মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম : কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদার ছিলেন অগ্নিযুগের কিংবদন্তি বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের সহযোদ্ধা। তাঁর কাজ ছিল তরুণ যুবক ও ছাত্রদেরকে বিপ্লবী দলে এনে বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত করা। এমনকি নিজ দলের বিপ্লবীদেরকেও তিনি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন কলা-কৌশল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলে পূর্ণেন্দু দস্তিদারই প্রথম নারীদের অন্তর্ভূক্ত করেন এবং কল্পনা দত্ত ও প্রীতিলতাসহ আরো অনেক নারীকে সংগঠিত করেন। তাঁর বড় ভাই অর্ধেন্দু দস্তিদার জালালাবাদ পাহাড় দখলের যুদ্ধে শহীদ হন।
অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী, কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও লেখক কমরেড পূর্ণেন্দু দস্তিদার এর জন্ম ১৯০৯ সালের ২০ জুন চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে। তাঁর পিতার নাম চন্দন কুমার দস্তিদার এবং তাঁর মাতা কুমুদিনী দস্তিদার। পূর্ণেন্দু চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯২৫ সালে এন্ট্রান্স ও ১৯২৭ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলেও সূর্যসেন এর সহযোগী হিসেবে কলকাতায় গ্রেফতার হন এবং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ত্যাগ করেন। জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় ১৯৩৪ সালে তিনি ডিস্টিংশন সহ বিএ পাস করেন এবং পরে বিএল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪০ সালে জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি চট্টগ্রাম আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ার পর তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জেলে আটক থাকা অবস্থায় পূর্ণেন্দু দস্তিদার চট্টগ্রাম জেলার সংরক্ষিত আসন থেকে কংগ্রেস প্রার্থী বিনোদ বিহারী দত্তকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালে জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি পূর্ববঙ্গ আইন সভায় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের (১৮ এপ্রিল ১৯৩০) স্মারক স্তম্ভ নির্মাণের প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং ১৯৫৬ সালে তা গৃহীত হয়।
কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকায় পূর্ণেন্দু দস্তিদার ১৯৫৭ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে (ন্যাপ) যোগ দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশনা মতো কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির পর তিনি আবারও গ্রেফতার হন এবং ১৯৬২ সালে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদে চট্টগ্রাম-১১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭১ সালের ৯ মে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার পথে পূর্ণেন্দু দস্তিদার এর মৃত্যু হয়।
পূর্ণেন্দু দস্তিদার সাহিত্যিক এবং অনুবাদক হিসেবেও খ্যাতিলাভ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, ‘কবিয়াল রমেশ শীল’, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ উল্লেখযোগ্য। ‘শেখভের গল্প’, ‘মোপাশাঁর গল্প’ তাঁর উল্লেখযোগ্য অনুবাদকর্ম ।
প্রায় বাষট্টি বৎসরের জীবনকালে তাঁর কারাজীবন ছিল দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশি। বাংলার মানুষকে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্ত করাই ছিল তাঁর আজীবনের স্বপ্ন ও সংগ্রাম।
সূত্র : সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ফেসবুক স্ট্যাটাস