চাচার মৃত্যুর সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল থেকে ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগের বাসায় ছুটে গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তুহিন। সেখান থেকে মাকে নিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের বাড়ি আবদুল্লাহপুরে। কিন্তু বেপরোয়া বাসের চালক তা আর হতে দিল না। প্রকাশ্যে ছেলের চোখের সামনে পিষ্ট করে মারল জন্মদাত্রী মাকে। এক শোকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় বেপরোয়া চালকের নিষ্ঠুরতায় আরেক গভীর ক্ষত। এমন বর্বরতায় নির্বাক হয়ে পড়েছে তুহিন।
ঘটনাটি ঘটেছে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার মগটুলা ইউনিয়নের বৈরাটি গ্রামে। মাকে নিয়ে ইজিবাইকে চাচার লাশ দেখতে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছিল তুহিন। পথে এমকে সুপার পরিবহনের বেপরোয়া যাত্রীবাহী বাসটি তাদের ইজিবাইককে ধাক্কা দিচ্ছে দেখে আতঙ্কে রাস্তায় ছিটকে পড়েন তুহিনের মা মোছা. শিউলি আক্তার। এর পর বেপরোয়া গতির বাসটি তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে তুহিন চিৎকার করতে করতে মাকে বাঁচাতে বাসের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে বাসটি চলে যায় এক শ গজ সামনে। পিষ্ট করে ফেলে শিউলি আক্তারকে। চাকার নিচ থেকে মাকে উদ্ধার করতে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে তুহিন বাসটি ধাক্কাতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।
মোছা. শিউলি আক্তার (৪২) মাইজবাগ বাজারের ধানচাল ব্যবসায়ী আবদুল মতিনের স্ত্রী। গত বুধবার রাতে মতিনের বড় ভাই মোসলেম উদ্দিন মারা যান। চাচার মৃত্যু সংবাদ শুনে টাঙ্গাইল থেকে বাড়িতে যায় মেহেদী হাসান তুহিন। গতকাল মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাওয়ার পথে তাদের বহনকারী ইজিবাইকটিকে এমকে সুপার পরিবহনের বেপরোয়া গতির বাসটি ধাক্কা দিতে গেলে ইজিবাইক থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়েন শিউলি আক্তার। কিন্তু বাসটি গতি না কমিয়ে আরো দ্রুতগতিতে চলতে থাকে।
তুহিন জানায়, পেছন পেছন দৌড়ে সে বাসটি থামানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তার মাকে একদলা মাংসপিণ্ড বানিয়ে চালক বাসটি রেখে পালিয়ে যায়। এ সময় উত্তেজিত জনতা বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ঠেলে পাশের একটি পুকুরে ফেলে দেয়। এ ঘটনায় ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ঈশ্বরগঞ্জ সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে মাইজবাগ বাসস্ট্যান্ড। ওই বাসস্ট্যান্ডের টাইমমাস্টার নজরুল ইসলাম জানান, গতকাল দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে ময়মনসিংহ থেকে ছেড়ে আসা কিশোরগঞ্জগামী এমকে সুপার পরিবহনের যাত্রীবাহী বাসটি (ঢাকা মেট্রো জ-১৪-২৮০৩) ওই স্টেশন ছেড়ে যায়। মিনিটখানেক পরে কয়েক শ গজ দূরে লোকজনের দৌড়াদৌড়ি আর চিত্কার শুনতে পান তিনি। পরে সেখানে গিয়ে দেখতে পান বাসের চাকার নিচে পিষ্ট হয়ে পড়ে আছেন এক নারী। আর আর্তচিত্কার করছে এক যুবক। পরে জানা গেছে নিহত ওই নারীর ছেলে ওই যুবক। মাকে নিয়ে চার কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়ি মগটুলা ইউনিয়নের আব্দুল্লাহপুরে যাচ্ছিল মারা যাওয়া চাচার লাশ দেখতে।
প্রত্যক্ষদর্শী এরশাদুল ইসলাম, হাবিবুল্লাহ ও সাইফুল ইসলাম জানান, তাঁরা পাশের একটি চায়ের দোকানে বসা ছিলেন। ওই সময় একটি বাসের পিছনে পিছনে দৌড়াচ্ছিল এক যুবক। চিত্কার করে বাসটি থামাতে বলছিল সে। কিন্তু বাসটি আরো দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে কিছু লোক বাসের সামনে কয়েকটি কাঠের টুকরা ফেলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে বাসটি থামে। তখন অন্য যাত্রীর সঙ্গে চালকও নেমে জনতার সঙ্গে মিশে সটকে পড়ে। পরে লোকজন এসে বাসটি পিছনের দিকে ঠেলে ওই নারীর থেঁতলানো নিথর দেহ বের করে আনে।
গতকাল আবদুল্লাহপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নিহত শিউলি আক্তারের ভাসুর মৃত মোসলেম উদ্দিনকে গোসল করিয়ে জানাজার জন্য প্রস্তুত ছিল পরিবারের লোকজন। কিন্তু বাড়ির বধূর এমন মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় সবাই স্তব্ধ হয়ে পড়ে। বাড়ির লোকজনের আহাজারিতে পুরো এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া।
নিহত নারীর ছেলে মেহেদী হাসান তুহিন টাঙ্গাইল মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে পড়াশোনা করে। অন্য দুই বোন স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বুধবার রাতে তুহিনের বাবা আব্দুল মতিন তাকে জানান চাচার মৃত্যুর খবর। গতকাল সকালে মাইজবাগ বাজারে নিজেদের বাসায় গিয়ে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়েছিল তুহিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here