আত্মতুষ্টি সব সময়ই বিপজ্জনক হয়েছে

0
609
মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

 

ইতিহাসবিদদের বড় একটা অংশের মূল্যায়ন হচ্ছে হিটলার, যদি ১৯৪১ সালের জুন মাসে অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) আক্রমণ না করতেন, তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফল ভিন্ন হতে পারত এবং হিটলার আজ ইতিহাসে অন্য রকমভাবে মূল্যায়িত হতেন। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি হিটলারের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের এক বছরের মাথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গতিপথ হিটলারের বিরুদ্ধে চলে যায়। ১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর মাত্র এক বছরের মাথায় ফ্রান্সসহ প্রায় পুরো ইউরোপ হিটলারের বাহিনী দখল করে নেয়। ফলে আত্মতুষ্টির চরমে হিটলারের কাছে মনে হয় চিরশত্রু কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করার বোধ হয় এটাই উপযুক্ত সময়। তার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর মাত্র সাত দিন আগে স্বাক্ষর করা অনাক্রমণ চুক্তি ভঙ্গ করে হিটলার বাহিনী ১৯৪১ সালের জুন মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজিত হওয়ার এটাই অন্যতম একটা প্রধান কারণ। আত্মতুষ্টিতে পেয়ে বসলে শত্রুপক্ষ বা প্রতিদ্বন্দ্বীর সক্ষমতার সঠিক মূল্যায়ন হয় না বলে উপযুক্ত কোর্স অব অ্যাকশনও গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এই সুযোগটিই শত্রুপক্ষ নিয়ে থাকে। হিটলারের বেলায় সেটাই হয়েছিল। বাংলাদেশে এখন একটা রাজনৈতিক যুদ্ধ চলছে। এর এক পক্ষে রয়েছে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি, আর অন্য পক্ষে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষ।

মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী পক্ষের একটা সুনির্দিষ্ট ভোটব্যাংক রয়েছে, যা সংখ্যার হিসাবে কম নয়, বরং তা নিয়ে নির্বাচনে জয়ী হওয়ার প্রত্যাশা করা অমূলক নয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যর্থ হওয়ায় এবং সঠিক রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ না করে শর্টকাট পন্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র ও অপরাজনীতির পথে হাঁটায় তারা এখন রাজনীতির মাঠে অনেকটাই কোণঠাসা ও দিশাহারা। তাদের নেত্রী দুর্নীতির দায়ে আদালত কর্তৃক দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে এখন জেলে আছেন এবং ভারপ্রাপ্ত নেতা আদালতের খাতায় পলাতক আসামি হয়ে ১০ বছর ধরে দেশান্তরে। দলের টপ নেতৃত্বের মধ্যে কোনো ঐক্য ও সমন্বয় নেই। এক নেতা কারওয়ান বাজারের দলীয় কার্যালয়ে বসে প্রতিদিন যা বলেন তাতে দলের অবস্থা ও গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন আরো তলানিতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির জন্য এক প্রকার ফাঁকা মাঠই বলা চলে, যদিও নির্বাচনের সময় ভোট গণনা করলে দেখা যায় ভোটের বাক্সে ওই পক্ষের ভোটের তেমন কমতি নেই। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে পেছনে পড়ার কারণে তারা সাম্প্রতিক সময়ের স্থানীয় নির্বাচনে ভালো ফল করতে পারেনি। এরই প্রতিফলন দেখা গেছে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে। এই নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দল প্রায় ৬৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছে। তবে বিপরীত পক্ষও লক্ষাধিক ভোট পেয়েছে, যা মোটেই হেলাফেলা করার নয়। এতে বোঝা যায় তাদের ভোটব্যাংক স্থির আছে।

খুলনায় বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ায় আত্মতুষ্টি এসে গেলে ভবিষ্যতে সেটি বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। আত্মতুষ্টি পরিত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বাত্মকভাবে মাঠে না নামলে আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিপদের সম্মুখীন হওয়া লাগতে পারে, এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই। বিগত দিনের উদাহরণের দিকে তাকালেও দেখা যায়, যখন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি আত্মতুষ্টির মধ্যে থেকেছে, তখনই বিপর্যয় নেমে এসেছে। ১৯৯১ ও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনই এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক, মিডিয়াসহ জনমনে এমনই ধারণা ছিল যে আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিশ্চিতভাবে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এমন খবরও ছিল বিএনপি পরাজয়ের গ্লানি ঢাকার জন্য ভোটের পরের দিন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে হরতালের কর্মসূচিও ঠিক করে রেখেছিল, অপেক্ষা শুধু ভোটের ফল শোনার জন্য। এর ফলে আওয়ামী লীগের মধ্যে এমন আত্মতুষ্টির সৃষ্টি হয়, পরে শুনেছি ভোটের আগেই নাকি নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে আওয়ামী লীগ নেতারা ড্রয়িংরুমে বসে নিজেদের মধ্যে মন্ত্রিত্ব বণ্টনের হিসাব-কিতাব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই সুযোগটিই গ্রহণ করে বিএনপি ও তাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। আইএসআইয়ের মধ্যস্থতায় রাতারাতি জামায়াতের সঙ্গে আসনভিত্তিক সমঝোতা হয়ে যায় বিএনপির। জামায়াত রেজিমেন্টেড ও ক্যাডারভিত্তিক দল হওয়ায় কোন কোন আসনে জামায়াতের ভোট বিএনপিকে দিতে হবে তা সমন্বয় করার জন্য বেশি সময়ের প্রয়োজন হয় না। তাত্ক্ষণিকভাবে এ কাজটি তারা করে ফেলে। সে বছর নির্বাচনে আইএসআইয়ের টাকা বিএনপির জন্য কিভাবে এসেছিল এবং ব্যবহৃত হয়েছিল, তা এখন সবার কাছে ওপেন সিক্রেট। কিন্তু এসবের কিছুই তখন টের পায় না আওয়ামী লীগ। ফলে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যার পর থেকে যখন ভোটের ফল প্রকাশ হতে থাকে, তখন সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। তবে তখন আর করার কিছুই ছিল না। ফল যা হওয়ার তা-ই হয়ে গেল। অথচ ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনের সব কয়টিতে উপযুক্ত প্রার্থী দেওয়ার মতো সাংগঠনিক অবস্থান বিএনপির ছিল না। ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণেই নতুনরূপে বিএনপি সুসংগঠিত হওয়ার সুযোগ পায়। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলেও ১১৬টি আসন পেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে সংসদে অবস্থান নেয়।

স্বাধীনতার পর থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত যতগুলো সরকার দেশ পরিচালনা করেছে তার সঙ্গে তুলনা করলে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের পারফরম্যান্স ছিল সবচেয়ে চমকপ্রদ ও আশাব্যঞ্জক। সুতরাং দেশের মিডিয়া, জনগণ ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক—সবাই মনে করেছিল ২০০১ সালের নির্বাচনেও জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসছে। কিন্তু এবারেও সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। অতিরিক্ত আত্মতুষ্টির ফলে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার সময় আওয়ামী লীগ বুঝতে পারল না কিভাবে নিজেদের নিয়োগকৃত রাষ্ট্রপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। বুঝতে পারল না প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ দুই সেক্টরের একটা শক্তিশালী আমলা গ্রুপ সরকারের সব আনুকূল্যের ভেতর থেকে কিভাবে ষড়যন্ত্র করছে। ২০০১ সালের জুলাই মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান লতিফুর রহমানের কাছে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের পরের দিন সকালেই বোঝা গেল ষড়যন্ত্রের শিকড় কত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। কিন্তু তখন আর করার কিছুই ছিল না। একটু ভালো করে চোখ মেলার পর দেখা গেল শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে বাইরের শক্তিও জড়িত। সময় গেলে সাধন হয় না, যা হওয়ার তা-ই হলো। একটা কথা প্রচলিত আছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে পরাজিত হলে বাংলাদেশই পরাজিত হয়, যার স্বরূপ বিশেষ করে দেখা গেছে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময়। তখন বাংলাদেশ বিলুপ্ত হয়ে বাংলাদেশ নামের খোলসের ভেতরে আরেকটি পাকিস্তান হওয়ার পথে ধাবিত হচ্ছিল রাষ্ট্র। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় বড় নির্বাচনগুলোর ফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, যখন যেখানেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়েছে তা ঘটেছে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যের কারণে। আওয়ামী লীগ যেখানে ঐক্যবদ্ধ থেকেছে সেখানে তারা কখনো পরাজিত হয়নি। সম্প্রতি খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। সব দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল বলেই বিপুল ভোটে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয় লাভ করেছেন। কিন্তু খুলনা জয়ের আত্মতুষ্টিতে ভুগলে গাজীপুরে বিপদের আশঙ্কা করছেন অনেকেই, যে কথা আগেই উল্লেখ করেছি।

গাজীপুরকে আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলা হয়ে থাকে। ঐক্যবদ্ধ থাকলে আশঙ্কার কোনো কারণ থাকতে পারে না। আহসানউল্লাহ মাস্টার নেই, আজমতউল্লার মতো জনপ্রিয় নেতারা এখনো আছেন। আগেরবার গাজীপুরে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হেরে যাওয়ার পেছনে কিছু স্থানীয় নেতার নিষ্ক্রিয়তাই দায়ী বলে তখন পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল। এবারে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর রাজনৈতিক পরিপক্বতা নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। তাই দলের কেন্দ্র থেকে সমন্বয় না করলে বিপদ হতে পারে। গাজীপুরের নির্বাচন হবে জুন মাসের শেষের দিকে। এখনো সব কিছু ঠিক করে নেওয়ার যথেষ্ট সময় আছে। কথায় আছে, ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়’ সমান। গাজীপুরের নির্বাচন খুলনার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আগামী জাতীয় নির্বাচনের ওপর এর প্রভাব পড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। সুতরাং আত্মতুষ্টিতে না থেকে আগামী দিনে অনুষ্ঠেয় সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা উচিত। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনটি যদি দুটি গণতান্ত্রিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির মধ্যে লড়াই হতো, তাহলে সাধারণ মানুষের তা নিয়ে ভাবনার বড় কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু তা তো নয়। লড়াইটা হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের মধ্যে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কি উদার গণতান্ত্রিক ও পরিপূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ থাকবে, নাকি দেশ আবার পাকিস্তানিতন্ত্রের দিকে ধাবিত হবে। সুতরাং আত্মতুষ্টি নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ লড়াইয়ে জিততে হবে।

লেখক : কলামিস্ট ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here