প্রক্রিয়া শেষে স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী ভার ৫.২০ মিনিটে ঘোষণা করেন যে, ২৫৮-০ ভোটে সংসদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হয়েছে।

স্পিকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাসের ঘোষণা দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি দৌঁড়ে চলে যাই স্পিকারের পিএস হেমায়েত সাহেবের কক্ষে। সেখান থেকে টেলিফোন করি অফিসে। সারওয়ার সাহেব ধরলেন। বললাম বিল পাস হয়েছে। তাকে সময়টা, পক্ষ-বিপক্ষ ভোটসংখ্যা ও বিলে কী কী আছে সংক্ষেপে বললে তিনি নিজেই লিখে নিলেন। এ খবর দিতে দিতেই শুনি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সমাপনী ভাষণ দিতে উঠেছেন। পিএস-এর কক্ষেই মাইক্রোফোন ছিল, তাই শুনছিলাম। তখনও সারওয়ার সাহেব লাইনে আছেন। আমি জানাই প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছেন। আমি এখান থেকেই মাইক্রোফোনে শুনছি। তিনি তখন বললেন, শুনে শুনে তুমি বল আমি লিখছি। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণদানের সময় সংসদ ভবনে ও বাইরে মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি সংসদকক্ষেও ভেসে আসে। এভাবে সেদিন সংসদ থেকে নিউজ পাঠিয়ে খসরু সাহেবকে নিয়ে অফিসে যাই ভোর ৬টায়। গিয়ে দেখি সারওয়ার সাহেব ও শাহরিয়ার সাহেব নিউজ তৈরি করে ফেলেছেন। সারওয়ার সাহেবের কাছ থেকে পরে শুনেছি তিনি এসে দেখেন কম্পিউটার অপারেটর নেই, আর্টিস্ট নেই। সাইকেলে বাসা থেকে আবার অফিসে আনিয়েছেন। সকাল সোয়া ৬টার মধ্যে প্রেসে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য মেকআপ দিয়ে পৌনে ৭টায় আমরা অফিস থেকে কাগজ নিয়ে হোটেলে ফিরি। এর মধ্যে প্রথম সংস্করণ ছাপা ও বিতরণ প্রায় শেষ হয়েছে। প্রেস অপেক্ষা করছিল। আমরা তখন অন্যসব কাগজ নিয়ে বসি। দেখি অনেক কাগজেই তত্ত্বাধায়ক সরকারের বিল পাসের খবরটি নেই। আমরা তরতাজা খবরটি দিতে পেরেছি। এতেই তৃপ্তি। এটা সম্ভব হয়েছে সংশ্লিষ্ট সবার আন্তরিকতা ও প্রস্তুতির জন্যেই। হোটেলে ফিরে দেখি আমাদের জন্য যে-খাবার রাখা হয়েছিল তা রুমে পড়ে আছে। কিন্তু রাতের খাবার সকাল ৭টায় আর না খেয়ে খসরু সাহেব আর আমি বেবি ট্যাক্সিতে বাসায় ফিরে। সারওয়ার সাহেব চলে যান উত্তরায়। আর শাহরিয়ার সাহেব মালিবাগে। বাসায় ফিরে গোসল করে নাস্তা খেয়ে আবার প্রেসক্লাবে উদ্দেশে যাত্রা।

(সুপ্রিয় পাঠক, সময়ের অভাবে যদি কেউ পূর্বের পোস্টকৃত কোন পর্ব পড়তে না পারেন, তাহলে ফেসবুকের এই আইডি থেকে অথবা বাংলাদেশ জার্নাল অনলাইনের ‘অন্যান্য’ ক্যাটাগরি থেকে ‘রিপোর্টার থেকে সম্পাদক’ বইটি পড়তে পারবেন।)

বইটি সংগ্রহ করতে চাইলে অর্ডার করুন #www.rokomari.com/utso
#www.porua.com.bd
#www.boimela.com

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here