করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে উদ্বেগ

0
298

বাংলা খবর ডেস্ক:
ফ্রান্স, স্পেন, ব্রিটেন, রাশিয়া, চিলি, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা ও পেরুর মতো অনেক দেশেই করোনা সংক্রমণ এক দফা কমে গিয়ে আবার বেড়ে গেছে। বিষয়টিকে দেখা হচ্ছে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ হিসেবে। এ ছাড়া অনেক দেশেই নতুন করে দৈনিক সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। নেপালেও দৈনিক সংক্রমণ এখন বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে সংক্রমণ কখনো কিছুটা কমছে, আবার বেড়ে যাচ্ছে। এ দুটি দেশ বাদে অন্য অনেক দেশেই দ্বিতীয় সংক্রমণ নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করছে। এর সঙ্গে কোনো কোনো দেশে একই ব্যক্তির দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টিও ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে।

দেশের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, এখানেও দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে অনেকে। তবে বাংলাদেশে এখনো সংক্রমণের প্রথম টেউ বিলীন হয়নি, বরং শনাক্তসংখ্যা কমছে ধীরগতিতে। ফলে প্রথম ঢেউ কোথায় গিয়ে, কবে শেষ হবে, সেটা নিয়ে সংশয় কাটছে না। এর মধ্যেই উদ্বেগ শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফ থেকে প্রকাশিত করোনাভাইরাস মহামারির বৈশ্বিক পরিস্থিতির সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, মোট শনাক্ত তালিকায় গতকাল সকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৫ নম্বরে। ১২ দিন আগে ছিল ১৪ নম্বরে। একই সময়ের হিসেবে দৈনিক শনাক্ত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৯ থেকে উঠে গেছে ৩০ নম্বরে। একইভাবে দৈনিক মৃত্যুর তালিকায় ২০তম স্থান থেকে চলে গেছে ২৫ নম্বরে। আর মোট মৃত্যু সূচকে গতকাল বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ২৬ নম্বরে। ১২ দিন আগে ছিল ২৯ নম্বরে।

দেশের রোগতত্ত্ববিদরা অবশ্য এখনো দ্বিতীয় ঢেউয়ের আগে প্রথম ঢেউ কতটা দ্রুত ম্লান করা যায় তার ওপর জোর দিচ্ছেন। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে বৈশ্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন গভীরভাবে। এই পর্যবেক্ষণ অনুসারেই দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আসন্ন শীতকালের বাড়তি ঝুঁকির বিষয়টিকেও মাথা রাখা হচ্ছে। শীতে অ্যাজমা-নিউমোনিয়াসহ শ্বাসতন্ত্রের রোগে আক্রান্তরা গরমকালের তুলনায় বেশি জটিলতায় ভোগে। সে কারণে এবার শীতে তাদের জন্য বাড়তি ঝুঁকি হয়ে আসছে করোনাভাইরাসের বিপদ। ফলে দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দিলে পরিস্থিতি আবার গত জুন-জুলাই মাসের মতো বা তার চেয়ে খারাপ অবস্থায় যেতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দেশে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ব্যাপারে সতর্কতার কথা উল্লেখ করেছেন।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনো প্রথম ঢেউ থেকেই নামতে পারছি না। সংক্রমণ যেমন ধীরে বেড়েছে, তেমনি ধীরে কমেছে। অনেক দিন যেমন দৈনিক শনাক্ত হার ২০ শতাংশ বা এর কাছাকাছি আটকে ছিল, গত কয়েক দিন ধরে সেটা ১১-১২ শতাংশে এসে অনেক ধীরে চলতে শুরু করেছে। দ্রুত নিচে নামছে না। এটা দ্রুত নেমে গেলে ভালো হতো।’

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘যদি দৈনিক পরীক্ষার তুলনায় শনাক্ত হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ অবস্থান করে তবেই আমরা সেটাকে প্রথম ঢেউ শেষ হওয়া বলতে পারব। তবে এখন যে অবস্থায় আছে সেটা যদি আবার ঘুরে গিয়ে বেশি মাত্রায় ঊর্ধ্বমুখী হয়, তবে তা দ্বিতীয় ঢেউ বলেই বিবেচিত হবে। আমরা কিন্তু সেই আশঙ্কা উড়িয়ে দিতে পারছি না। এ ছাড়া অনেকে দ্বিতীয়বারেও আক্রান্ত হচ্ছে।’

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ড. তাহমিনা শিরীন বলেন, ‘অনেকটাই ভালো অবস্থানে আমরা এসেছি। কিন্তু ধীরগতি এক ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে আছে। দ্বিতীয় ঢেউ নিয়েও শঙ্কা আছে। যেসব দেশে দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে আমরা সেসব দেশের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। সেদিকে নজর রেখে পরিকল্পনার কাজ চলছে। তবে এ ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে পরীক্ষা কম হওয়া। পরীক্ষা যদি পর্যাপ্ত করা যেত তবে হয়তো আরো ভালো একটা চিত্র পেতাম। কিন্তু মানুষ তো এখন পরীক্ষা করাতে আসছে না। যারা পরীক্ষা করাচ্ছে তাদের একটি অংশ বিদেশগামী বা নেগেটিভ কি না সেটা দেখার জন্য পরীক্ষা করাচ্ছে।’

ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হওয়া দেশগুলোতে প্রথম ঢেউ কমে যাওয়ার পর অসতর্ক চলাফেরা ও স্বাস্থ্যবিধি না মানাকেই বড় কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেহেতু বাংলাদেশেও অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছে না, ফলে সংক্রমণ আবারও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না।

জাতীয় বক্ষ্মব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহেদুর রহমান খান বলেন, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫ শতাংশ অ্যাজমা ও ৬ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ বা সিওপিডিতে আক্রান্ত। শীতের সময় সাধারণত তাদের এসংক্রান্ত জটিলতা তুলনামূলক বেড়ে যায়। তাপমাত্রার সঙ্গে সরাসরি করোনা সংক্রমণের হ্রাস-বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো প্রমাণিত না হলেও শীতের সময় অ্যাজমা, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্র ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্তদের জন্য করোনার ঝুঁকি অনেক বেশি। কারণ এই সময় এসব রোগীর অবস্থা নাজুক থাকে।

ইউরোপে দ্রুতগতিতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ:

ওদিকে ইউরোপে আবার দ্রুতগতিতে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। এর প্রেক্ষিতে স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের অংশবিশেষে আরোপ করা হচ্ছে লকডাউ। ফলে সোমবার থেকে মাদ্রিদের ৮ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারবেন না। ভ্রমণের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে। একসঙ্গে বেশি মানুষ একত্রিত হতে পারবেন না। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। এতে বলা হয়েছে, ইউরোপে সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমণ হয়েছে স্পেনে। আবারও মাদ্রিদ সবচেয়ে আক্রান্ত এলাকায় পরিণত হয়েছে।

উত্তর গোলার্ধের এসব দেশের বেশির ভাগই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মোকাবিলা করছে। অন্যদিকে সেখানে আস্তে আস্তে শীতকাল এগিয়ে আসছে। ফলে সংক্রমণ আরো মারাত্মক রূপ নিতে পারে। এ অবস্থায় মানুষজন ঘরের বাইরে চলাচল করলে তাতে আরো কঠিন অবস্থা হতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এর ইমার্জেন্সি স্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মসূচির প্রধান ড. মাইক রায়ান বলেছেন, সংক্রমণ বিস্তার রোধে আরো অনেক কাজ করতে হবে। এই মহামারিকে দমিয়ে রাখতে হবে। স্কুল খুলে দেয়ার বিষয়ে নিরাপত্তা আনতে হবে। সমাজের সবচেয়ে বিপন্ন মানুষগুলোকে সুরক্ষা দিতে হবে।

করোনা মহামারি শুরুর পর প্রতিদিনের হিসেবে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন ফ্রান্সে। সেখানে প্রতি ২৪ ঘন্টায় আক্রান্তের সংখ্যা ৩০০০ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২১৫। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লা মেইর। তার কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি। তবে পরীক্ষায় তার করোনা ধরা পদে। এ অবস্থায় মার্সেইলি, নাইস সহ বেশ কিছু শহরে কঠোর বিধিনিষেধ দেয়া হচ্ছে।

ওদিকে বৃটেনে শুক্রবার নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৩২২ জন। মারা গেছেন ২৭। ৮ই মে’র পরে এটা সর্বোচ্চ সংখ্যা। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন দ্বিতীয় করোনা সংক্রমণ অনিবার্য বলে সতর্কতা দিয়েছেন। ইংল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ অংশ এখন বড় রকমের লকডাউনের মধ্যে রয়েছে।

আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে ইনডোর রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। অপ্রয়োজনে সকল প্রকার ভ্রমণ নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ডেনমার্কে ১০০ মানুষের জমায়েত অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তা কমিয়ে এখন ৫০ করা হচ্ছে। বার ও রেস্তোরাঁ’কে আগেভাগে বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। আইসল্যান্ডের রাজধানী রিকজাভিকে সপ্তাহান্তে বিনোদনকেন্দ্র ও পাব-গুলো বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here