কুষ্টিয়ায় আনুশকাহর দাফন সম্পন্ন, দোষীদের বিচার দাবিতে বিক্ষোভ

0
124

বাংলা খবর ডেস্ক:
রাজধানীর কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মাস্টার মাইন্ডের ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী আনুশকাহ নূর আমিনকে (১৮) সমাহিত করা হয়েছে।

গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়া সদরের গোপালপুরে শনিবার সকাল ৭টায় জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।

এর আগে শুক্রবার দিনগত রাত ১টার দিকে আনুশকাহর মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

এদিকে দাফন শেষে ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছে গ্রামবাসী।

মেধাবী এই শিক্ষার্থীকে হত্যার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত ফারদিন ইফতেখার দিহানের কঠোর শাস্তি দাবি করে মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে আরও কারো সংশ্লিষ্টতা থেকে থাকলে তদন্তপূর্বক তাদেরকেও আইনের আওতায় আনতে হবে।

মামলা সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সকাল আনুমানিক সাড়ে ৮টার দিকে আনুশকাহ নূর আমিনের মা কর্মস্থলের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে যান। এক ঘণ্টা পরে তার বাবাও ব্যবসায়িক কাজে বাসা থেকে বের হন।

দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ওই ছাত্রী তার মাকে ফোন করে কোচিং থেকে পড়ালেখার পেপার্স আনার কথা বলে বাসা থেকে বের হন। এ মামলার একমাত্র আসামি ‘ও’ লেভেল পড়ুয়া দিহান বেলা ১টা ১৮ মিনিটে ফোন করে ওই শিক্ষার্থীর মাকে জানান, মেয়েটি তার বাসায় গিয়েছিলেন। হঠাৎ অচেতন হয়ে পড়ায় তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়েছে।

অফিস থেকে বের হয়ে আনুমানিক দুপুর ১টা ৫২ মিনিটে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাসপাতালে পৌঁছেন। হাসপাতালের কর্মচারীদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, আসামি তার মেয়েকে কলাবাগান ডলফিন গলির বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করেন। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে অচেতন হয়ে পড়লে বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য আসামি নিজেই তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে নিয়ে যান।

খবর পেয়ে কলাবাগান থানা পুলিশের একটি দল হাসপাতালে গিয়ে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে এবং ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায় বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

বৃহস্পতিবারই হাসপাতাল থেকে দিহানকে গ্রেপ্তার করে কলাবাগান থানা পুলিশ। শুক্রবার মামলায় ‘দোষ স্বীকার’ করে তিনি ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

শুক্রবার বিকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে মেয়েটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান সোহেল মাহমুদ জানিয়েছেন, স্কুলছাত্রীর শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া না গেলেও যৌনাঙ্গ ও পায়ুপথে ক্ষত চিহ্ন পাওয়া গেছে। বিকৃত যৌনাচারের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ায় তার মৃত্যু হয়েছে।


ফারদিন ইফতেখার দিহানকে আদালতে নেয়া হচ্ছে। ছবি : ফোকাস বাংলা

ওদিকে রাজধানীর কলাবাগানে ‘ও’ লেভেলের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের দায় স্বীকার করেছেন ফারদিন ইফতেখার দিহান (২০)। শুক্রবার দুপুরে কলাবাগান থানা পুলিশ দিহানকে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদের আদালতে হাজির করে। আদালতে দিহানকে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য ১ ঘণ্টার বেশি সময় দেয়। পরে দিহান আদালতে ধর্ষণের কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেয়।

ধর্ষণের সঙ্গে দিহান একাই জড়িত। বাসায় একা থাকতে পেরে দিহান ওই শিক্ষার্থীকে ফোন করে ডেকে নেয়। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী কলাবাগানের লেক সার্কাসের ৬৩/৪, পান্থনিবাস-২ অ্যাপার্টমেন্টের দোতালার ডি-২ ফ্ল্যাটে আসে। ফ্ল্যাটের মালিক দিহানের বাবা আব্দুর রউফ সরকার। তিনি ২০১২ সালে জেলা রেজিস্ট্রার পদ থেকে অবসরে যান। করোনার মধ্যে আব্দুর রউফ সরকার রাজশাহীর দুর্গাপুরে তার বড় ছেলের বাড়িতে চলে যান। দুর্গাপুরে আব্দুর রউফের মাছের খামার রয়েছে। অপরদিকে, দিহানের মেজ ভাই নারায়ণগঞ্জে যমুনা ব্যাংকের সিনিয়র কর্মকর্তা। তিনিও বৃহস্পতিবার সকালে নারায়ণগঞ্জ চলে যান। দিহানের মা সানজিদা সরকার তার অসুস্থ বাবাকে দেখতে বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় বাড়ি থেকে বের হয়ে বগুড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।

বাসায় কেউ ছিল না বলে দিহান নিজেই ওই শিক্ষার্থীকে ফোন করে গ্রুপ স্টাডির কথা বলে বাসায় আসতে বলে। বেলা ১২টার দিকে ওই শিক্ষার্থী তাদের বাসায় এলে তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন হয়। এক পর্যায়ে দুহান ওই শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে। এরপরে ওই শিক্ষার্থীর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হলে, দিহান ভয় পেয়ে যায়। প্রায় ২০/২৫ মিনিট ধরে তারা রক্তক্ষরণ বন্ধ করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তখন দিহান বাসার নিচে গিয়ে গাড়ি পার্কিং থেকে নিজের গাড়িটি বের করে। দোতালা থেকে ওই শিক্ষার্থীকে ধরাধরি করে নামিয়ে এনে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় মডার্ন আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে হাসপাতালে নেওয়ার পর সেখানে চিকিৎসকরা জানান ওই শিক্ষার্থী আগেই মারা গেছে। তখন সে তার বন্ধু হুমায়িদ মিল্কি, আলভী মাহবুবসহ তিনজনকে ফোন করে হাসপাতালে আসতে বলে। এরপরই পুলিশ তাকে আটক করে কলাবাগান থানায় নিয়ে যায়।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে দিহান আরো জানিয়েছে, সে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে ইডেক্সেল-এ লেভেল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। যে গাড়িটিতে করে ওই শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে- সেটি তার বাবা ২০১৯ সালে তার বাবা তাকে কিনে দিয়েছে। এর আগে তার বাবা তাকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা দিয়ে সুজুকি জিক্সার মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছে। টয়োটা এক্সিও মডেলের গাড়িটি সে নিজেই চালাত। তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। নিহত ওই শিক্ষার্থী ছাড়াও তার সঙ্গে আরো এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে। এ ঘটনায় ওই শিক্ষার্থী যে মারা যাবে-সেটি সে কল্পনা করতে পারেনি। তবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করার পরিকল্পনা থেকে বৃহস্পতিবার ওই শিক্ষার্থীর কাছে সে ফোন দেয় বাসায় আসার জন্য। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার পর আদালত দিহানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, ছোট বেলা থেকেই দিহান বখাটে ছিল। ১৩/১৪ বছর বয়স থেকেই সে এলাকায় মোটরবাইকার হিসেবে পরিচিতি পায়। এলাকায় জোরে হর্ন বাজিয়ে সে মোটরসাইকেল চালাত। লেক সার্কাস এলাকায় দিহান একটি গ্যাং গ্রুপ পরিচালনা করে।

ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ:

শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে নিহতের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ধর্ষণের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। মৃত্যুর আগে চেতনানাশক কিছু খাওয়ানো হয়েছে কিনা, তার জন্য প্রয়োজনীয় নমুনা সংগ্রহ করে কেমিক্যাল পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে। এসব রিপোর্ট পাওয়ার পর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বলা যাবে।’এর আগে বয়স নির্ধারণের জন্য মরদেহের প্রয়োজনীয় আলামত সংগ্রহ করা হয়। পরে স্বজনরা মরদেহ নিয়ে যান।

মামলা দায়ের:

বৃহস্পতিবার রাতেই নিহত শিক্ষার্থীর বাবা বাদী হয়ে কলাবাগান থানায় দিহানকে একমাত্র আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ এ ঘটনায় দিহানের গাড়িটি জব্দ করেছে। পরে সিআইডির ক্রাইমসিন বিভাগ লেকসার্কাসে আব্দুর রউফ সরকারের ফ্ল্যাট থেকে ধর্ষণের বেশ কয়েকটি আলামত জব্দ করে।

এ ব্যাপারে রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ঘটনাটি আমরা কঠোরভাবে তদন্ত করছি। এ ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। ধর্ষণ ও হত্যার বিষয়টি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে এ ঘটনায় দিহানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশের রমনা বিভাগের নিউ মার্কেট জোনের সহকারী কমিশনার আবুল হাসান বলেন, মামলায় ইফতেখার ফারদিন দিহানকেই একমাত্র আসামি করা হয়েছে। দিহানের তিন বন্ধুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদেরও মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here