স্বপ্নবাজ এক মানুষের কথা………

0
292

শওকত মিল্টন :

আমাদের স্বপ্নের মানুষরা হারিয়ে যায়, এ শহরের সবুজের মতো। শীতের পাতা ঝড়ার দিনগুলো যেন তাদের কথা মনে করে, তুমুল বৃষ্টির রাতগুলো কাঁদে। রাজা রায় বাহাদুর সড়কের কালো পীচ ঢালা পথ যেন তাঁদের স্মরনে বুকে ধারন করে লম্বা কালো ব্যাজ। আমাদের বরিশালে যাঁরা স্বপ্নবাজ ছিলেন, যাঁরা স্বপ্ন দেখাতেন- তাঁরা একে একে শরতের শাদা কাশের মতো, ধলপহরের দূর আকাশের জ্বলজ্বল তারা। শত সহস্র যোজন দূরে। আমাদের সেইসব দিনগুলো-যখন কেবলই সামনের দিকে চলা, তখন এক স্বপ্নবাজ ছিলেন এই শহরে। হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো ছিলো তাঁর সম্মোহনী, সারা শহর তিনি হেঁটে বেড়াতেন। লিখতেন চমৎকার ঝরঝরে গদ্য , এই শহরের সব কিছুতে ছিল তাঁর পদচারনা। তিনি আজাদ ভাই-কাগজে কলমে যাঁর নাম নশরত শাহ, আমাদের কাছে জনপ্রিয়তা তাঁর মামা ডাক। তাঁর প্রভাব আমার ব্যক্তি জীবনে কম নয়। এক সময় দিনের একটা বড় সময় তাঁর সাথেই কাটতো। গৌরনদী উপজেলাতেই তাঁদের আদি বাড়ী। একাত্তরে সেখানেই ছিলেন, সেই দারুন অভিজ্ঞতার কথা তিনি বলেছিলেন বাংলা একাডেমীর প্রকাশনায়। লম্বা একহারা এই মানুষটি, আমাদের ডাকে সব সময় সাড়া দিতে প্রস্তত থাকতেন। তাঁর প্রেম, বিয়েও কম আলোচিত ছিলো না এই শহরে। হাঁটা বাবা আজাদ ভাই বিয়ের পরও ব্যাচেলর ছিলেন। তাঁদের বাসা ছিলো আগরপুর সড়কে আর মুন্না আপাদের রূপাতলী পাওয়ার হাউসে। বেশ কয়েক দিন লাপাত্তা আজাদ ভাইকে মুন্না আপা ধরে নিয়ে যেতেন রাস্তায়, যেখানে পেতেন-সেখান থেকেই। আজাদ ভাই সুবোধ বালকের মতো মুন্না আপার সাথে রিক্সায়। আমরা বলতাম আজাদ ভাই এ্যারেস্ট। বরিশালের চারুকলা বিদ্যালয়, অক্ষর সাহিত্য, বরিশাল নাগরিক পরিষদ এমন অনেক কিছুর সাথেই তাঁর সম্পর্ক ছিলো নিবিড়। বিদেশে ঘোরাফেরার ব্যারামের সূত্রপাতেও তিনি ছিলেন। আমি, গনেশ আর আজাদ ভাই জনপ্রতি একশো ডলার নিয়ে দার্জিলিং আর সিকিম ঘুরে ছিলাম। আমাদের এই আলোকিত মানুষটি হঠাৎ চলে গেলেন দেশ ছেড়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। জানি এর পেছনেও ছিলো অনেক কিছু। এক যুগ আগে আমাদের শেষ দেখা, বীথিকে একটা লাল মাফলার দিয়ে। সেই মাফলার গুপ্তধনের মতো এখনো আমাদের কাছে। বরিশালের জল হাওয়া যাঁর কাছে অমূল্য তিনি কি করে থাকলেন এভাবে? সেসব নিয়ে সমালোচনার এক ঝড়ো হাওয়া আমার মনেও বইতে পারে, তবে তাঁর চেয়েও বড় ঝড় এক আমার মনকে স্পর্শ করে। আমার মার্কিন ফোনে আজাদ ভাই। কাজ বাদ দিয়ে কয়েক ঘন্টার পথ মাড়িয়ে শেষ দুপুরে তিনি হাজির। এক যুগ পর তাঁর মুখোমুখি, মাথার চুলে রূপালী পোছ। সেই একই প্রাণ শক্তি। চেহারায় যেন একটু ক্লান্তির ছাপ। হতে পারে আমার চালশে চোখের নতুন চশমা একটু বেশীই দেখে। আমরা দিন ভর নিউ ইয়র্কের ব্যাস্ত এভিন্যুতে বরিশালের সদর রোড খুঁজি, হাডসনের সাথে যে কীর্তনখোলার মতো ঢেউ নেই, জ্যামাইকার রেস্তরার পরাটায় নেই বলাকার স্বাদ-এমন সব আলোচনার নামে আমরা আসলে বরিশালেই ফিরতে চেয়েছি। রাতে গ্রান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনে আজাদ ভাইকে বিদায় জানাই। আবারো কয়েক ঘন্টার পথ পেড়িয়ে কানেকটিকাট রাজ্যের নিজের ঘরে ফিরবেন। সেখানে কিংকিনী অপেক্ষা করছে তার লাল ভোক্সওয়াগন নিয়ে প্রিয় বাবার জন্য। কবে আবার আজাদ ভাই তাঁর প্রিয় শহরে ফিরবেন জানি না। আমার খুব ইচ্ছে আবারও এক কোজাগরী পূর্ণিমায় চন্দ্রাহত হবো, আমি আর আজাদ ভাই হাঁটবো। কীর্তনখোলার তীরে গিয়ে খুঁজবো নিজেদের। বরিশাল অপেক্ষায় তাঁর এক স্বপ্নবাজ বংশীবাদকের জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here