রওশন হাসান
মঙ্গলবার ২৮শে আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র নিউইয়র্কে তিনবাংলা আয়োজন করে এক সম্বর্ধনার l বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বীরাঙ্গনা সমগ্র’ এর লেখক সুরমা জাহিদকে এ সম্বর্ধনা প্রদান করা হয় l সুরমা জাহিদ গত ১৫ই আগস্ট নিউইয়র্কে সপরিবারে আসেন l নিউইয়র্কের জ্যামাইকার স্টার কাবাব পার্টি হলে লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, মিডিয়াকর্মী ও নিউইয়র্কে বসবাসরত বহুসংখ্যক বাঙালির উপস্থিতিতে এ আয়োজন সম্পন্ন হয় l অনুষ্ঠান শুরুর পূর্বে আপ্যায়ন ও পরিচিতি পর্বে লেখক-সাংবাদিক মনিজা রহমান লেখক সুরমা জাহিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। l ভাস্কর্যশিল্পী ও বীরাত্মা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীকে তিনবাংলার এ আয়োজন উৎসর্গ করা হয় l
অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধান অতিথি তাজুল ইমাম, তিনবাংলা সভাপতি নার্গিস আহমেদ, বিশেষ অতিথি এডভোকেট এন মজুমদার, লেখক সুরমা জাহিদ, চিত্রকর-স্থপতি দম্পতি সুরমা জাহিদের জামাতা ও কন্যা রফিক আজম ও নূরে জান্নাত জুঁই মঞ্চে আসন গ্রহণ করেন l মুক্তিযোদ্ধা ও বহুমাত্রিক শিল্পী তাজুল ইমাম অনুষ্ঠানের উদ্ভোধনী ঘোষণা দেন l শিল্পী শাহ হামজা ও উপস্থিত অংশগ্রহণকারী কতৃর্ক বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে এ অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয় l অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ও সার্বিক তত্বাবধানে ছিলেন তিনবাংলা সাধারণ সম্পাদক কবি রওশন হাসান l তিনবাংলা নির্বাহী সম্পাদক সীমু আফরোজা সুরমা জাহিদকে ফুল দিয়ে অভ্যর্থনা জানান l
লেখক সুরমা জাহিদের চারখন্ডের বীরাঙ্গনা সমগ্র, কবি রওশন হাসান ও লেখক শরীফ মাহবুবুল আলমের বই গ্রন্থপ্রদর্শনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয় l
আগস্ট মাস বাঙালি জাতির জন্য শোকাবহ মাস, তিরোধানের মাস। এমাসেই আমরা হারিয়েছি জাতির পিতাকে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, দেশপ্রেমিক, রাজনীতিবিদদের l অধিকাংশের স্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যাকান্ড সংগঠিত হয়েছিল আগস্ট মাসে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু,সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, কবি শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরী তাঁদের মধ্যে অন্যতম l সকল বিদেহী আত্মা, যুদ্ধশহীদ, বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় l লেখক-মুক্তিযোদ্ধা ড. নুরুন্নবী অসুস্থতাজনিত কারণে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেননি বলে দুঃখপ্রকাশ করে লেখক সুরমা জাহিদের উদ্দেশ্যে একটি শুভেচ্ছাবানী পাঠান l সঞ্চালক কবি রওশন হাসান ড. নুরুন্নবীর এ শুভেচ্ছাবানী পাঠ করেন l
লেখক সুরমা জাহিদ, প্রধান অতিথি তাজুল ইমাম, রফিক আজম ও নূরে জান্নাত জুঁইকে উত্তরীয় পরিয়ে দেন সভাপতি নার্গিস আহমেদ ও তিনবাংলা সংশিষ্ট সদস্যবৃন্দ l বীরাঙ্গনা সমগ্র থেকে ড. আনিসুজ্জামানের লেখা মুখবন্ধ পাঠ করেন সঞ্চালক কবি রওশন হাসান l বীরাঙ্গনা সমগ্র এর চার খন্ডের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধান অতিথি, সভাপতি, তিনবাংলার নির্বাহী সম্পাদক কবি সীমু আফরোজা, তিনবাংলা সদস্য লেখক শরীফ মাহবুবুল আলম ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী শফিকুল হক l
গ্রন্থ আলোচনা পর্বে অংশগ্রহণ করেন সাহিত্যিক-সাংবাদিক আহমেদ মাযহার, সাংবাদিক-লেখক ওবায়দুল্লাহ মামুন, লেখক অভীক বসু ও লেখক-সাংবাদিক শামসাদ হুসাম চৌধুরী l বীরাঙ্গনা সমগ্র থেকে পাঠপর্বে অংশগ্রহণ করেন আবৃত্তিশিল্পী শুক্লা রায়, লেখক ড. বিলকিস রহমান, লেখক শেলী জামান খান, কবি-সাংবাদিক ছন্দা বিনতে সুলতান ও কবি সীমু আফরোজা l বীরাঙ্গনা সমগ্রের চারটি খন্ড থেকে যুদ্ধকালীন বীরাঙ্গনাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কিয়দংশ পাঠের অন্তর্ভুক্ত ছিলো l প্রধান অতিথি শিল্পী-মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের পরিচিতি পড়ে শোনান কবি-সঞ্চালক রওশন হাসান l মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী তাজুল ইমাম যুদ্ধে অংশগ্রহণকালীন স্মৃতিচারণ করেন l ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাব সম্ভ্রম হারানো মা বোনদের জন্য অত্যন্ত লঘু প্রাপ্তি বলে তিনি মনে করেন l তিনি বলেন বীরাঙ্গনা ও মুক্তিযোদ্ধা সমমর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী lতিনি যুদ্ধনারীদের প্রতি ক্ষমা প্রার্থনা করেন l বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত হানাদারবাহিনীর মত নারী ও শিশু ধর্ষণ ঘটনা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও স্বাধীনতা পরিপন্থি বলে তিনি মতপ্রকাশ করেন l
বিশেষ অতিথি এডভোকেট এন মজুমদার এ আয়োজনে উপস্থিত হতে পেরে গর্ববোধ করেন l লেখক সুরমা জাহিদের কর্মের ভূয়সী প্রশংসা করে তিনবাংলার আয়োজকদের ধন্যবাদ জানান l
বক্তব্যে লেখক সুরমা জাহিদ তাঁর গবেষণা কর্মে প্রতিবন্ধকতা ও মানসিক প্রতিক্রিয়ার কথা ব্যক্ত করে বলেন বীরাঙ্গনাদের মুখোমুখি হওয়াটা তাঁর জন্য অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল l প্রথমদিকে সাহিত্যিক রাহাত খান এ কাজে সহযোগিতা করেছিলেন l পরবর্তীতে রাহাত খান অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর স্বামী জাহিদ হোসেন তাঁকে সর্বাত্মকভাবে এ কাজে সহায়তা করেন l বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে বীরাঙ্গনাদের সম্ভ্রমহানির জবানবন্দি সংগ্রহ করা দূরহ ব্যাপার ছিল l তিনি জানান মাঠপর্বের এ কাজে বীরাঙ্গনাদের কাছে পৌঁছে তিনি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন l বীরাঙ্গনাদের পাশবিক নির্যাতনের বর্ননা শুনে মানসিকভাবে তিনি মুষড়ে পড়েছিলেন l এ পর্যন্ত চার খন্ডে গ্রন্থভূক্ত হয়েছে ৩৬১ জনের জবানবন্দি l আরও ৩০০ জবানবন্দি এখনও প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে l সুরমা জাহিদ তিনবাংলা ও আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন l
অনুষ্ঠানে একে একে তাঁদের বক্তব্য রাখেন স্থপতি রফিক আজম, কবি কাজী জহিরুল ইসলাম, প্রীতম প্রকাশের প্রতিষ্ঠাতা ও নারী পত্রিকা নিউইয়র্কের কর্ণধার পপি চৌধুরী ও অধ্যাপিকা হোসনে আরা বেগম l কবি কাজী জহিরুল ইসলাম তাঁর সদ্য প্রকাশিত ইংরেজি কবিতার বই smell of dust লেখক সুরমা জাহিদের হাতে তুলে দেন l
অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা তিনবাংলা সভাপতি ও সোস্যাল এক্টিভিটস নার্গিস আহমেদ তাঁর বক্তব্যে অংশগ্রহণকারী সকলকে ও তিনবাংলা সংশ্লিষ্ট সদস্যদের শ্রমসাধ্য আয়োজনের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানান l লেখক সুরমা জাহিদের এ অমূল্য সংরক্ষণকে সাধুবাদ জানান l বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নারীশিশু ধর্ষণের আধিক্যের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর বক্তব্যের ইতি টানেন l
অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা সরাফ সরকার, এডভোকেট মোহাম্মদ আলী বাবুল, সোস্যাল এক্টিভিটস মোর্শেদ আলম, লেখক নাসরিন চৌধুরী, লেখক-গীতিকার ইসতিয়াক রুপু আহমেদ, কবি হাবিব ফয়েজী, এডভোকেট শেখ আকতার উল ইসলাম, শিল্পী দুলাল ভৌমিক, চিত্রকর সোমা বসু, অভিনেত্রী রোকেয়া রফিক বেবী, কানেক্টিকাট থেকে আগত ড্রিসট্রেস চিল্ড্রেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ড. এহসানুল হক, কবি আব্দুস শহীদ, সাপ্তাহিক পরিচয় সাংবাদিক নাজমুল আহসান, লেখক-সাংবাদিক বাংলাদেশ সম্পাদক তাসের মাহমুদ, কবি কামরুন্নাহার রিতা, স্বপ্না ইমাম, লেখক ড. আবুল কাসেম, লেখক মুক্তি জহির ও টিবিএন ও টাইম টিভি মিডিয়া কর্মীর উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য l পুরো অনুষ্ঠানের আলোকচিত্র ধারণ করেন তিনবাংলা সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কাজী শফিকুল হক l
রাত্রিভোজন ও বীরাঙ্গনা বিষয়ক শিল্পী শাহ হামজার গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে রাত্রি এগারোটায় এ স্মরণীয় আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে l এ আয়োজনে ষাটেরও অধিক বিশিষ্টবর্গ অংশগ্রহণ করেন l অংশগ্রহণকারী সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ সহযোগিতার জন্য l