জীবনের অগণিত চাঁদ এবং বিভ্রান্তিগুলি

0
555

শামীম শাহেদ
বিবাহ প্রসঙ্গে আমার গুরু হুমায়ুন আহমেদ সম্ভবত সবচেয়ে কাজের কথাটা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বিবাহ লজ্জার ব্যাপার, কিন্তু দরকার আছে।
আমারও তাই মনেহয়, বিবাহ দরকার আছে, কিন্তু একটু বুঝে-শুনে। তবে আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জার অনুভতিটা যে বিবাহের সময়-ই হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। অন্য কিছু না, বিয়ের দিনের ঘটনা বলছি। পুরো মিলনায়তন ভরা পরিচিত মুখ, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে, মোনাজাত শেষ, একজন বললেন, বাবা দাঁড়িয়ে সালাম দাও। আমি দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। এমন লজ্জা পেলাম বলে বোঝাতে পারব না। সেদিন কেন এত লজ্জা পেয়েছিলাম এখনো বুঝতে পারি না। সেই থেকে বিভ্রান্তির শুরু!
এখন থেকে ঠিক ষোল বছর আগের ঘটনা। ৭ জানুয়ারি, ২০০৫। আমার সকল যন্ত্রণার শক-অ্যাবজর্ভার হয়ে আমার জীবনে এলো এক কিশোরী। নাম মুন। শাহরিন ইকরাম জাহান মুন। তার আগে অবশ্য আইডিয়াল এর চাইতে ভিকারুননিসা-র মেয়েদেরই আমার বেশি ভাল লাগত।
বিয়ের পরপরই মুন বলল, শোনো তোমার সব পুরোনো প্রেম নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নাই। কিন্তু এখন থেকে নতুন প্রেম শুধু একটাই-আমি।
আমি মনে মনে ভাবলাম, বলে কী এই মেয়। আমি বিভ্রান্ত!

আবার একদিন বলল, শোনো, সব সময় এত দূরে দূরে দাঁড়াও কেন? কাছে আসা। হাত ধর। সব সময় এভাবে হাত ধরে কাছাকাছি দাঁড়াবে। আমি বিভ্রান্ত।
একদিন বলল, কি আশ্চর্য সব সময় রুমের দরজা বন্ধ করে রাখো কেন? দরজা খোলো। আমি খুলে দিলাম। মুন বলল, সব সময় ঘরের দরজা বন্ধ রাখতে হয় না। মাঝে মাঝে খুলেও রাখতে হয়। ঠিক আছে? আমি বললাম, ঠিক আছে। আবার বিভ্রান্ত!
হঠাৎ একদিন প্রশ্ন করল, আইডিয়াল নাকি ভিকারুননিসা? আমি না বুঝেই বললা, আইডিয়াল। ভিতরে ভিতরে বিভ্রান্ত!
এই বিভ্রান্তি যে শুধু হাটাচলাতে, তা না। খাওয়া দাওয়াতেও বিভ্রান্তি।
তখন আমি প্রথম আলোর সিনিয়র সাব-এডিটর। রাত দেড়টা-দুইটায় বাসায় ফিরে দেখতাম, রান্না করে টেবিল ভার্তি খাবার নিয়ে বসে আছে। মুখে দেওয়া মাত্রই প্রশ্ন করত, মজা হয়েছে না? আমি হাসি হাসি মুখে উত্তর দিতাম, হ্যাঁ মজা হয়েছে। আর মনেমনে ভাবতাম, বাকি জীবন খাব কীভাবে? আবার বিভ্রান্ত।
সেই হাসি-খুশি ভদ্র মহিলা এখন এত চমৎকার রান্না করেন, এত চমৎকার করে বাকি সব সামলান যে মাঝে মাঝে ভাবি, আমরা পুরুষরা অকারনেই বাহাদুরী করি। ঠিক জায়গামতো প্রতিযোগিতায় পড়লে পালানোর পথ থাকবে না। একটা বিভ্রান্তি দূর হল-আইডিয়াল, ভিকারুননিসা, হলিক্রস, শহীদ আনোয়র গার্লস সবাই সেরা।
শাহরিন ইকরাম জাহান মুন চমৎকার একজন মানুষ। সব পরিস্থিতিতেই হাসিহাসি মুখ। কাল যদি তাঁকে অ্যামাজন এর জঙ্গলে নিয়েও ফেলা হয়, তিনি হাসিহাসি মুখে বললবেন, বাহ বেশ সুন্দর জায়গাতো, আমার পছন্দ হয়েছে। তারপরই দেখা যাবে তিন বাচ্চাকে নিয়ে কাউন্সিলিং করতে বসে গেছেন। আমাদের জীবনে অ্যামাজনের জঙ্গলে বসবাস করাটা কেন জরুরি, ঠিক কতটুকু জায়গা নিয়ে ঘরটা হওয়া দরকার, কার কী দায়িত্ব- সব বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে বলবেন, সব ঠিকঠাক, এখন চলো কফি খেয়ে আসি!
আজ সেই মানুষটির আমার জীবনে পদার্পণের দিন। ষোল বছর পূর্ণ করে সতের বছরে যাত্রা। নোরা, জারা, অরোরা-আমার আশেপাশে এখন অনেকগুলি চাঁদ।
এখন মাঝেমঝেই তারাশঙ্করের ‘কবি’র একটা লাইন মনে পড়ে-
ভালোবেসে মিটল না আশ,
কুলাল না এ জীবনে
জীবন এত ছোট কেনে?
(মুন, যন্ত্রণা কি বেশি দিয়ে ফেললাম? কি করব বলো। আমি তো এমনই!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here