আবদুল মান্নান

দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে বিদেশে যাওয়া নিঃসন্দেহে গৌরবের ও সম্মানের। সম্প্রতি জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গী হয়ে সেই গৌরব ও সম্মানের অংশীদার হতে পেরে নিঃসন্দেহে আমি আনন্দিত। অবশ্য এর আগেও তিনি আমাকে দুইবার তাঁর সফরসঙ্গী করেছেন। ২০১৫ সালে তাঁর জাপান সফরের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলাম আর গত বছর ভারত সফরের সময় তিনি আমাকে তাঁর সফরসঙ্গী করেছিলেন। শেখ হাসিনা সম্পর্কে বাজারে অনেক জানা-অজানা কথা চালু আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, তিনি ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করতে পারেন। সেই ক্লান্তিহীন যে কত ক্লান্তিহীন, তা তাঁর সফরসঙ্গী যাঁরাই হয়েছেন তাঁরা বুঝতে পারেন। এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়ার যখন আমন্ত্রণ হাতে এলো তখন বেশ খুশিই হয়েছিলাম। কারণ শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদে এটি তাঁর শেষ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর সফরসঙ্গীদের নিয়ে যখন ব্রিফ করা হলো তখন বুঝতে পারলাম এবারের অধিবেশনটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, শেখ হাসিনার জন্যও। কারণ এ অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্বশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের জন্য দুটি অ্যাওয়ার্ড বা সম্মাননা দেওয়া হবে। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘের মূল অধিবেশন ও একাধিক পার্শ্ব সেশনে রোহিঙ্গা সমস্যা ছাড়াও আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরবেন।

শেখ হাসিনার বিদেশ সফর, বিশেষ করে জাতিসংঘ সফরসঙ্গীর তালিকা নিয়ে প্রতিবারই কিছু নাদান ব্যক্তি কিছু অর্থহীন বক্তব্য প্রকাশ করেন। বিশেষ করে ব্যবসায়ীদের কেন তিনি সরকারি অর্থে সফরসঙ্গী করেন। এবারও এর ব্যতিক্রম দেখা গেল না। একজনকে দেখা গেল নিউ ইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস এলাকায় একটি গাড়িতে বসে বেশ দীর্ঘ সময় ধরে ফেসবুকে লাইভে এসে এমন প্রশ্ন তুলে বলছেন, ‘শেখ হাসিনাকে কেন প্রতিবছর জাতিসংঘের অধিবেশনে এত বিরাট দল নিয়ে (তাঁর মতে ২২২ জন) আসতে হবে? খালেদা জিয়া বা অন্য কোনো সরকারপ্রধান তো কখনো এতবার জাতিসংঘ অধিবেশনে আসেননি।’ এমন সমালোচনা যাঁরা করেন, তাঁদের জানার ও বোঝার প্রচুর ঘাটতি আছে। এবার জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর প্রকৃত ডেলিগেটের সংখ্যা ছিল ৮০। এর মধ্যে আছেন তাঁর নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, ছোট বোন শেখ রেহানা, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, আছেন কয়েকজন সংসদ সদস্য, তিনজন মন্ত্রী (পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী), কয়েকজন সচিব, কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সিভিল সোসাইটির কয়েকজন সদস্য। সাংবাদিকও আছেন কয়েকজন। কয়েকজন ব্যবসায়ী ও দলীয় নেতা গেছেন ও হোটেলে থেকেছেন নিজ খরচে। মূল প্রতিনিধিদলের সদস্যরাই শুধু জাতিসংঘের অধিবেশনগুলোতে অংশ নিয়েছেন। প্রতিটি অধিবেশনেই অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য আসন নির্ধারিত থাকে আর অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার জন্য বিশেষ প্রবেশপত্র প্রয়োজন হয়, যা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের জন্য সীমিত সংখ্যায় বিলি করা হয়। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র চেম্বারের মতবিনিময়সভার আয়োজনটি আমাদের হোটেলেই করা হয়েছিল। খালেদা জিয়া কেন নিয়মিত জাতিসংঘের অধিবেশনে যাননি, তা তিনি ভালো বলতে পারবেন। একটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান বিশ্বসভায় বক্তব্য দেওয়ার তাৎপর্যই আলাদা। যে ব্যক্তি ফেসবুক লাইভ করছিলেন তিনি মন্তব্য করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও এত বড় সফরসঙ্গী ও দল নিয়ে জাতিসংঘে আসেন না।’ এটি একটি আহাম্মকি মন্তব্য। ট্রাম্পের সফরসঙ্গী হয়তো বড় ছিল না, যেহেতু রাষ্ট্রসংঘটি তাঁর দেশে অবস্থিত। কিন্তু যেদিন ট্রাম্প সাধারণ অধিবেশনে বক্তব্য দিলেন, সেদিন নিউ ইয়র্কের ব্যস্ততম ম্যানহাটান (জাতিসংঘ সদর দপ্তর এখানে অবিস্থত) এলাকা প্রায় ২৪ ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিল। বিভিন্ন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ছিলেন কম করে হলেও হাজার পাঁচেক। কুকুর ছিল শ দুয়েক। আমাদের যে হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেই গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। একই হোটেলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়াও কম করে হলেও এক ডজন দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা উঠেছিলেন। সবার সঙ্গেই বড় আকারের সফরসঙ্গী ছিল। কিছু মানুষ আছেন যাঁরা সুযোগ পেলেই শেখ হাসিনার কাজের বা কথার কোনো কারণ ছাড়া সমালোচনা করতে দ্বিধা করেন না, কথাগুলো এ কারণেই লিখতে হলো। তাঁরা স্বীকার না করলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর, যেমনটি স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ছিলেন তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন দেখেছি, বিদেশে বাংলাদেশকে মুজিব কান্ট্রি হিসেবে চিনত। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘে প্রথম ও শেষবারের মতো তাঁর ঐতিহাসিক উপস্থিতির মাধ্যমে বাংলায় বক্তব্য দেন এবং বলেন, ‘আজ বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত, শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এখানে উল্লেখ্য, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ যখন জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করে, তার বিরুদ্ধে ভেটো দিয়ে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভ আটকে দেয় চীন। অথচ চীন ঠিক এর ১০ মাস আগে জতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করে, যখন চীনকে তাইওয়ানের স্থলে জাতিসংঘ স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর জাতিসংঘের প্রথম ও একমাত্র উপস্থিতি এ কারণেই ঐতিহাসিক। কারণ তিনি যখন বিশ্বসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের কারণে একজন বিশ্বনন্দিত ও পরিচিত রাষ্ট্রনায়ক, যিনি একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছেন। হয়ে উঠেছিলেন বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রতীক।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের সময় নির্ধারিত ছিল ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায়। মূল হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শোনার জন্য বাংলাদেশের আনুমানিক ৩০ জন প্রতিনিধিকে প্রবেশপত্র দেওয়া হয়েছিল। তাঁরা সবাই ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বসেছিলেন। কিছু দেওয়া হয়েছিল ওপরে দর্শক গ্যালারির জন্য। আমাদের জন্য নির্ধারিত ভিআইপি আসনস্থলে আরো বসেছিলেন নেপালের কিছু প্রতিনিধি। আমরা যখন আমাদের আসনে বসি তখন নেপালের প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিচ্ছিলেন। মূল হলে প্রবেশের আগে কফি শপে পরিচয় হলো নিকোলাস বার্নসের সঙ্গে (আসল নাম নয়)। জাতিসংঘের একজন সহকারী সেক্রেটারি। বললেন, তোমাদের প্রধানমন্ত্রী বেশ স্মার্ট। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাই কয়েক দিন আগে আমাদের দেশ থেকে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এসেছিলেন জাতিসংঘে এই প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে অভিযোগ জানাতে। উত্তরে নিকোলাস বললেন, জাতিসংঘে কত মানুষই নানা রকমের আবদার নিয়ে আসেন। তাঁদের কথা হয়তো আমরা শুনি; কিন্তু সব কথা গুরুত্বসহকারে নিই না। হয়তো তোমাদের দেশ থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা এমন কেউ হবেন। আর কথা বাড়াই না। মির্জা ফখরুলের মিশনের একটা ধারণা পাওয়া গেল।

বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ২৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক পৌঁছে। সেদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেওয়া এক সংবর্ধনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। নিকটস্থ হিল্টন হোটেলে অনুষ্ঠিত এ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহর থেকে আসা প্রায় হাজার দুয়েক বাঙালি সমবেত হয়েছিল। জাতিসংঘে ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া বাংলাদেশের কর্মসূচি ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর মূল অধিবেশনে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। মূল অধিবেশন ছাড়াও প্রায় ৩০টি পৃথক আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আবার কয়েকটিতে শুধু প্রধানমন্ত্রী বা পররাষ্ট্রমন্ত্রী অংশ নেন। এর মধ্যে কয়েকটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে ছিল—১. বিশ্ব শরণার্থী বিষয়ক আলোচনা, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা; ২. সাইবার সিকিউরিটি; ৩. জলবায়ু পরিবর্তন। এ সব কটিতেই বাংলাদেশি প্রতিনিধিরা পালা করে অংশ নিয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের ৭৩তম অধিবেশনের মূল কর্মসূচি ছিল সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ। আমাদের জন্য নির্ধারিত আসনে বসে দেখি, শেখ হাসিনা আগেই অধিবেশনস্থলে এসে আমাদের সামনে বাংলাদেশ গ্যালারিতে বসে নিজের ভাষণের কপির ওপর চোখ বোলাচ্ছিলেন। শেখ হাসিনার এই একটা গুণ। তিনি কোনো সভায় বক্তব্য দিতে গেলে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে যান; যার বড় প্রমাণ তাঁর সংবাদ সম্মেলন ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকার। তাঁর নিউ ইয়র্ক অবস্থানকালে তিনি রয়টার্স ও ভয়েস অব আমেরিকাকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দেশে ফিরে বুধবার দেশের সাংবাদিকদেরও মুখোমুখি হয়েছেন। অন্যদিকে খালেদা জিয়া কোনো সংবাদ সম্মেলনে কোনো সাংবাদিকের প্রশ্ন নেওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না।

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আগে বক্তব্য দেন প্যাসিফিক সমুদ্রে অবস্থিত টুুভ্যালু দ্বীপরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এসব অঞ্চলের সব রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্লোবাল ওয়ার্মিং। শেখ হাসিনা যখন বক্তব্য দিতে মূল মঞ্চে উঠলেন তখন তাঁকে আমরা সবাই করতালি দিয়ে অভিবাদন জানালাম। সন্ধ্যা ৭টায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ শুরু করেন। যথারীতি বাংলায়। যেহেতু বাংলা এখনো জাতিসংঘের দাপ্তরিক ছয়টি ভাষার একটি নয়, সেহেতু বিশেষ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ জাতিসংঘের সব ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, শেখ হাসিনার উদ্যোগে এরই মধ্যে বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে। শুরুতেই তিনি তাঁর পিতার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘৪৪ বছর আগে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সব নর-নারীর গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। এই দুঃখ-দুর্দশা-সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল। আমার বাবা বাংলাদেশের জনগণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘ সংগ্রামে ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৭১ সালে। এই দীর্ঘ সংগ্রামে প্রায় ১৪ বছরই তিনি কারাগারে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল বারবার।’ শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদেরও ছাপিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমাদের পথচলা এখনো শেষ হয়নি। এই পথচলা তত দিন চলবে যত দিন না আমরা আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা এবং শোষণমুক্ত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে পারব।’

শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রধান বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা। এ প্রসঙ্গে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে তার বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। এজাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে যত ধরনের চুক্তি বা সমঝোতা হয়েছে তার কোনোটাকেই মিয়ানমার গুরুত্ব দিচ্ছে না।’ শেখ হাসিনা বাংলাদেশ ও তার জনগণ রোহিঙ্গাদের জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করছে, তা সবাইকে আবারও মনে করিয়ে দেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ‘জয় বাংলা’ বলে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। তাঁকে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতারা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান।

বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপরই শেখ হাসিনাকে ৮ নম্বর সভাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে জাতিসংঘের ইন্টার প্রেস সার্ভিসের পক্ষ থেকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, দায়িত্বশীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের জন্য দুটি অ্যাওয়ার্ড বা সম্মাননা দেওয়া হবে। আমরা তাঁকে অনুসরণ করি। সেখানে উপস্থিত ছিলেন উদ্বাস্তুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক উইলিয়াম লেইসি সুইং, জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্ক লোওকক ও কানাডার আন্তর্জাতিক উন্নয়ন মন্ত্রী মিস ম্যারি ক্লড বিভিই। তাঁরা সবাই শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মানবিক গুণাবলির ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, তিনি বর্তমানে নিঃসন্দেহে বিশ্বনেতাদের জন্য একজন রোল মডেল। পরদিন ছিল শেখ হাসিনার জন্মদিন (বাংলাদেশে এরই মধ্যে তা পালিত হয়েছে)। সবাই তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান এবং বলেন, এই পুরস্কার প্রকৃত অর্থেই তাঁর জন্মদিনের শুভেচ্ছা। পুরস্কার গ্রহণ করে শেখ হাসিনা বলেন, তিনি তাঁর এই পুরস্কার বাংলাদেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করছেন। অনুষ্ঠানটি ছিল সংক্ষিপ্ত। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর তাঁকে গিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতেই তিনি জানতে চান আমরা সবাই ভালো আছি তো? সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কত আপনজন। তাঁর মধ্যে ছিল না কোনো মেকি গাম্ভীর্য, ছিল একরাশ ক্লান্তি। কিন্তু ছিলেন বেশ উৎফুল্ল। মুখে ছিল কিছুটা তাঁর শিশুসুলভ হাসি। ২৮ তারিখ আমাদের হোটেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব (মন্ত্রী) মাইকেল পম্পেও। দুজনের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ হলো একান্তে। বলার অপেক্ষা রাখে না, মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব শুধু নির্বাচিত সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এই সফরে শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশের যতজন সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন, সবাই-ই প্রত্যাশা করেছেন আগামী নির্বাচনে তিনি যেন ভালো করেন এবং পরবর্তী অধিবেশনে যেন তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হয়। বিকেলে আমরা যখন দেশে ফেরার জন্য বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা করব হোটেলের বাইরে দেখি, কয়েক শ বাঙালি জড়ো হয়েছে তাদের প্রিয় নেত্রীকে একনজর দেখবে বলে। বঙ্গবন্ধুকন্যা তাদের হতাশ করেন কিভাবে। তিনি লবিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান। সবাই দোয়া করে, যেন তিনি পরের বছর আবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিশ্বসভায় এসে বাংলাদেশ ও বাঙালির কথা তুলে ধরতে পারেন, যেমনটি তাঁর বাবা প্রথমবারের মতো ৪৪ বছর আগে তুলে ধরেছিলেন।

লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here